জাফরুল্লাহ ‘রং হেডেড’, কড়া হুঁশিয়ারি আদালতের

বিচারকদের নিয়ে কটূ মন্তব্য করায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘রং হেডেড’ বলেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2015, 05:55 AM
Updated : 1 Sept 2015, 05:55 AM

আদালত অবমাননার অভিযোগে কোনো শাস্তি দেওয়া না হলেও কড়াভাবে তাকে সতর্ক করেছে আদালত।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে। জাফরুল্লাহ এ সময় আদালতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আদালত থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের সামনেও তিনি কোনো কথা বলেননি।

এর আগেও অবমাননার অভিযোগে দুই দফায় আদালত আসা জাফরুল্লাহর মন্তব্যকে আদালত দেখছে একজন ‘অবিবেচক ব্যক্তির বক্তব্য’ হিসেবে।

তার নিঃশর্ত ক্ষমার আবেদন মঞ্জুর করে রায়ে আদালত বলেছে, ‘অবমাননকারী’ জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেকে ‘এক্সট্রিমলি রং হেডেড’ ব্যক্তি হিসাবে প্রমাণ করেছেন।

“আমরা মনে করি, তাকে যদি থামানো না হয়, তাহলে তিনি বেআইনি ও উগ্র কার্যক্রম চালিয়ে বিচার ব্যবস্থা ও দেশের আইনের শাসনের অনিষ্ট করতে থাকবেন।”

এই রায়ের একটি অংশ লিখেছেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া আলাদা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তবে জাফরুল্লাহকে ক্ষমার বিষয়ে অপর দুই বিচারকের সঙ্গে তিনি একমত পোষণ করেছেন।

রায়ে তিন বিচারকের সিদ্ধান্তে বলা হয়, বাক স্বাধীনতার অধিকারের নামে এই ধরনের ‘দায়িত্বহীন ও বিদ্রুপাত্মক’ কাজের পুনরাবৃত্তি না করতে কঠোরভাবে সতর্ক করে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ক্ষমা করা হল।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “স্বাধীনতা যুদ্ধে তার (জাফরুল্লাহ) অবদানকে জাতি অবশ্যই স্বীকার করে, তবে কেবল এই কারণে ধরে নেওয়া যাবে না যে, তিনি যে কোনো অপরাধ করতে পারেন বা তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। বরং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অবমাননার অভিযোগ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত।

“আমরা বারবার বলছি, আমরা সবসময়ই আমাদের সংবিধান স্বীকৃত বাক স্বাধীনতাকে মান্য করি। সেটা যথাযথভাবে রক্ষা করতে হবে। তবে এর অপব্যবহার করা যাবে না অথবা এর মাধ্যমে আদালতের দক্ষতা ও কর্তৃত্ব অথবা আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা বা সম্মান ধ্বংস বা ক্ষতির অনুমোদন দেওয়া যায় না।

রায়ে বলা হয়, “এটা ভাবা ভুল যে, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে জনসম্মুখে জাফরুল্লাহ বিচারক ও বিচার বিভাগকে কলঙ্কিক করার লাইসেন্স পেয়ে গেছেন।

“কোনো ভালো কাজ পূর্বে বা পরে সংগঠিত কোনো ভুল বা অপরাধের দায় থেকে ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে পারে না। আদালত এবং বিচারকদের হীন করে জাফরুল্লাহ বরং সচেতনভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার গৌরবের অপব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।”

এ মামলার শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানের সাজায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ৫০ নাগরিকের এক ‘অবমাননাকর’ বিবৃতিকে ঘিরে।

জাফরুল্লাহ ছাড়া বাকি বিবৃতিদাতারা ক্ষমা চেয়ে ওই মামলা থেকে রেহাই পান। আর অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে গত ১০ জুন জাফরুল্লাহকে সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল।

শাস্তি হিসাবে তাকে এক ঘণ্টা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তবে জাফরুল্লাহ নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাকে সতর্ক করে দিয়ে ওই দণ্ড মওকুফ করে দেয়।

ট্রাইব্যুনালের সেই রায়ের দিন আদালত সাজা ঘোষণার পর জাফরুল্লাহ চৌধুরী রায়ের অনুলিপি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কাঠগড়ায় যাবেন না বলে দীর্ঘসময় অনড় থাকেন। পরে রায়ের কপি হাতে দেওয়া হলে স্বেচ্ছায় কাঠগড়ায় গিয়ে সাজাভোগ করেন এবং পরে আদালতের বাইরে এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

সে সময় তিনি বলেন, “আজকের আদালত অবমাননার রায়টা তিনজন বিচারকের মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ। তিনজন বিচারপতির মানসিক অসুস্থতার প্রমাণ। যেখানে বিচারপতিরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, সেখানে ন্যায়বিচার হয় না।

“যখন তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তখন যুক্তি থাকে না বলেই তারা আইনের আড়ালে আত্মগোপন করেন। এখানে এই মামলাটার বোঝার বিষয় আছে। আদালত অবমাননার মামলায় তিনটির একটি বিষয় প্রমাণ করতে হয়। স্ক্যান্ডালাইজিং দ্য কোর্ট, কোর্টের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, অবস্ট্রাকশন অব দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব দ্য জাস্টিস, বিচারের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, আদালতের ডিগনিটি ক্ষুণ্ন করা।”

আদেশের সময় এজলাসকক্ষে অভিযুক্তদের দাঁড় করিয়ে রাখাটা ‘অভদ্রতা’ মন্তব্য করে জাফরুল্লাহ বলেন, “যখন রায় পড়েন তখন সকল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে রাখা অর্থহীন। এটা প্রাগৈতিহাসিক, মধ্যযুগীয় ঘটনা। কিন্তু তারা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তারপর বলেছেন বয়স, কিন্তু বয়সের সম্মান আমি তাদের কাছে কামনা করি না।”

এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর  ও নজরুল ইসলাম এবং গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের সংগঠক কামাল পাশা চৌধুরী ও এফ এম শাহীন গত ৬ জুলাই আদালত অবমাননার এই অভিযোগ দায়ের করেন।

অভিযোগের বিষয়ে গত ১২ জুলাই প্রাথমিক শুনানি করে ট্রাইব্যুনাল জাফরুল্লাহকে আদালতে হাজির হয়ে নিজের আচরণের ব্যাখ্যা দিতে বলে। এরপর গত ৯ আগস্ট আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

জাফরুল্লাহর ওই বক্তব্য ‘দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মতো’ উল্লেখ করে সোমবার রায়ের এক পর্যায়ে আদালত বলে, “রায়ের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু বিচারকদের সমালোচনা করা যায় না।”

রায়ের পর আদালত থেকে বেরিয়ে জাফরুল্লাহর আইনজীবী বাসেত মজুমদার বলেন, “আসলেই এ ধরনের বক্তব্য বলা ঠিক না; মিডিয়ায় প্রকাশ করাও ঠিক না। এই ধরনের কথা বললে আদালত অবমাননা তো হবেই।”

প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ বলেন, “জাফরুউল্লাহ বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এরপরও প্রথমেই ক্ষমা চাওয়ায় আদালত তাকে ক্ষমা করেছে।”

এর আগে টকশো’তে মন্তব্যের কারণে আরও একবার অবমাননার অভিযোগে জাফরুল্লাহকে ট্রাইব্যুনালে জবাব দিতে হয়েছিল।