বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে যশোরের বেনাপোল স্থল বন্দরে তাকে হস্তান্তর করা হয় বলে বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন।
রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে ওপারের পেট্রাপোল বন্দর থেকে নীল রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে নূর হোসেনকে নিয়ে ফেরেন বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি অপূর্ব হাসান ও বেনাপোল ইমিগ্রেশন ওসি তরিকুল ইসলাম।
যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, বিজিবি কর্মকর্তা মেজর লিয়াকত আলী ও শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুস সালাম এসময় বেনাপোল ইমিগ্রেশনে উপস্থিত ছিলেন।
সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনকে নিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মামুনুর রশীদও ছিলেন সেখানে।
বিজিবির মহাপরিচালক আজিজ আহমেদ বলেন, “বিজিবির মেজর লিয়াকতের কাছে নূর হোসেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে।”
নূর হোসেনকে পশ্চিমবঙ্গের কারাগার থেকে বের করার খবর প্রকাশের পর গণমাধ্যমকর্মীরা বেনাপোলে ভিড় জমান।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিএসএফের কর্মকর্তা এস কে শুকলা ওসি অপূর্ব এবং ইউএনও সালামকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন।
এরপর রাত ১০টার দিকে বেনাপোল বন্দর থানার ওসি ও ইমিগ্রেশন ওসি নীল রঙের মাইক্রোবাসটিতে করে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের দিকে যান। ওপারেও তখন কয়েকটি গাড়ি দেখা যাচ্ছিল।
রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে গাড়িটি পেট্রাপোল থেকে বেনাপোল দিয়ে ফেরে। তবে কালো কাচের গাড়ির ভেতরে অবয়ব দেখা গেলেও স্পষ্ট করে নূর হোসেনকে বোঝা যায়নি।
গাড়িটি দ্রুত বেনাপোল হয়ে ঢুকেই সড়ক ধরে বেরিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কর্মকর্তারাও দ্রুত অন্য গাড়িগুলো নিয়ে বেরিয়ে যান।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, নূর হোসেনকে প্রথমে ঢাকায় আনা হবে। পরে নেওয়া হবে নারায়ণগঞ্জে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ’ পাওয়ার পর গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রেখেছেন তারা।
নূর হোসেনকে এনে এই জেলার আদালতে হাজির করা হবে বলেও জানান তিনি।
নারায়ণগঞ্জের আদালতেই কাউন্সিলর নজরুল ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনের হত্যা মামলার বিচার চলছে, যাতে আসামি রয়েছেন র্যাবের তিন কর্মকর্তাও।
২০১৪ সালে হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে গিয়ে ধরা পড়েন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনেরই আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। পশ্চিমবঙ্গের দমদম কারাগারে রাখা হয়েছিল তাকে।
বাংলাদেশে হত্যামামলার এই আসামিকে ফেরত পাঠাতে গত মাসে পশ্চিমবঙ্গের আদালতের অনুমতি মেলার পর তাকে ফেরানোর আলোচনা চলছিল।
এই আলোচনা আরও জোর পায় বুধবার আসামের বিদ্রোহী নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানোর পর।
উলফা নেতাকে ফেরত দেওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বুধবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নূর হোসেনকেও একই প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা হবে।
ফেরতের আলোচনার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের দমদম কারাগার থেকে বৃহস্পতিবার বিকালে বের করা হয় নূর হোসেনকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএসএফ সদস্যরা নূর হোসেনকে বেনাপোলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”
এদিকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বিকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা হন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ।
নূর হোসেনকে কি রাতেই ফেরত আনা হচ্ছে- বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “এখনও হ্যান্ডওভার হয়নি, দিবে।”
নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা হলেও তা তুলে নিতে সরকারের আবেদন গত ১৬ অক্টোবর উত্তর চব্বিশ পরগণার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম সন্দীপন চক্রবর্তী মঞ্জুর করেন।
ওই আদেশের পর পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কৌঁসুলিরা বলেছিলেন, আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মাধ্যমে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানো হবে। সেখান থেকে সবুজ সংকেত মিললে নূর হোসেনকে দেওয়া হবে বিএসএফের হাতে।
দুই দেশের যোগাযোগের মাধ্যমে হস্তান্তরের তারিখ ও সীমান্ত ঠিক হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে যাবেন। এরপর বিএসএফ নূর হোসেনকে বিজিবির হাতে তুলে দেবে এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে হস্তান্তর করা হবে।
নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সে সময় অভিযোগ করেন, র্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। পরে র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও তার সত্যতা পাওয়া যায়।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল নূর হোসেন এবং র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন নূর হোসেন। এক পর্যায়ে নিরুদ্দেশ হন সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই নেতা।
এরপর ২০১৪ সালের ১৪ জুন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালি এলাকার একটি বাড়ি থেকে দুই সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
পুলিশ সুপার মহিদ জানান, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের এক মামলায় তার এক বছরের সাজা হয়েছে।
বন্য প্রাণী আইনে মামলায় সাজার পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করে সরকার। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কৃত হন তিনি।
সাত খুনের মামলায় র্যািবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২২ জন কারাগারে রয়েছে। পলাতক রয়েছেন র্যারবের ৮ সদস্যসহ ১৩ আসামি।
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক কামাল তালুকদার, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি মজিবুল হক পলাশ এবং ভারত প্রতিনিধি]