প্রকাশক খুনেও পুলিশের সন্দেহ আনসারুল্লাহকে

অভিজিৎ রায়সহ ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যে জঙ্গি সংগঠনটির নাম উঠে এসেছে, প্রকাশক খুনও সেই আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের কাজ বলে পুলিশের সন্দেহ।

লিটন হায়দারও গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2015, 02:00 PM
Updated : 1 Nov 2015, 08:07 PM

শনিবার দুটি স্থানে একই কায়দায় হামলা চালানো ব্যক্তিদের একটি ঘটনার ধরন দেখে তাদের ‘অপেশাদার’ও মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

শনিবার বিকালে রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই সময়ে লালমাটিয়ায় আরেক প্রকাশক শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।

একদিন বাদে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে এসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ‍পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, “আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যরা আগের ব্লগার হত্যায় জড়িত বলে পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত। এই ঘটনাতেও আনসারুল্লাহ ঘরানার লোকেরাই জড়িত থাকতে পারে।”

গত ফেব্রুয়ারিতে অভিজিতের পর কয়েক মাসে কয়েকজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছিল। তাতে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমকেই দায়ী করে পুলিশ।  

সম্প্রতি ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস তার দায় স্বীকার করে বলে দাবি উঠলে তা নাকচ করে পুলিশ বলে, ওই সংগঠনটির তৎপরতা বাংলাদেশে নেই।

জাগৃতির কার্যালয়ে রক্তের দাগ

আগের ব্লগারদের মতো দুই প্রকাশকের উপর হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে টুইটারে বার্তা এসেছে আনসার আল ইসলামের কাছ থেকে, তারা আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্যও জানিয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, “আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে যারা পরিচিত, তারা এই জাতীয় ঘটনা ঘটিয়ে এভাবে দায় স্বীকার করে। কখনও সেভেন (আনসার আল ইসলাম সেভেন), কখনও ফোর বা কখনও থ্রি নামে তারা দায় স্বীকার করে।

“তাদের (আনসারুল্লাহ) সবাইকে ধরেছি- তা যেমন সত্য না, আবার কাউকেই ধরিনি তাও সত্য না। পুলিশ অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে।”

নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যামামলায় এখন বিচারের মুখোমুখি।

‘অপেশাদার’ খুনি

লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে টুটুলসহ অন্যদের উপর হামলাকারীরা অপেশাদার বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল।

“ঘটনাস্থল ওরা দুটো গুলি ফেলে গেছে। ওরা পেশাদার খুনি হিসেবে আগে কোনো কাজে জড়িত ছিল বলে মনে হচ্ছে না।”

শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে যখন হামলা হয়, তখন টুটুল ছাড়াও চারজন ছিলেন সেখানে। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, হামলাকারীরা ছিল তিনজন। তাদের সঙ্গে চাপাতির সঙ্গে পিস্তলও ছিল।

টুটুলদের আক্রমণের পর ঘরের এবং ভবনের কলাপসিবল গেইটে তালা দিয়ে মোটর সাইকেলে করে হামলাকারীরা চলে যায় বলে  প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

হামলায় উলট-পালট শুদ্ধস্বর কার্যালয়

শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতির কার্যালয়ে কখন দীপন আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই সময়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি একাই ছিলেন সেখানে, বিকালে কার্যালয়ে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

মনিরুল বলেন, “দুর্বৃত্তরা দীপনকে কুপিয়ে দোকানের শাটার লাগিয়ে দিয়েছিল। দোকানে তখন আর কেউ ছিল না। অনেক পরে বিষয়টি জানা যায়।”

“দুটো ঘটনার ধরন প্রায় একই। দুটো ঘটনার পেছনে নেপথ্যের ব্যক্তিরাও এক এবং একই লোক ট্রেনিং দিয়েছে বলে ধারণা করছি,” বলেন তিনি।

আজিজ সুপার মার্কেটের সিসি ক্যামেরার ছবিতে আশা জাগানো তথ্য মিলছে বলে দাবি করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজিজ মার্কেটের সিসি ক্যামেরা দেখে আমরা মোটামুটি একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি। মনে হয় কিছু পেতে যাচ্ছি।”

আজিজ কো অপরেটিভ সুপার মার্কেট মার্কেট ঘিরে রয়েছে আটটি সিসি ক্যামেরা। সবগুলো ক্যামেরার ফুটেজ শনিবার রাতেই গোয়েন্দা পুলিশ নিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন মার্কেটের দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি নাজমুল আহসান নাজু।

লালমাটিয়ার যে বাড়িতে হামলা হয়েছিল, সেখানে কোনো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ছিল না। তবে আহতরা ছাড়াও দুজন হামলাকারীদের দেখেছেন, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

আজিজ সুপার মার্কেটে দীপনের উপর হামলাকারীদের শনাক্ত করা হলে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরে হামলাকারীদের তথ্যও বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছেন ওই র‌্যাব কর্মকর্তা।

দুটি ঘটনার কোনোটিতেই মামলা হয়নি বলে রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম।

দুই প্রকাশকের উপর হামলার পর আরেক প্রকাশক হুমকি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

প্রকাশকদের মধ্যে আর কেউ হুমকি পেয়ে থাকলে পুলিশকে জানাতে অনুরোধ জানান মনিরুল।

পুলিশ ‘সিনসিয়ার’

একের পর এক ব্লগার খুন হওয়ার পর খুনিদের ধরতে না পারার মধ্যে প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের পরও পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল দাবি করেন, অপরাধীদের গ্রেপ্তারে তার বাহিনীর চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই।

“পুলিশের কমিটমেন্ট আছে, সিনসিয়ারিটিও আছে। অনেক ঘটনাই ঘটতে যাচ্ছিল, সেগুলো প্রতিরোধ করেছি।”

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাস খানেকের মধ্যে ঢাকার তেজগাঁওয়ে সড়কে খুন হন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, তারপর সিলেটের সড়কে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, তারপর ঢাকায় ঘরের মধ্যে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে।

সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ধরনই ছিল এক। এর মধ্যে ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের পর দুজনকে স্থানীয়রা ধরে পুলিশে দিলেও অন্য কোনটির খুনিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে তদন্তে পুলিশ

মনিরুল মনে করেন, ব্লগার-প্রকাশক হত্যার মতো ঘটনাগুলো ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে ‘নিবেদিত শাখা’ ছাড়া এগুলো প্রতিরোধ কঠিন।

“আপনারা দেখছেন, আমরা ‘ভিজিবল পুলিশিং’ জোরদার করেছি। ভিজিবল পুলিশ দিয়ে স্পেশাল ক্রাইম প্রতিরোধ সহজ হয় না। পুলিশ ভিজিবল থাকলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের চলাফেরা ‘রেস্ট্রিকটেড’ হয়।”

“বিশেষ অপরাধ মোকাবেলায় বিশেষ শাখা গঠন করা দরকার। ব্লগার হত্যার ঘটনাগুলো সাধারণ অপরাধ নয়, এগুলো প্রতিরোধ সহজে হয় না।”

এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ‘কাউন্টার টোরোরিজম ইউনিট’ গঠনের পক্ষে মত জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে এই ধরনের ইউনিট থাকলেও বাংলাদেশে না থাকায় সব ধরনের ঘটনার তদন্ত ডিবিকেই (গোয়েন্দা পুলিশ) করতে হচ্ছে।