প্রয়োজন মনে করলে যে কোনো মামলায় অনুমতি ছাড়াই অধিকতর তদন্ত করার সুযোগ পুলিশের রয়েছে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির আবেদনের নিষ্পত্তি করে দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 14 Dec 2015, 10:41 AM
এর ফলে অভিযোগপত্র হয়ে যাওয়ার পরও সাত খুনের মামলায় অধিকতর তদন্ত বা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার আইনি সুযোগ নিয়ে অস্পষ্টতার অবসান হলো।
ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২০ এর বি ধারা অনুযায়ী এ মামলায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ যুক্ত করা হলে তা আমলে নিতেও বিচারিক আদালতের কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছে হাই কোর্ট।
উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা ‘যথাযথভাবে’ অনুসরণ করা হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন।
এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে বাদ রেখে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি জানিয়েছিলেন বিউটি। তার ওই আবেদন নিম্ন আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়ায় অধিকতর তদন্ত চেয়ে হাই কোর্টে আসেন তিনি।
ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালত ১৪ ডিসেম্বর আদেশের দিন রাখে। এর ধারাবাহিকতায় সোমবার আদেশ দেয় আদালত।
আদেশে আদালত বলেছে, কোনো মামলায় প্রতিবেদন দেওয়ার পর কারও বিরুদ্ধে অপরাধের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেলে তদন্ত কর্তৃপক্ষ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে অধিকতর তদন্ত করতে পারে, সে অধিকার তাদের আছে। সেখানে যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের তথ্যা-প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে। আরও তদন্ত বা অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তাদের অনুমতির প্রয়োজন নেই।
হাই কোর্ট বলেছে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে দণ্ডবিধির ১২০ বি (ষড়যন্ত্র) ধারা অন্তর্ভুক্ত করেননি। অভিযোগপত্রে তুলে ধরা বিষয়ের প্রেক্ষিতে বিচারিক মন প্রয়োগ করে দণ্ডবিধির ১২০ বি ধারার ষড়যন্ত্রের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের আদালতের কোনো বাধা নেই।
হাকিম ও জজ কোর্ট নারাজি আবেদন নাকচ করে আদেশ দিয়েছিল, তাতে ‘হস্তক্ষেপ করার মত সন্তোষজনক কারণ দেখা যাচ্ছে না’ বলেও হাই কোর্ট জানিয়েছে।
আদালতে আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার ও মন্টু ঘোষ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল শেখ এ কে এম মনিরুজ্জামান কবির ও সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. শহীদুল ইসলাম খান। এ সময় আবেদনকারী সেলিনা ইসলাম বিউটি উপস্থিত ছিলেন।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পাওয়া যায়।
তখন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা নারায়ণগঞ্জের আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। সেই সঙ্গে র্যাবের কর্মকর্তাদেরও হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলে নজরুলের পরিবার।
নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পরে র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে নুর হোসেন র্যাবকে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক আরেক কাউন্সিলর নজরুলকে খুন করান।
তদন্তে র্যাবের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ উঠে আসার পর দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও আলোচনায় ওঠে এই হত্যাকাণ্ড।
প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল নূর হোসেন ও র্যাব কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ, যাতে বাদ পড়েন এজাহারের পাঁচ আসামি।
এজাহারভুক্ত আসামিদের বাদ দেওয়ায় অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করে নারাজি আবেদন করেন বাদী বিউটি। নারায়ণগঞ্জের হাকিম ও জজ আদালত তা খারিজ করে দেওয়ার পর ২৩ নভেম্বর তিনি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন।
তালিকা থেকে বাদ পড়া এই পাঁচ আসামি হলেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেন।
২৯ নভেম্বর শুনানিতে মামলার অভিযোগপত্রে ক্রটি রয়েছে বলে আদালত মত দিলেও অধিকতর তদন্তের ফাঁকে বিচার যাতে বিলম্বিত না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেন বিচারক। আরেকদিন শুনানিতে আদালত বলে, এ মামলায় ষড়যন্ত্রের ধারা যুক্ত নেই।
সাত খুনের ঘটনার পর হাই কোর্টের নির্দেশেই র্যাবের তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, এম এম রানা ও আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশাসন তদন্ত কমিটিও করে আদালতের নির্দেশে।
সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত এই তিন কর্মকর্তা ছাড়া আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন নূর হোসেন, মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার, র্যাব সদস্য এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই বজলুর রহমান ও আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক ও নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন ও বাবুল হাসান, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়ব, নুরুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান নূর।
র্যা বের সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আব্দুল আলিম, মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন শরীফ, তাজুল ইসলাম ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান পলাতক।
এছাড়া নূর হোসেনের সহযোগী বন্দর উপজেলার কুড়িপাড়া এলাকার সেলিম ভারতের কারাগারে আটক রয়েছেন।