শনিবারে বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা মানসিকভাবে দারিদ্র্যের মধ্যে আছি। আমাদের মানস কাঠামোয় যে দারিদ্র্য আছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা এখনও সাদাদের সঙ্গে কথা বলার সময় সোজা হয়ে কথা বলতে পারি না, মানসিকভাবে যেন কিছুটা ভেঙে পড়ি।”
এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অবিচল থাকার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “১৯৭৩ সালে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার একেবারে খালি তখনও বঙ্গবন্ধু বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টকে বলতে পেরেছিলেন, তোমরা যদি শর্ত দাও যে ‘পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে বৈদেশিক সাহায্য খরচ হয়েছিল, তার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।’ তাহলে আমি বলব, তোমাদের কোনো সাহায্যই আমরা নেব না।”
তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে আমরা কারও উপর প্রভুত্ব করতে চাই না। আমরা কাউকে আমাদের উপর প্রভুত্ব করতে দেব না। যদি আপনার হাঁটু কাঁপে তাহলে আপনি ৬ ফুট/সাড়ে ৬ ফুট মানুষের সামনে দাঁড়াবেন কীভাবে?
“নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মাত্র ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার ছিলেন। কিন্তু এই মানুষটিই প্রায় সারা পৃথিবী দখল করে ফেলেছিলেন। তাই শারীরিক শক্তিই নয়, মানসিক শক্তিই আসল শক্তি। এ ব্যাপারে বাঙালিদের খেয়াল রাখতে হবে।”
কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কা সফরে এক ফরাসি অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “তিনি আমাকে বারবার একটা কথাই বলেছিলেন, ‘তোমাদের যেমন টাকার প্রয়োজন, সাদাদের তেমন তোমাদের তাদের অতিরিক্ত টাকাগুলো দেওয়া প্রয়োজন।’ আমাদের নীতি-নির্ধারকদেরও এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।”
‘সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ’ থেকে বর্তমান বাংলাদেশ কোথায় নেমে এসেছে সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য আবুল বারকাতের বইটি পড়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“আমরা নিচে নেমেছি আবার উঠেছি। এখন আর আমাদের নিচে নামার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে আছি ওখান থেকেই এগিয়ে যেতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ছিল সাগরের মত বিশাল হৃদয়। কত বড় মাপের মানুষ উনি ছিলেন তাতো আমি বলতে পারব না। কারণ আমার মত সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার একজন মানুষের পক্ষে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সেই চেষ্টাও আমি করব না।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে সর্বকালের সেরা বক্তৃতা অভিহিত করে খায়রুল হক বলেন, “সেরা বক্তব্য যারা দিয়েছিলেন তাদের বক্তব্যের জন্য প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রস্তুতি বলতে ছিল কিছু নোট ও জটিংস। যেই বক্তৃতা তিনি দিলেন, সেই বক্তৃতার জন্য বিদেশি সাংবাদিকরা তাকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসাবে অভিহিত করেছিল।”
প্রকাশনা অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ও ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম আলোচনা করেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বক্তব্যে ‘বাঙালিরা মানুষ হয়েছে’ বলার পর তার সঙ্গে কথা দেখা করেছিলেন জানিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, “আমরা তার কাছে গিয়ে বলেছিলাম, একটি মুক্তিযুদ্ধ করলেই কেউ মানুষ হয়ে যায় না। মানুষ হওয়ার জন্য তাদের জন্য কিছু ব্যবস্থার প্রয়োজন, সেটা আপনাকেই করে যেতে হবে।
“কিন্তু এতদিন পরে এসেও আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশে লোকসংখ্যা বাড়লেও মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এটা আমার ধারণা, বারকাত সাহেবরা গবেষণা করে বের করতে পারেন। মানুষ ও লোকের আলাদা শুমারি হওয়া উচিত।”
আমীর-উল ইসলাম বলেন, “আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি না কেন, উন্নয়নের ভার সহ্য করার মত লোক যদি তৈরি করতে না পারি, তাহলে কিন্তু উন্নয়ন টিকে থাকবে না।”
অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু যখন ক্ষমতায় আসেন তখন মাত্র ৪ লাখ টন খাদ্যশস্য ছিল, ঘাটতি ছিল ৪০ লাখ টন। এমন অবস্থা থেকে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে তিনি পরিবর্তন করেছিলেন। এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যে অবস্থায় আগে ছিল।”
মিজানুর রহমান বলেন, “আমি একজন মিজানুর রহমান মরে গেলে একজন মানুষই কেবল মারা যায়। কিন্তু একজন শেখ মুজিবুর রহমান মারা গেলে একটি আদর্শ, একটি দর্শনের মৃত্যু হয়।”
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী ঘিরে নানা ধরনের ‘মেকি শোকসভা’র সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যারা মেকি শোকসভা করছে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, সাধারণ মানুষ-শ্রমিক-কৃষক-মোটে-মজুর, তাদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।”