রাজধানীর লালমাটিয়ার সি ব্লকে নিজের কার্যালয়ে শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে হামলার পর টুটুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
টুটুলের সঙ্গে থাকা ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকেও কোপানো হয়। রহিমের কোমরে গুলির জখম রয়েছে। তারা দুজনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
অস্ত্রোপচারের পর ঢাকা মেডিকেলের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের সার্জন কে এম রিয়াজ বিকাল ৫টার দিকে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “টুটুল ও তারেকের অবস্থা ক্রিটিকাল। রণদীপম আশঙ্কামুক্ত।”
সন্ধ্যার পর ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াকে চিকিৎসকরা জানান, তিনজনই এখন আশঙ্কামুক্ত।
লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনকে। তিনিও অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার বাইরে প্রবাসী লেখক অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যার সঙ্গে জঙ্গিরা সংশ্লিষ্ট বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’সহ কয়েকটি বই বের করেছে শুদ্ধস্বর। তাদের কার্যালয়ে হামলায় কারা জড়িত, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
গত ফেব্রুয়ারিতে অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর ফেইসবুকে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে টুটুল মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।
শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢোকার পথ
হামলার পর তদন্তে পুলিশ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে প্রকাশক টুটুলসহ কয়েকজন ছিলেন ওই কার্যালয়ে। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে হানা দেয় কয়েকজন দুর্বৃত্ত।
বিকাল সোয়া ৩টার দিকে লেখক রণদীপম বসু ফেইসবুকে লেখেন, “কুবাইছে (কুপিয়েছে), আমি টুটুল ভাই আর তারেক।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে অফিস কক্ষে তালা লাগিয়ে চলে যায়। পুলিশ এসে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে।
ভেতরে আটকা পড়া ওই তরুণ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা (হামলাকারী) ছিল তিনজন। তারা ঢুকেই বলেছিল, ‘আমরা টুটুলকে মারতে এসেছি’।”
তিনি বলেন, তাকেসহ অন্যদের অস্ত্রের মুখে পাশের কক্ষে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
“নক করা হলে দরজা খুলে দেওয়া হয়। একজন ঢুকে বলে যে সে বই নিতে এসেছে। তাকে ঢুকতে দিলে বলে, ‘আমার এক ভাই আছে’। এরপর সে বাইরে গিয়ে তিনজন একসঙ্গে ঢোকে। এদের একজন স্বাস্থ্যবান। একজনের হালকা দাড়ি ছিল। যার হাতে পিস্তল ছিল, তার ১৬-১৭ বছর বয়স।”
“প্রথমে যে ঢুকেছিল তার কাছে কালো ব্যাগ ছিল। সেখান থেকে চাপাতি বের করে। আমাদের অন্য ঘরে জিম্মি করে রাখে। পরে কুপিয়ে তালা লাগিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় গুলির শব্দ শুনি।”
আহমেদুর রশীদ টুটুল
রণদীপম বসুর ফেইসবুক স্ট্যাটাস
শুদ্ধস্বরের কার্যালয় ভবনের সামনের একটি দরজি দোকানের কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিৎকার শুনে আমরা ওইদিকে খেয়াল করে দেখি একটি মোটর সাইকেলে করে তিনজন দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে।”
শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এক শিক্ষক বলেন, “আমি বাথরুমে ছিলাম। চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে পুলিশ তিনজনকে উদ্ধার করেছে।”
টুটুলের বন্ধু সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, “টুটুলের ফোন থেকে আড়াইটার দিকে ফোন আসে। আমি রিসিভ করি। তার কর্মচারী রাসেল আমাকে বলে, ‘আমাদের রক্ষা করেন। আমাদেরকে কুপিয়ে তালা মেরে চলে গেছে’। তখন আমি পুলিশকে জানাই।”
ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। ওই কোচিংয়ের এক ছাত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিচের কলাপসিবল গেইটটিতেও তালা মেরে দিয়েছিল হামলাকারীরা। পুলিশ এসে ওই তালাও খোলে।
পুলিশ গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় টুটুল, তারেক ও রণদীপমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় বলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে রক্তের দাগ
শুদ্ধস্বর কার্যালয়ের সিঁড়িতে রক্তের দাগ
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক লিটন হায়দার ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, চতুর্থ তলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে চাপ চাপ রক্ত। সিঁড়িতেও রক্তের দাগ। পুরো কার্যালয় ওলট-পালট। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে।
ঘটনস্থলে গুলির খোসা দেখেছেন বলে জানান টুটুলের বন্ধু সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি।
এদিকে টুটুলসহ তিনজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে ভিড় জমে। ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে গণজাগরণ মঞ্চ বিক্ষোভ মিছিলও করেছে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে তিনজনের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমরা ঘটনাস্থলে তদন্ত করে দেখছি।”
ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি ও খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ফেব্রুয়ারিতে টুটুলের জিডির পর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল- জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব বলেন, “জিডি করেছিল কি না, মনে নেই। তারা যখনই পুলিশের সাহায্য চেয়েছে, তা দেওয়া হয়েছে।”