হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ৫ মামলা ঝুলছে বহু দিন

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার যতগুলো ঘটনা ঘটেছিল, তার চারটি আদালতে গড়ালেও বহু দিনেও শেষ হয়নি বিচার।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2015, 04:08 PM
Updated : 20 August 2015, 05:30 PM

ওই চারটি ঘটনার পাঁচটি (মোট মামলা ২১ অগাস্ট নিয়ে সাতটি) মামলার বিচার শেষ না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তাদের অবহেলা, অব্যবস্থাপনাই মূল বিষয় হিসেবে ধরা পড়েছে।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার দুই মামলায় গতি থাকলেও অন্য পাঁচটি মামলা থেমে আছে ঢাকা ও সাতক্ষীরার আদালতে। এগুলোর বিচার কবে নাগাদ শেষ হবে, তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

মামলাগুলো হচ্ছে- ১৯৮৯ সালের ১০ অগাস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে ফ্রিডম পার্টির নেতৃত্বে হামলার ঘটনার দুই মামলা, ২০০০ সালের ২০ জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রাখার দুই মামলা, ২০০২ সালের ৩০ অগাস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বিএনপি কার্যালয়ের সামনে গাড়িবহরে হামলার মামলা।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে গেলেও ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর রাজনীতিতে নেমে একাধিকবার ঝুঁকিতে পড়েন শেখ হাসিনা।

এর মধ্যেই গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছেন, জীবনের পরোয়া তিনি করেন না।

একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলার মামলা দুটি ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে চলছে। এই মামলা দুটিই কেবল গতিশীল। সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের মামলা দুটি।

ফ্রিডম পার্টির হামলার মামলা

২৪ বছর আগের এই হামলার মামলায় আসামিদের জবানবন্দি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে পাওয়া যায়নি বলে এ মামলার বিচারকাজ ঝুলে আছে।

এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের তৎকালীন হাকিম আফজালুর রহমানের বাড়ি টাঙ্গাইলের বিলওয়ালী গ্রামের ঠিকানায় অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে।

আফজালুর এ মামলার তিনজন আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়েছিলেন।

এ মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। বার বার সমন পাঠিয়ে,  অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও আফজালুরের হদিস না পাওয়ায় কয়েক দফায় সাক্ষ্য গ্রহণ  পিছিয়ে যায়।

এদিকে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর ও ২ নম্বর সাক্ষীকে আসামি ফ্রিডম পার্টির কর্মী মুরাদের আইনজীবী গত বছরের ২১ মে পুনরায় সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আবেদন জানালে এই সাক্ষীদের তলব করা হয়।

আগামী ২৯ অক্টোবর বিচারক রুহুল আমিন এ মামলার সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য পুনরায় তারিখ রেখেছেন; যদিও হত্যাচেষ্টা মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষের সব সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

একই আদালতে একই আসামিদের বিরুদ্ধে একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলারও বিচার চলছে। এ মামলায় একই বিচারক রুহুল আমিন রাষ্ট্র পক্ষের ১, ৮ এবং ১৩ নম্বর সাক্ষী অর্থাৎ তৎকালীন হাকিম আফজালুরকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা পাঠিয়েছেন বলে নথিপত্রে দেখা গেছে।

ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত পিপি সাইফুল ইসলাম হেলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হত্যাচেষ্টা মামলাটির উপরেই বেশি জোর দিচ্ছেন তারা।

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালের ১০ অগাস্ট রাতে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০/১২ জনের একটি দল আক্রমণ করে। তারা একযোগে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে ‘কর্নেল ফারুক-কর্নেল রশীদ’ জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দেয়।

বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য মো. জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় মামলাটি করেন।

পরে তিন আসামি রেজাউল ইসলাম খান, মো. লিয়াকত ও হুমায়ুন কবীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, রশীদ ও বজলুল হুদার নির্দেশে তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলাটি চালিয়েছিলেন।

এইচ এম এরশাদ সরকারের আমলে দায়ের হওয়া এ মামলাটির তদন্ত কাজ সে সময়ে বন্ধ থাকে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর তদন্ত গতি পায়।

১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ মামলাটিতে অভিযোগপত্র জমা দেয় আদালতে।

অভিযোগপত্রে ফ্রিডম পার্টির নেতা ও বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, আবদুর রশিদ ও বজলুল হুদাসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়।

এরপর আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট মেয়াদের শাসনকালে মামলাটির বিচার আর এগোয়নি। ২০০৯ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ফের গতি আসে মামলায়।

ওই বছরের ৫ জুলাই অভিযোগ গঠন করে ২৭ অগাস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে আদালত।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হলেও বিচার থাকে ঝুলে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে মামলার নথি আগের বিচারিক আদালত ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। মামলাটির বিচারের ভার তিনজন বিচারকের হাত ঘুরে এ আদালতে আসে।

মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, চার আসামি গোলাম সারোয়ার, সোহেল, জর্জ, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ  কারাগারে রয়েছেন। পাঁচ আসামি হুমায়ুন কবির (১), মিজানুর রহমান, খন্দকার আমিরুল ইসলাম কাজল, গাজী ইমাম হোসেন, শাহজাহান জামিনে রয়েছেন। আবদুর রশীদ, হুমায়ুন কবীর (২) ও জাফর আহম্মদ মানিক রয়েছেন পলাতক।

মুরাদকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হলেও ইন্টারপোলের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনার পর গত বছরের ২০ মার্চ তাকে আদালতের সামনে হাজির করা হয়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তার পক্ষে আগের সাক্ষীদের  নতুন করে সাক্ষ্য নেওয়ার আবেদন করা হলে পিছিয়ে যায় বিচার।

কোটালীপাড়ার ৭৬ কেজি বোমা

শেখ হাসিনার ভাষণের জন্য মঞ্চ নির্মাণের সময় ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশে কবি সুকান্ত সেবা সংঘের সামনে একটি দোকানের সামনে মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করা হয়।

এর দুই দিন পরে নিজের নির্বাচনী এলাকার ওই কলেজ মাঠে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল।

ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপপরিদর্শক নূর হোসেন বাদী হয়ে এ থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করেন।

শেখ হাসিনা (ফাইল ছবি)

তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল, তাতে আসামি করা হয় ১৬ জনকে। পরে ২০০৯ সালের ২৯ জুন নতুন করে ৯ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

গোপালগঞ্জের আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্রটি যখন দেওয়া হয়, তখন রাষ্ট্রপক্ষে ৮৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪১ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল।

পরে তখনকার বিচারিক আদালতের বিচারক গোলাম মুরশেদ ওই ৪১ সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আবার ডাকেন।

জনগুরুত্বসম্পন্ন, স্পর্শকাতর ও আলোচিত হওয়ার কারণে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তিতে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে গোপালগঞ্জের আদালত থেকে ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। পরে মামলাটি যায় ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।

এ ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক মো. নূরুজ্জামানের কাছে আসামি মুফতি আব্দুল হান্নানের খালাত ভাই ঘটনাস্থলের চায়ের দোকানি বদিউজ্জামান ২০১২ সালের ১ অগাস্ট সাক্ষ্য দেন।

এরপর এ মামলায় তারিখের পর তারিখ চলে গেলেও আর কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। গত বুধবার (১৯ অগাস্ট, ২০১৫) এ মামলার সাক্ষ্য নেওয়ার দিন ছিল।

একই দিন একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার সাক্ষ্যগ্রহণও ছিল। কয়েকজন দুই মামলায়ই আসামি। ফলে গোপালগঞ্জের মামলাটিতে ওই আসামিদের হাজির করা যায়নি।   

বৃহস্পতিবার মুফতি হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ অভি, মাওলানা আব্দুর রহমান, মাওলানা সাব্বিরের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বাদী নূর হোসেনকে জেরা করেন। 

ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক মমতাজ বেগম আগামী ৩ সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য নেওয়ার দিন রেখেছেন।

ঢাকার এ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি সৈয়দ সামসুল হক বাদল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সত্যি কথা বলতে কী, গোপালগঞ্জের আদালত থেকে সাক্ষী রিকলের আদেশ হওয়ার পর আমরা বিপদে পড়ে গেছি। এতগুলো সাক্ষীকে আবার ঢাকার আদালতে নিয়ে আসা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

“তাছাড়া দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় এসব সাক্ষীদের আগের জবানবন্দির সঙ্গে এখনকার জবানবন্দির ফারাক আসতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।”

এ মামলার ২৪ আসামির মধ্যে  মুফতি হান্নানসহ ১১ জন কারাগারে রয়েছেন। একজন জামিনে এবং অন্যরা পলাতক বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান আসামিদের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ।