অবমাননার দায়ে জনকণ্ঠ সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকের সাজা

বিচারাধীন বিষয়ে বিচারকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিবন্ধ প্রকাশ করায় জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ও নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়কে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছে আদালত।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2015, 04:22 AM
Updated : 13 August 2015, 04:22 AM

বৃহস্পতিবার আদালত না ওঠা পর্যন্ত এই দুই সাংবাদিককে সেখানে অবস্থান করতে বলা হয়। এটাই তাদের দণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়। 

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বৃহত্তর আপিল বেঞ্চ আলোচিত এই অবমাননা মামলার রায় ঘোষণা করে।

পাশাপাশি দুই সাংবাদিককে দশ হাজার টাকা জরিমানাও করেছে সর্বোচ্চ আদালত। ওই টাকা কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দিয়ে আদালতে তার রশিদ দাখিল করতে হবে। সাত দিনের মধ্যে জরিমানার টাকা না দিলে তাদের সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন।

রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, বিচারালয় ও বিচারককে নিয়ে কুৎসা রটানো যাবে না।... স্বাধীনভাবে কথা বলার অর্থ এই নয় যে লাগামহীন হবে।”

সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে আদালত বসার পর পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ও স্বদেশ রায় আদালত কক্ষে আইনজীবীদের বেঞ্চে বসেন। প্রধান বিচারপতি সকাল ১০টা ৭ মিনিটে রায় পড়া শেষ করলে দুই সাংবাদিকের সাজা শুরু হয়।

আদালতের কার্যক্রম শেষ হয় বেলা সোয়া ১টায়। ওই সময় পর্যন্ত মোট ৫৪টি মামলার কাজ চলে।

এ বেঞ্চের অন্য পাঁচ সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

আদালত উঠে যাওয়ার পর আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ও স্বদেশ রায় আইনজীবীদের সঙ্গে আদালত থেকে বেরিয়ে যান। সাজা হিসেবে তারা আদালতে ছিলেন তিন ঘণ্টা আট মিনিট।

তাদের আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের রায় আমরা মেনে নিয়েছি, গ্রহণ করেছি। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে পর্যালোচনা করে রিভিউয়ের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

এ বিষয়টির শুরু হয় যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর চূড়ান্ত রায় প্রকাশের আগে গত ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে স্বদেশ রায়ের লেখা একটি নিবন্ধকে কেন্দ্র করে।

২৯ জুলাই সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণার পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদক ও নিবন্ধের লেখকের বিরুদ্ধে রুল জারি করে। অবমাননার দায়ে কেন তাদের সাজা দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে দুজনকে তলব করা হয়।

১০ অগাস্ট এ বিষয়ে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতের নির্দেশে ওই নিবন্ধের বিভিন্ন অংশ পড়ে শোনান।

‘সাকার পরিবারের তৎপরতা: পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামে ওই নিবন্ধের একটি অংশে বলা হয়, “এখানেই কি শেষ ৭১-এর অন্যতম নৃশংস খুনি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নিষ্পাপ বাঙালির রক্তে যে গাদ্দারগুলো সব থেকে বেশি হোলি খেলেছিল এই সাকা তাদের একজন। এই যুদ্ধাপরাধীর আপিল বিভাগের রায় ২৯ জুলাই। পিতা মুজিব! তোমার কন্যাকে এখানেও ক্রুশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই যদি না হয়, তাহলে কিভাবে যারা বিচার করছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের লোকেরা? তারা কোন পথে বিচারকের কাছে ঢোকে, আইএসআই ও উলফা পথে না অন্য পথে? ভিকটিমের পরিবারের লোকদেরকে কি কখনও কোন বিচারপতি সাক্ষাৎ দেয়। বিচারকের এথিকসে পড়ে! কেন শেখ হাসিনার সরকারকে কোন কোন বিচারপতির এ মুহূর্তের বিদেশ সফর ঠেকাতে ব্যস্ত হতে হয়। যে সফরের উদ্যোক্তা জামায়াত-বিএনপির অর্গানাইজেশান।” 

বিবাদীদের আইনজীবী সালাউদ্দিন দোলন প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে এ বিষয়ে ‍শুনানির জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠনের আবেদন করলেও তা নাকচ হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি ছয় সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির সিদ্ধান্ত দেন।

প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রধান বিচারপতিকে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল কি না- শুনানির এক পর্যায়ে তা জানতে চায় আদালত। পরে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কোনো বিচারককে বিদেশ যেতে বাধা দেওয়া হয়নি।

১০ অগাস্ট শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি একান্তই তার নিজের এখতিয়ার। এমনকি উচ্চ আদালতের বিচারকসহ বিচার বিভাগের কোনো ব্যক্তির বিদেশ যাওয়ার বিষয়টিও প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত।

“প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক একাধিক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের পরামর্শ নিয়েছি কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ..প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তিনি বিচার বিভাগ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে নাক গলান না।”

বিচারপতি এস কে সিনহা শুনানিতে বলেন, “সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা থেকে যদি প্রধান বিচারপতি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতেন তবে কারা লাভবান হত? শুনানি শেষে রায়ের আগে যদি প্রধান বিচারপতি সরে যেত তাহলে তো ওই মামলায় রায়ই হত না।

এরপর ১১ অগাস্ট শুনানিতে জনকণ্ঠের আইনজীবী একটি অডিও রেকর্ডের শ্রুতিলিখন উপস্থাপন করেন, যা বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলা এবং মওদুদ আহমদের বাড়ি নিয়ে মামলার বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য এক বিচারকের কথোপকথন বলে তিনি দাবি করেন।

এই বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রশাসনিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাকে বিভিন্ন বিচারকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।

“প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমারও নানা বিষয়ে কথা হয়, বিতর্কও হয়। এখন আমি যদি সব সময় টেপ নিয়ে যাই, তাহলে প্রধান বিচারপতি আমাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন? তাহলে কি কোনো প্রধান বিচারপতি কাজ করতে পারবেন?”

বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, “এখানে শুধু প্রধান বিচারপতিকে মেলাইন করা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তিতে আঘাত করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান। সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।”

ওই অডিও রেকর্ড সোমবার একাত্তর টেলিভিশনে প্রচার করা হলে মঙ্গলবার আপিল বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরেকটি আদেশ দেয়।

একাত্তরে সম্প্রচারিত খবর ও আলোচনা অনুষ্ঠানের ভিডিও এবং সেখানে শোনানো দুই বিচারকের কথোপকথনের অডিও টেপ ১৬ অগাস্টের মধ্যে আপিল বিভাগে দাখিল করতে বলা হয় ওই আদেশে।

এর আগে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি লেখায় আদালত অবমাননার দায়ে পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে ২০১৪ সালের মার্চে সাজা দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ওই মামলায় নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে রেহাই পান।

এ ধরনের লেখা ছাপার বিষয়ে প্রথম আলোসহ সব সংবাদ মাধ্যমকে সে সময় সতর্ক করে দিয়েছিল আদালত।