সাকা, মুজাহিদের চূড়ান্ত রায় প্রকাশ, এখন রিভিউ

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহালের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এখন তা পুনর্বিবেচনায় (রিভিউ) আবেদনের সুযোগ রয়েছে এই দুই যুদ্ধাপরাধীর; এজন্য তাদের হাতে সময় ১৫ দিন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2015, 04:04 PM
Updated : 30 Sept 2015, 06:33 PM

রিভিউ আবেদনের সময়ের মধ্যে দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া সরকার শুরু করতে পারবে জানিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আসামি আবেদন করলে অবশ্য এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাবে।

রিভিউ আবেদন করবেন জানিয়ে মুজাহিদের আইনজীবী শিশির মনির বলেছেন, তা নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকরের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) থেকে রিভিউ আবেদনের সময় গণনা শুরু হবে বলে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের বিরোধিতা করে এই আইনজীবী বলছেন, ১৫ দিন সময় গণনা শুরু হবে তারা অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর থেকে।

পুরো অক্টোবর মাস সুপ্রিম কোর্টে ছুটি রয়েছে। আদালত চাইলে রিভিউ আবেদনের শুনানি অবকাশের মধ্যেও নিতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন মাহবুবে আলম। তা না হলে শুনানি যাবে নভেম্বর।

রিভিউতে যদি দণ্ডের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন সাবেক এই দুই মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদ। তা নাকচ হয়ে গেলে সরকার প্রাণদণ্ড কার্যকরের পদক্ষেপ নেবে।

এর আগে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে রিভিউতে রায়ের কোনো পরিবর্তন আসেনি। তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ নেননি বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

পৃথক দুটি দিনে সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের রায় ঘোষণা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে একই দিনে। সালাউদ্দিন কাদেরের রায় হয়েছিল গত ২৯ জুলাই, তার আগে ১৬ জুন হয়েছিল মুজাহিদের রায়।

বুধবার আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, দণ্ড কার্যকরের বিষয়ে অগ্রসর হওয়ায় কোনো নিষেধ নাই।

“তারা রিভিউ ফাইল করবেন কবে? সেজন্য রাষ্ট্রপক্ষ বসে থাকবে, এটা কিন্তু আইনে বলা নেই। ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে রিভিউ ফাইল করার জন্য। বলা হয়নি রাষ্ট্রপক্ষকে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে।”

“কিন্তু এর ভেতর যদি আসামিপক্ষ বা দণ্ডিত ব্যক্তি রিভিউ পিটিশান ফাইল করেন, তাহলে স্বংয়ক্রিয়ভাবে এই দণ্ডের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যাবে। এই রিভিউ আবেদনটি ফাইল করতে হবে ১৫ দিনের ভেতর।”

মুজাহিদের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “১৫ দিনের মধ্যে আমরা রিভিউ আবেদন দায়ের করব। এই আবেদন কার্যতালিকায় আসবে ও পরিপূর্ণ শুনানি হবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তির একটি রায় হবে। এই রায়ের ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করবে দণ্ড কার্যকর হবে কি, হবে না।

“এছাড়া কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগে নেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। যদি নিয়ে থাকেন, তাহলে তা হবে আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত।”

সময় গণনার বিষয়ে শিশির মনির বলেন, “কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজের রায় অনুযায়ী ১৫ দিন সময় গণনা শুরু হবে রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার দিন থেকে অথবা রায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পড়ে শোনানো, এই দুটির যেটি আগে হয়।

“অর্থাৎ কোনোভাবে ১৫ দিন সময় গণনা আজ (বুধবার) থেকে শুরু হচ্ছে না। কারণ আমরা রায়ের অনুলিপি পাইনি ও রায় কারাগারে এখনও পৌঁছেনি।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউয়ের বিষয়টি বলা ছিল না বলে কাদের মোল্লার রায়ের পর যুদ্ধাপরাধীদের এই সুযোগ পাওয়া নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।

এরপর সর্বোচ্চ আদালত এই সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, আসামি ও রাষ্ট্র- দুপক্ষই ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবে।

তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে।

রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর দিন গণনা শুরু হবে বলে আসামি পক্ষের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “রায় যেদিন সই হয়ে যাবে সেদিন থেকে গণনা হবে। বুধবার থেকেই দিন গণনা শুরু হবে।

“কারণ তার (আসামির) আইনজীবীরা জেনেছেন। রায়ের কপিও আদালত থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রায়ের কপি অ্যার্টনি জেনারেল অফিসে আসবে, ট্রাইব্যুনালে যাবে, কারাগারে যাবে।”

পূর্ণাঙ্গ রায় দুটির অনুলিপি বুধবারই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে গেছে।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) রায় ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হবে। রায়ের প্রত্যায়িত কপি আগামীকাল কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হবে।”

সুপ্রিম কোর্টে অবকাশ শুরু হতে যাওয়ায় রিভিউ আবেদন হলে এর মধ্যে তার শুনানি হবে কি না- জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, “এটি নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।

“আদালত যদি মনে করেন, বন্ধের ভেতর শুনবেন, শুনতে পারেন। অনেক মামলাই এরকম বন্ধের ভেতর শুনানি হয়েছে। আদালত যদি মনে করেন, বন্ধের পরে নভেম্বর মাসের ১ তারিখের পরে তারা শুনবেন, তাও হতে পারে।”

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে এর আগে গত ১১ এপ্রিল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল পরদিন মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল।

তার আইনজীবীরা ৫ মার্চ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ৬ এপ্রিল আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়। রায়ে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর ৮ এপ্রিল তা আসামি কামারুজ্জামানকে পড়ে শোনানো হয়।

কিন্তু আসামি প্রাণভিক্ষার জন্য কত সময় পাবেন এবং কতদিনের মধ্যে তার নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া না থাকায় কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।

কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিল, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে আসামি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন।

তবে প্রাণভিক্ষার জন্য কারাবিধিতে বেঁধে দেওয়া ৭ থেকে ২১ দিনের সময়সীমা যুদ্ধাপরাধের মামলার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য হবে না। এই আইনে আছে, দণ্ড কার্যকরের হবে সরকারের নির্দেশে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।

ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় দেয় আপিল বিভাগ, এরপর ৫ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়।

অনুলিপি পাওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে তা পাঠায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তখন রিভিউ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটেনি।  

১০ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি কারা কর্তৃপক্ষ জানালেও আসামিপক্ষের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ এক আকস্মিক আদেশে তা স্থগিত করে দেন।

ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন।এর একটিতে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাস চাওয়া হয়।

এরপর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের আবেদনের শুনানি করে তা নাকচ করে দেয় প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এরপর ১২ ডিসেম্বর রাতেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়ার পর কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।