কারা ফটকে অপেক্ষা

যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড কখন কার্যকর হবে সে প্রশ্নের উত্তর জানতে পেরিয়ে গেল একটি দিন।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2015, 07:52 PM
Updated : 21 Nov 2015, 03:40 AM

শুক্রবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানালেন, আগের দিন রিভিউ খারিজের রায় পড়ে শুনিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না। রাত পর্যন্ত এর কোনো জবাব তার কাছে পৌঁছায়নি।

বুধবার মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যত সব আইনি প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তি হয় দুই যুদ্ধাপরাধীর। তাদের সামনে এখন কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগই বাকি।

দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কখন কার্যকর হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল বৃহস্পতিবার রাত থেকেই। কারাগার ঘিরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের অর্ধশতাধিক সাংবাদিক কারা ফটকের সামনে সেই উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন।

কেউ কোনো খবর পেলেন কি না তা নিয়ে দিনভর চলে আলোচনা। কারাগার বা জেল পুলিশের কোনো কর্মকর্তাকে ফটকে দেখা গেলেই তাকে ঘিরে ধরে সাংবাদিকরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন।

কারা কর্তৃপক্ষের কেউ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। তবে কোনো কোনো সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, সকালে ফাঁসির মহড়া হয়ে গেছে। সব কিছু প্রস্তুত কি না তাও দেখা হয়েছে।

কারারক্ষীদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ বলেছিলেন তারা পরে সিদ্ধান্ত জানাবেন। সেই সিদ্ধান্ত জানতে শুক্রবার জুমার নামাজের আগে কারা কর্মকর্তারা আবারও কনডেম সেলে যান। কিন্তু উত্তর মেলেনি।

সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছিল, শুক্রবারই ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি অংশ আবার বলেন, শুক্রবারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নজির বাংলাদেশে নেই।

এক সাংবাদিক বলেন, স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি প্রিজন্স দণ্ড কার্যকরের জন্য বৈঠক করেছেন বলে তার কাছে খবর কাছে।

এ সময় পাশে আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ফাঁসি কার্যকর করতে জেলা প্রশাসক লাগবে, সিভিল সার্জনকে লাগবে। আরও কর্মকর্তা থাকবেন। তাদের কাউকে সন্ধ্যার পর কারাগারের সামনে দেখা যায়নি। তাছাড়া আগের দুই ফাঁসির আগে বাঁশ, ত্রিপল ও অন্যান্য আনার যে প্রস্তুতি দেখা গিয়েছিল, এবার তেমন কিছু চোখে পড়েনি।

ওই প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রাখা হয়েছে- এমন কথাও কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়।

তবে এসব বিষয়ের কোনো কিছুই কারা কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেননি। তারা শুধু বলেছেন, দণ্ড কার্যকরের সব প্রস্তুতি তাদের আছে।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে দিন গড়ালেও প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে সালাউদ্দিন ও মুজাহিদের জবাব মেলেনি মধ্যরাত পর্যন্ত।  

যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

কারা ফটকের কাছাকাছি সাধারণের পৌঁছানোর সুযোগ নেই। কারাগারের চারপাশে দুদিন ধরে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। কাউকে সন্দেহ হলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদও করছেন। তারপরেও জনতার উৎসাহের কমতি নেই।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের নিরাপত্তা কর্মী হাবিবকে সকাল সাড়ে ৯টায় কারা ফটকের কাছাকাছি দেখা যায়। সন্ধ্যার সময়ও ওই এলাকায় দেখা যায় তাকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ফাঁসি হবে। কখন কী হয় দেখতে এসেছি।”

জেলখানা এলাকার প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকানিরাও কৌতূহল নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জানতে চেয়েছেন- “আজ হবে, না কাল?”

এদিকে রাত ৯টার দিকে হঠাৎ করেই কারাগারের ফটকে আসেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুই ছেলে ফায়েজ কাদের চৌধুরী ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ কয়েকজন আত্মীয়।

কারাগারে ঢোকার সুযোগ না পেয়ে ফটকের বাইরে তারা সাংবাদিকদের বলেন, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে এই বিএনপি নেতার মত জানতে এসেছেন তারা।

ছোট ছেলে হুম্মাম সাংবাদিকদের বলেন, “গতকাল আমরা বাবার সাথে দেখা করেছিলাম। ওইটা ছিল ক্যাজুয়াল ভিজিট। বাবা মার্সি পিটিশন বা ক্ষমা চাইবেন কি চাইবেন না-সে বিষয়ে কিছু বলেননি।

“শুধু বলেছিলেন, আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।... যেহেতু বাবা একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, যার বিষয়ে আমরাও জানি না, তাই আমরা চলে এসেছি জানার জন্য- উনি কী চিন্তা করছেন।”

কারা ফটকের সামনে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী

এদিকে মুজাহিদের পরিবার শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলন হবে জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফাঁসির বিষয়ে বক্তব্য জানাতে পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হবে।”

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে।

একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের রায় এসেছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় এ বছর ২৯ জুলাই আপিলের রায়েও বহাল থাকে।

তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একই দিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং কারা কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর তা দুই ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনায়।

এরপর দুই যুদ্ধাপরাধী ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে বুধবার আদালত তা খারিজ করে দেয়।

রিভিউর রায় হওয়ার পর বুধবার থেকেই কারাফটকে জোরদার নিরাপত্তা রয়েছে। সাঁজোয়া যান নিয়ে পুলিশের অবস্থানের পাশাপাশি রয়েছে র‌্যাবের টহলও।

আগের দুই দিনের তুলনায় শুক্রবার কারাগার এলাকায় র‌্যাবের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়।

র‌্যাব ১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রায় কার্যকর  ঘিরে আমাদের যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমরা নিয়েছি। কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড যাতে না ঘটতে পারে সে উদ্যোগ আছে।”

জেলখানার মূল ফটকের সামনের রাস্তায় রয়েছে পুলিশের আর্মড পার্সনেল ক্যারিয়ার (এপিসি)। কিছুক্ষণ পরপর হুইসেল বাজিয়ে ওই সাঁজোয়া যানকে টহল দিতে দেখা যায় দিনভর।

চকবাজার থানার ওসি শামীম উর রশিদ তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের বিশৃংখলা যাতে ঘটতে না পারে সেজন্য টহল দেওয়া হচ্ছে।”