ঢাকায় ঘরে ঢুকে স্বজনদের উপস্থিতিতে এই হত্যাকাণ্ডের তিন দিনেও কাউকে গ্রেপ্তার না করতে পারার সমালোচনার মধ্যেই পুলিশ বলছে, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ছয় মাসে তিনজন খুন হওয়ার পর শুক্রবার দুপুরে গোড়ানে বাসায় ঢুকে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায় কয়েক যুবক।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে অভিজিৎ রায়, বেগুন বাড়িতে ওয়াশিকুর রহমান বাবু এবং সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশকেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
তাদের হত্যার পর যেভাবে আনসার আল ইসলাম নামে খোলা ফেইসবুক ও টুইটার পাতায় বিবৃতি এসেছিল, তেমনি নিলয় হত্যার দায় স্বীকার করেও বিবৃতি আসে।
তবে ‘আনসার আল ইসলাম’ নামে কোনো জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার খবর বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে নেই। তারা বলছেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমই আনসার ইসলামের ছদ্মাবরণে কাজ করতে পারে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকেই সন্দেহ করছেন।
“আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের কোনো গ্রুপ এই হত্যাকাণ্ড সংগঠন করে থাকতে পারে। গোয়েন্দারা এই হত্যা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা বিভিন্ন তথ্য যাচাই বাছাই করে খুনিদের ধরতে কাজ করে যাচ্ছে।”
গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিলয়কে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘আনসার আল ইসলাম’ এর নামে দায় স্বীকার করে যে বার্তা এসেছে, সেই মেইলগুলো বাংলাদেশ থেকেই পাঠানো হয়েছে।
“কোনো একটি পক্ষ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে আর অন্য পক্ষ হত্যাকারীদের আড়াল করতে বা তদন্ত কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করতেও এই মেইল করে থাকতে পারে,” সন্দেহের কথা জানান তিনি।
নিলয়ের দেহে ধারালো অস্ত্রের ১২টি আঘাত ছিল, যার প্রায় সবই মাথার আশপাশে। তার মৃত্যু নিশ্চিত করতেই এত আঘাত করা হয় বলে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, “নিলয়কে যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তার সঙ্গে আগে যেসব ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তার ধরন মিলে যায়।”
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে গত বছর নিষিদ্ধ করা হয়। এই দলটির প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের মুখোমুখি।
ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডে যে দুই মাদ্রাসাছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা মুফতি জসীমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ ইতোপূর্বে জানিয়েছে।
আনসার আল ইসলামের ই-মেইল ও ফেইসবুক আইডি শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল।
নিলয়ের ঘর থেকে একটি ল্যাপটপ ও সিম্ফোনি মোবাইল সেট খোয়া গেছে। তা উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন খান একটি দাঁত, রক্তমাখা গামছা ও একটি টিশার্ট থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়ে তা ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার আবেদন করেন। আদালত তাতে সায়ও দিয়েছে।
উপ-কমিশনার মাহবুব বলেন, “নিলয়কে হত্যার পর তার বাসার নিচে রক্তমাখা টিশার্টটি পাওয়া গিয়েছিল। নিলয়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার পর তার শরীরে রক্ত লেগে যাওয়ায় খুনি শার্টটি ফেলে গিয়েছিল।”
সোমবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সেখানে তারা কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বলেছেন।
বাংলাদেশে ব্লগার খুন নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনার মধ্যে নিলয় হত্যার তদন্তে সহযোগিতা করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই।
এফবিআইয়ের তিন সদস্যের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রোববার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বৈঠক করে।
মাহবুব বলেন, “তারা (এফবিআই) আমাদের কতটুকু সহায়তা, কীভাবে নিশ্চিত করবেন আমরা তা জানতে চেয়েছি।”
“এছাড়াও অভিজিৎ রায় হত্যার সময় তারা ১১টি আলামত নিজেদের পরীক্ষাগারে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোও আমরা যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা শেষে ফেরত চেয়েছি।”
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎ স্বদেশে আসার কয়েকদিনের মধ্যে খুন হয়েছিলেন। লেখালেখির জন্য তাকে হুমকি দিয়ে আসছিল ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। একই হুমকি ছিল নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশের ক্ষেত্রেও।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক মাসের মধ্যে চারজন ব্লগার হত্যার বিষয়টিকে গোয়েন্দারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।”
অভিজিৎ হত্যায় জড়িত সাতজনের নাম পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার আবু তাহের ওরফে সাইফুলকেও কয়েকজনের নামও বলেছে বলে তিনি জানান।
“গোয়েন্দা পুলিশ ওই নামগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে যাচাই-বাছাই করে তাদের পরিচয় জানতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,” বলেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।