হারাবে না শকুন, রক্ষার তোড়জোড়

খাবারের সংকটে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যখন শকুন হারাতে বসেছে তখন রেমা-কালেঙ্গাঁর গভীর জঙ্গলে চলছে তাদের রক্ষার তোড়জোড়। গড়ে তোলা হয়েছে শকুনের অভয়াশ্রম ও প্রজনন কেন্দ্র।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2015, 01:37 PM
Updated : 26 Sept 2015, 01:55 PM

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে সীমান্তঘেঁষা রেমা-কালেঙ্গাঁ বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল হিসেবেই পরিচিত। আর এই বনের রেমা রেঞ্জের দুর্গম ময়নার বিলের বড় আকারের গাছে বাসা বেঁধে বাস করছে প্রায় ৭৫টি শকুন।

তবে স্থানীয় মানুষ ও বন বিভাগের সহযোগিতায় নিরাপদ খাদ্য ও বাসস্থান সংস্থান হওয়ায় দিন দিন এখানে শকুনের সংখ্যা বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা বর্জ্যভুক প্রাণীর মধ্যে শকুন শুধু প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখে না, জীবাণুমুক্তও রাখে। শকুন বিভিন্ন রোগের জীবাণু যেমন অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণ থেকে মানুষসহ বিভিন্ন পশু-পাখিকে রক্ষা করে।

রেমা-কালেঙ্গাঁ বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এম আকবর হোসেইন জিতু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চার-পাঁচ বছর আগেও এখানে খুব একটা শকুন দেখা যেত না। কিন্তু এখন ৩৮টি পরিবার বা ৭৬টি শকুনের বাস রয়েছে এখানে।”

তিনি দাবি করেন, ময়নার দ্বীপে শকুনের এমন দুটি পরিবার রয়েছে, যে প্রজাতি ৩৫ বছর আগেই আন্তর্জাতিকভাবে বিলীন ঘোষণা করা হয়েছে।

‘ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন’ খাওয়ানো মৃত পশুর মাংস খেয়ে শকুন বিলীন হয়ে যাচ্ছে বলে পরিবেশবিদদের দাবি।

বন অধিদপ্তরের বন সংরক্ষক (বণ্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) তপন কুমার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, বিভাগের হিসাবে স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে ৫০ হাজার শকুন থাকলেও গত ৪৪ বছরে তা কমে ৫০০ নিচে চলে এসেছে।  

তাই ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ হিসেবে পরিচিত শকুনের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে চলছে আলোচনা। 

২০০৯ সালে নেপাল সর্বপ্রথম শকুনের নিরাপদ এলাকা গঠন করে। বর্তমানে নেপালে শকুনের দুটি নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে স্থানীয় জনগণের প্রতিষ্ঠিত সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শকুনের সংখ্যা পুনরুদ্ধার হচ্ছে।

আর বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর বৃহত্তর সিলেট ও খুলনায় শকুনের দুটি নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করেছে, যার একটির আওতায় রয়েছে রেমা-কালেঙ্গাঁ বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র।     

কিন্তু এ বিপণ্নতার মধ্যেও রেমা-কালেঙ্গাঁতে শকুনের সংখ্যা কেন বাড়ছে- এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আকবর হোসেইন জিতু বলেন, “রেমার ময়নার দ্বীপ এলাকায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রায় ২০০ গাছকে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে শকুনের আবাস্থল হিসেবে। এসব গাছ ও এর আশেপাশের এলাকায় মানুষের প্রবেশ নিষেধ।”

এছাড়া পাহাড়ের মাথায় মাচা বানিয়ে সেখানে মরা পশু রাখার ব্যবস্থাও করা হয়ে, যাতে শকুনের খাবার নিশ্চিত হয়।

তিনি জানান, এসব পশু সেখানে ফেলার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নেওয়া হয়, যাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান না থাকে।

প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর আয়তনের রেমা-কালেঙ্গাঁতে সরকার ঘোষিত বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের আয়তন ১৭৯৫ হেক্টর। এ বনে রয়েছে উঁচু উঁচু বড় গাছের ঘন বন, যা দেশের অন্য বন্যগুলো থেকে একে আলাদা করেছে।

এসব গাছের মধ্যে রয়েছে আওয়াল, কাকরা, নেউর, হারগাজা, গণ্ধরাই, হরিতকি, বহেরা, জাম, গামার, বনাক, চিকরাশি, চাপালিশ, গর্জনসহ ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা।

পশুপাখির মধ্যে রয়েছে সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি এবং ৩৭ প্রজারি স্তন্যপায়ী প্রাণী।

কথা বলে জানা গেছে, রেমা-কালেঙ্গাঁতে বন রক্ষায় স্থানীয়দের নিয়ে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরি করা হয়েছে; যারা বন পাহাড়ার বিনিময়ে বনের ফসলি জমি ভোগ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।  

এরমকই একজন কালেঙ্গা রেঞ্জের ভূমি জায়গীরদার মো. নুরুল্লাহ বলেন, স্থানীয়দের ব্যবস্থানার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করায় বনদস্যুদের মোকাবিলা অনেক সহজ হয়ে গেছে। কাঠ পাচারসহ অন্যান্য দুষ্কর্মও কমে গেছে।

১৯৫০ সালেও রেমা-কালেঙ্গাঁতে বড় বড় বাঘ দেখা যেত বলে স্থানীয় মানুষ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান। তবে বনে দস্যু তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় একসময় তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এখন বনের বিভিন্নস্থানে মেছো বাঘের বংশ বিস্তানের ননুমা পাওয়া যাচ্ছে। 

আকবর হোসেইন জিতু বলেন, “সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সরকারের তৎপরতায় বন দস্যুদের আধিপত্য কমে গেছে। এরফলে বনের গাছপালা বৃদ্ধি পাচ্ছে ও বণ্যপ্রাণীর সংখ্যাও বাড়ছে।”