১৪ মিনিটের শুনানিতে যা বললেন লতিফ

সংসদ সদস্য পদ নিয়ে বিতর্ক নিষ্পত্তির শুনানি এড়াতে হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে লড়লেও শেষ পর্যন্ত সেই শুনানিতে উপস্থিত হয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2015, 09:01 AM
Updated : 23 August 2015, 02:03 PM

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে মাত্র ১৪ মিনিটের ওই শুনানির পর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত এই নেতা বলেছেন, এখনও তিনি ‘নেতার প্রতি’ অনুগত; ‘নেতার ইচ্ছা’ জেনেই তিনি নিজে থেকে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিচ্ছেন। 

নির্বাচন কমিশনের শুনানি বন্ধে লতিফের আবেদন খারিজের যে আদেশ হাই কোর্ট দিয়েছিল, রোববার আপিল বিভাগেও তা বহাল থাকে।

এরপর বেলা পৌনে ১১টার দিকে নির্বাচন কমিশনে পৌঁছান লতিফ সিদ্দিকী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজে শুনানিতে না এলেও তার প্রতিনিধিত্ব করেন দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সহ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছার ও সাইফুদ্দিন খালেদ।

সিইসি, চার নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ এবং ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম ও আইন শাখার যুগ্ম সচিব মো. শাহজাহানের উপস্থিতিতে ঠিক ১১টায় ইসির সম্মেলন কক্ষে শুনানি শুরু হয়।

লতিফ ও আওয়ামী লীগের জনা বিশেক সমর্থক এ সময় সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

ইসির যুগ্ম সচিব লতিফ সিদ্দিকীকে তার বক্তব্য তুলে ধরার আমন্ত্রণ জানালে তিনি নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি কি এখানে কথা বলব, নাকি পাশের ডায়াসে যাব?”

এরপর এগিয়ে এসে সামনে রাখা ডায়াসে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য লতিফ, যাকে হজ নিয়ে মন্তব্যের কারণে এক বছর আগে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় সদস্যপদ  হারাতে হয়েছে। 

তিনি বলেন, “আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...আমি সাচ্চা মুসলমান, আমি জন আস্থায় বিশ্বাস করি। জনতার আদালতে আমি গিয়েছি। আমি সংসদ সদস্য। আইনগতভাবে ও সাংবিধানিকভাবে সংবিধানের ৬৬ (৪) ধারা অনুযায়ী আমার বিষয়ে স্পিকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় আমাকে হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয়েছে।”

নিজের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে লতিফ বলেন, এর আগে ‘বহুবার’ দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও এমন শুনানিতে তাকে আগে কখনো আসতে হয়নি।

“দল থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি। বহুভাবে বহুবার বহিষ্কার হয়েছি। এভাবে আর কখনো হয়নি। মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আমি আনন্দের সঙ্গে, নির্লিপ্তভাবে ঘোষণা করছি, আমি টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব। এটা আমার ঘোষণা, আমার সিদ্ধান্ত।”

নির্বাচন কমিশনের এ শুনানির আর ‘দরকার নেই’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

“আপনাদের আর কোনো কার্যক্রম নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আপনাদের কষ্ট দিলাম। আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি। এখন থেকে মাত্র ৫ মিনিট পরেই তা কার্যকর হবে। স্পিকারের কাছে বিষয়টি জানানো হবে।”

পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছারকে শুনানিতে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়।

ডায়াসে দাঁড়িয়ে এ আইনজীবী বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, “উনি (লতিফ) তো পদত্যাগের কথা বলছেন। এখন কি আমাকে আর কিছু বলতে হবে?”

এ সময় নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “আপনি আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করুন। উনি (লতিফ) তো পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।”

এ সময় নিজের আসনে দাঁড়িয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, “আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বলেছি। আমি সংসদে গিয়ে স্পিকারকে তা জানাব।”

এমন সময় রিয়াজুল কবির কাউছার তার বক্তব্য শুরু করেন।

তিনি বলতে থাকেন, “...নির্বাচনী আইন ও সংবিধান অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর আর সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকার সুযোগ নেই... তার সদস্য পদ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।”

এরপর লতিফ সিদ্দিকী সহাস্যে ডায়াসে গিয়ে আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে ‘একমত’ পোষণ করেন।

নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারককে এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। পরে তিনি জানতে চান, লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে একমত কি না।

জবাবে লতিফ বলেন, “আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সদস্য পদ বাতিল চেয়েছে। আমার তো আর কিছু করার নাই, তাদের সঙ্গে একমত। তাই তো স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি।”

বেলা ১১টা ১২ মিনিটে প্রধান নির্বাচন কমিশনার শুনানিতে অংশ নেওয়া দুই পক্ষকে ইসির অবস্থান তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “লতিফ সিদ্দিকী সেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। কীভাবে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় তা সংবিধানে বলা রয়েছে। তিনি তা মেনেই কাজ করবেন আশা করি।”

দুই সপ্তাহের মধ্যে বিতর্ক নিষ্পত্তির বিধান থাকায় এ বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্তও পরে জানানো হবে বলে শুনানি শেষ করেন সিইসি।

তিনি বলেন, “শুনানি আপাতত মুলতবি রাখা হল। দুই সপ্তাহ পরে এ বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত জানাব।”

পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠিও নির্বাচন কমিশনে জমা দেন লতিফ সিদ্দিকী।  

নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, শুনানি মুলতবি করা হয়েছে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানি হবে।

“এর মধ্যে উনি (লতিফ) যদি পদত্যাগ করেন, এ সংক্রান্ত চিঠি স্পিকারের কাছ থেকে আমাদের কাছেও আসতে পারে। সেদিন পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কোনো সংসদ সদস্য স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে এবং স্পিকার তা গ্রহণ করলে আসনটি শূন্য ঘোষণার ব্যবস্থা করতে ইসিতে চিঠি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ইসি পরবর্তী ব্যবস্থা নেয় ।

শুনানি শেষে বেরিয়ে লতিফ সিদ্দিকী রসিকতার সুরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন, “ভালো সংবাদের অপেক্ষায় রয়েছেন নিশ্চয়ই?”

পরে তিনি বলেন, “আমার ঈমানে এতটুকু দুর্বলতা নাই। যা প্রচার হয়েছে, তা মিথ্যা প্রচার হয়েছে।”

উচ্চ আদালতে মামলা লড়লেও হঠাৎ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ‘ইচ্ছার’ কথা বলেন লতিফ।

তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে, একটু বিলম্ব হয়েছে.. আমি অবগত হয়েছি... আমার নেতা চান না আমি এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করি। আমি কমিশনকে বলেছি, আমি আর এ মামলা লড়তে চাই না।

আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও ‘নেতার প্রতি’ এখনও ‘অনুগত’ বলে মন্তব্য করেন লতিফ।

তিনি বলেন, “আমি যেহেতু অনুগত, আমি কমিশনকে বলেছি, আজকের এই শুনানি মুলতবি করা হোক। আমি মাননীয় স্পিকারের বরাবরে আমার পদত্যাগপত্র পৌঁছে দেব। সংসদ সদস্য পদ নিয়ে লড়বার মতো দুর্বল মানসিকতা আমার নেই।”

সাংসদ পদ নিয়ে তার ‘কোনো লোভ নেই’ মন্তব্য করে চারবারের এই সংসদ সদস্য বলেন, “আমার কাছে মূল্যবান হচ্ছে জনগণের ভালোবাসা। জনগণের ওপর আস্থা রয়েছে। আমি কমিশনকে বলেছি- আমি আর এ মামলা লড়তে চাই না। আমার সংসদ সদস্য পদ রক্ষার জন্যে আর বৃথা লড়াই করব না।”

কমিশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে লতিফ তার বক্তব্য শেষ করেন এভাবে- “আমি চাই এ দেশের কল্যাণ... শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা...। আপনাদের কল্যাণ হোক, শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোক, জয় বাংলা।”