চিহ্নিত কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পর এবারের বিজয় দিবসে ছিল মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস; আয়োজনেও দেখা গেছে ভিন্নতা।
Published : 16 Dec 2015, 07:48 PM
কোনো দাবি নয়, বরং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শপথ প্রতিধ্বনিত হয়েছে কোটি কণ্ঠে।
এমন আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর শপথ নিয়ে বুধবার ৪৫তম বিজয় দিবসে শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধার ফুল নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জড়ো হন নানা শ্রেণি-পেশার লাখো মানুষ।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার এই দিনে স্মৃতির মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে কেউ এসেছিলেন লাল-সবুজের পতাকা হাতে আবার কেউবা লাল-সবুজের সাজে।
মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি কর্মী ও রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতাসহ বিদেশি নাগরিকদেরও স্মৃতিসৌধে এসে বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে দেখা গেছে।
মুক্ত স্বাধীন লাল-সবুজের বাংলাদেশ নির্মাণে অগ্রসেনানীদের একজন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী। এবারের বিজয় দিবস ‘ডাবল বিজয়ের’ পরিতৃপ্তি নিয়ে এসেছে বলে জানালেন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা।
বললেন, “৪৪ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি আর এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলাম। এবার আমাদের ‘ডাবল বিজয়।”
পুষ্পস্তবক অর্পণে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সহ-সভাপতির দায়িত্বে থাকা আবু ওসমান চৌধুরী।
সকালে জাতির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই পর্ব শুরু হয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠনের জন্য।
এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জনতার ঢল নামে মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিস্তম্ভের দিকে।
সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর আগে ১০টার দিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যায়।
স্ত্রী রোকেয়া বেগমের সঙ্গে হুইল চেয়ারে ছেপে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসেন কুষ্টিয়ার মুকুল আলী মালিথা। 'বিএনপি কর্মীদের' হামলায় আহত এই আওয়ামী লীগ কর্মী সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) চিকিৎসাধীন।
পা-মাথায় জখম নিয়ে ওই কেন্দ্রে তিন মাস ধরে থাকা মুকুল কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করলেও স্মৃতিসৌধে এসে বলেন, “শহীদদের ভালোবাসি, তাদের কাছে আসছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ অনেকের কাছে এটি শুধু স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর দিন নয়, ক্ষোভ জানানোর দিনও।
“গণহত্যার ঘটনা অস্বীকার পাকিস্তানের বর্বর মিথ্যাচার। আজকের এই দিনে এসে আমরা বলছি, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় ও মিথ্যাচার করে তাদের সঙ্গে শিক্ষাসহ কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকতে পার না।”
বিজয় আনন্দে হাজারো বাঙালির সঙ্গে বেশ কয়েকদল বিদেশিকেও হাতে-মুখে লাল-সবুজের উল্কি এঁকে স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সাজে দেখা যায়।
তাদেরই একজন স্লোভাকিয়ার নাগরিক ইভিল ইভা, আট সদস্যের ইউরোপীয় একটি দলের সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন তিনি।
লাল-সবুজের টি-শার্ট পড়ে স্মৃতিসৌধে ইভা জানালেন, স্বাধীনতার জন্য এই দেশের মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস তাকে স্মৃতিসৌধমুখী করেছে।
“আমরা জেনেছি, এই দেশ স্বাধীন করতে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছে; আর এবার বিজয়ের ৪৪ বছর পূর্তি হয়েছে। সেইসব শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এখানে এসেছি,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।
এক বন্ধু ও বন্ধুর বড় ভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতিসৌধে এসে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া শিহাব শাকিল বলেন, “দেশ স্বাধীন করতে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের শ্রদ্ধা জানাতে এখানে আসছি।”
প্রতিবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসতে হলেও এবার তাদের দণ্ড কার্যকরে পরিতৃপ্তির আনন্দ নিয়ে এসেছেন বলে জানালেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেন, “এবার আর কোনো প্রত্যাশা নয়, আমরা পরিতৃপ্তির আনন্দ করছি। এখন দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে হবে।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরুর দাবি জানিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি মেনন বলেন, “প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তোলা হোক। যাতে সবাই একাত্তরে তাদের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে পারে।”
এদিকে সকাল থেকে স্মৃতিসৌধ এলাকার উন্মুক্ত মঞ্চে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা চলে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সমাজ ও জাতি গঠন (সজাগ)’-এর মতো অনেক সংগঠনকে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত গাইতে গাইতে স্মৃতিসৌধ অভিমুখে যেতে দেখা যায়।
প্রায় একশ জনের এই দলের সবার গায়ে জড়ানো ছিল একই ধরনের লাল-সবুজ পোশাক।
তাদের চলার এক পর্যায়ে, পাশের একটি মাইক থেকে ভেসে আসে ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান’।
এ সময় ওই মাইকে ভেসে আসা সুরে কণ্ঠ মেলান তারাও।