শনিবার শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মার তীরে এক সুধী সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এই সেতু নির্মাণের পথে বিশ্ব ব্যাংকের ‘মিথ্যা অভিযোগ’ এবং নানা বাধা-বিপত্তির কথা এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বড় কাজ করতে গেলে ‘হাত পাততে হবে’ এ মানসিকতা ভাঙতেই নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
“আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব।… আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।”
বক্তৃতার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না।
“আমরা সেই জাতি, যে জাতি সম্পর্কে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’, আজকেও সেটি প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।”
বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থনই শক্তি যুগিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
“অনেকে চেক দিয়েছিল। অনেকে অর্থ দিয়েছিল। এই যে সাহস এই যে সহযোগিতা, এটাই আমাকে সাহস দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে।”
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ করবে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন; ব্যয় হবে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
আর পুরো প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। এই সেতু দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলা।
সরকার আশা করছে, ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু আগামী তিন বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে। সেতুর উপর দিয়ে ট্রেনও চলবে।
তিনি বলেন, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে একদিকে দক্ষিণ অঞ্চলের অবহেলিত মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
“এই সেতু হলে কর্মসংস্থান হবে, নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠবে। এই এলাকাকে আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারব।”
পদ্মা সেতু দিয়ে বাংলাদেশ ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে বলেও জানান তিনি।
সরকার আশা করছে, এ সেতু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে।
জাজিরার অনুষ্ঠান শেষে নৌপথে মাওয়ায় যান প্রধানমন্ত্রী। পথে নদীর মধ্যে সাত নম্বর পিলারের পাইলিং-কাজের জায়গাটিও দেখেন তিনি।
মাওয়ায় পৌঁছে সেখানে মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সরকারপ্রধান। এর সঙ্গে সঙ্গে ৭ নম্বর পিলারের পাইলিং শুরু হয়। এরকম ৪২টি পিলারের উপরেই তৈরি হবে পদ্মা সেতু।
১৯৯৮ সালে আওয়ামী সরকার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে।
২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্ব ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে।
এরপর পদ্মা সেতুতে ‘সম্ভাব্য’ দুর্নীতির’ অভিযোগ আনে বিশ্ব ব্যাংক। দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে ২০১৩ সালের শুরুতে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়। তখন নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পর পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে যে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছিল তা জাজিরার সুধী সমাবেশে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “অনেকের ধারণা ছিল, কোনও কাজ করতে হলে কারও কাছে হাত পাততে হবে। এই মানসিকতা আমাদের পেয়ে বসেছিল। অন্যের সাহায্য ছাড়া কিছু করতে পারব না। অমুককে ধরেন- টাকা পাব… অমুককে অনুরোধ করেন- টাকা পাব।
“আমি বলেছিলাম, এটা বন্ধ করেন। আমরা কারও টাকা নেব না। নিজেদের টাকাতেই করব।”
প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বলেন, ‘হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই’ বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনে।
“আমি বলি, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। কারণ তখনও টাকা ছাড় হয়নি।আজ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারে নাই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।”
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির এই অভিযোগ নিয়ে কানাডায় মামলার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই মামলায় সে দেশের আদালতও বিশ্ব ব্যাংককে দুর্নীতির প্রমাণ দিতে বলেছে।
“ঘটনা ছিল অন্য। কোনো এক স্বনামধন্য ব্যক্তি, যিনি আইন ভঙ্গ করে ১১ বছর ধরে একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিল- ছেড়ে দিতে, তখন তিনি মামলা করলেন। মামলায় হেরে তাকে এমডি পদ ছেড়ে দিতে হয়।
“আমেরিকায় ই-মেইল গেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান তার শেষ কর্মদিবসে ওই অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি জাতির পিতার সন্তান। সব হারিয়ে আমি জনগণের কাজ করছি। আমি দুর্নীতি করি নাই। আমার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতি করে না।”
বক্তব্যের শুরুতেই সমবেত স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এখানে বক্তব্য দিতে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি।… যারা দূরে আছেন, তারাও দূরে নাই, আপনারা আমার আত্মার পরম আত্মীয়। যারা এই সেতু নির্মাণের জন্য জমি দিয়েছেন, ভিটা মাটি দিয়েছেন তাদের জন্য আমার কৃতজ্ঞতা।”
বিগত সরকারগুলোর সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিএনপি-জামায়াত যখনই ক্ষমতায় আসে এই সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয়। শুধু বন্ধই করে নাই, এই সেতু নিয়ে যায় পাটুরিয়া পয়েন্টে।”
তিনি বলেন, “সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অকার্যকর করে দেওয়ার যে এক ষড়যন্ত্র…আমরা সব দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম।”
অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান ও ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সেনা প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক এবং সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সুধী সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আশিক হোসেন]