মুক্তমনাদের হত্যা: ‘দায়ী সরকারের উদাসীনতা’

মুক্তমনা লেখক-প্রকাশকদের উপর হামলা চালিয়ে একের পর এক হত্যার ঘটনায় সরকারের ‘উদাসীনতা’ ও ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’কে দায়ী করেছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারা।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2015, 04:25 PM
Updated : 31 Oct 2015, 05:28 PM

আর মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, রাজনীতিতে ‘ফায়দা হাসিলের’ সংস্কৃতি চালু থাকায় এসব হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

১১ বছর আগে অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের উপর দিয়ে এ ধরনের হামলার সূত্রপাত হয়।

সর্বশেষ শনিবার দুপুরে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধশ্বরের কার্যালয়ে এর স্বত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ আরও দুজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে।

এরা দুজনই বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেন; যিনি নিজেও একই ধরনের হামলায় নিহত হন।

পর পর দুটি ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, “এ ঘটনাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা স্পষ্ট। আমি মনে করি, সরকারের ভেতরে পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।”

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে টেনে আনতেই এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে মত দেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত ব্লগার আরিফুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মুক্তচিন্তা করেন এমন লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারদের দমন করতে না পারলে বাংলাদেশে ইসলামের চাষবাস সম্ভব হবে না- এটা জেনেই ইসলামি জঙ্গিবাদীরা মুক্তমনাদের উপর নিয়মিত হামলা করে যাচ্ছে। সরকারও এতে খুশি। কারণ ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ স্বৈরশাসনের জন্য একটা উপযুক্ত আবহ তৈরি করে দেয়।

“সম্ভবত সরকারের ভেতরে ইসলামি জঙ্গি অধ্যুষিত যে শক্তিটা বিদ্যমান, তারাই কলকাঠি নেড়ে আগের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারে বাধা সৃষ্টি করছে।  মোটকথা সরকারি অবহেলা ও গুরুত্ব অনুধাবনের ব্যর্থতাই পর্যায়ক্রমিক আক্রমণের মূল কারণ।”

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা বিলোপের পাশাপাশি যেসব ইসলামি বা জঙ্গি নেতা, নিউজ পোর্টাল কিংবা ইসলামি দল ব্লগার ও মুক্তমনাদের উপর হামলার আহ্বান জানায়, তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

“গত দুবছরে চিন্তাক্ষেত্রের উপর যত আক্রমণ হয়েছে, সকল ঘটনার তদন্তে বিশেষ আন্তঃবাহিনী তদন্তদল তৈরি করে বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে।”

বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের উপর হামলার শুরু হয় ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা চলাকালীন সময়ে ধর্মান্ধদের হামলায় গুরুতর আহত হন লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।

ঘটনার পর ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি।

পরের হামলা হয় মুক্তমনা ব্লগার রাজীব হায়দারের উপর, যিনি ‘থাবা বাবা’ নামে ব্লগ লিখতেন। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর ১০ দিনের মধ্যে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীতে বাসার সামনে রাজীবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এলেও মামলার কার্যক্রম অনেকটাই থেমে আছে।

২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আরিফ রায়হান দীপকে। এ ঘটনারও বিচার শুরু হয়নি।

এবছর ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়; আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এ ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।

এরপর ৩০ মার্চ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে দিনেদুপুরে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে, ১২ মে সিলেটে সুবিদবাজারে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে এবং ৭ অগাস্ট ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে বাসায় ঢুকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়।

অনন্ত বিজয় দাশ এবং নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় দুজনই গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দেশের বাইরে থাকা আরেক ব্লগার সুব্রত শুভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাষ্ট্র ও প্রশাসন যে ব্যর্থ- স্পষ্টভাবে আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ২০০৭ সালে দেশে জঙ্গি সংগঠন ছিল ২৯টি, এখন দেশে জঙ্গি ১৩০টির উপর। তাহলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ব্লগারদের হত্যার প্রতিরোধে সরকার একদিকে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে জঙ্গিবাদের বিস্তারও ঠেকাতে পারছে না।

“বিচারহীনতার সংস্কৃতি অবশ্যই একটি বড় কারণ। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে উল্টো নিহত ব্লগারদের দোষী হিসেবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করছে। ফলে ব্লগার হত্যার একটা সামাজিক ভিত্তি স্থাপনে পুলিশ, র‌্যাবও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে।”

তিনি বলেন, “প্রতিটি আসামিকে গ্রেপ্তার করে বিচারের ব্যবস্থা করা হলে এবং সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন হলেই কেবল এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে আমি মনে করি।”

আরেক ব্লগার নির্ঝর মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপগুলি শুধু ব্যর্থই হচ্ছে না, সেগুলি প্রচণ্ড রকমের ‘সন্দেহজনক এবং ঘোলাটেও’। তাদের প্রচুর পদক্ষেপে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীরা উৎসাহিত হয়েছে, প্রশ্রয় পেয়েছে।

“মোটকথা, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার ঘটনাবলী এতই প্রবল এবং ভয়ঙ্কর যে সেটা জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ না করে বরং উৎসাহিত করছে, শক্তিশালী করছে।”

নির্ঝর বলেন, “শুধুবিচারহীনতা নয়। পুলিশের আইজিপি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি ব্লগারদের হত্যার পরে ‘সীমা লঙ্ঘন না করতে’ ব্লগারদের পরামর্শ দিয়েছিলেন- যেটি প্রকারান্তরে ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’। এই কারণে জঙ্গি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের হিংস্র আচরণ এবং খুনের মতো ঘটনাবলীও এক ধরনের নৈতিক বৈধতা পেয়েছে।”

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এদেশে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সারা বিশ্বে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের উত্থান দেখা যাচ্ছে, যার প্রভাব এখানেও পড়ছে।

“এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কিছু দুর্বলতা তো রয়েছেই। কারণ, এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে তারা সুকৌশলে ছোট ছোট দলে কাজটি করছে। একজন দুজন ধরা পড়লেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। সম্প্রতি এ ধরনের হামলাগুলো ঘটেছে, যা ঠেকাতে তাদের কোনো পূর্ব প্রস্তুতিও ছিল না।”

তিনি বলেন, “যখন ২১ অগাস্ট বোমা হামলা হল, তখন আওয়ামী লীগ বলেছিল এদেশে জঙ্গি আছে। এখন তারা সরকারে এসে বলছে, নেই। এ ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা লাভের বিষয়গুলোর কারণে প্রকৃত ঘটনা আড়ালে চলে যায়। সাম্প্রতিক এ হত্যাকাণ্ডগুলোর বিষয়েও ঠিক তাই ঘটেছে।”

সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদকে এখনই রুখে দেওয়া না গেলে বাংলাদেশের সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।