মুক্তির উৎসবে ছিটমহলের শেষদিন

শিক্ষার সুযোগ ও স্বাস্থ্যসেবাসহ ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসানের হাতছানির সামনে দাঁড়িয়ে নানা আয়োজনে উৎসবমুখর একটি দিন কাটিয়েছেন বাংলাদেশের ভেতর বসবাস করা ছিটমহলবাসীরা; নতুন ভোরে যারা পরিচিত হবেন নতুন জাতীয়তায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2015, 04:22 PM
Updated : 31 July 2015, 04:22 PM

শুক্রবার দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লাঠি খেলা ও নৌকা বাইচসহ নানা আয়োজনে এই উৎসবে মুখর হয় বাংলাদেশের পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার সবগুলো ছিটমহল।

ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশ ভাগের সময় ১৯৪৭ সাল থেকে সিরিল রেডক্লিফ কমিশনের তাড়াহুড়োয় বাংলাদেশে ১১১ ভারতীয় ছিটমহলের এসব বাসিন্দা জটিল এক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতর বসবাস করে আসছিলেন।

বিপরীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহলেও ছিল একই বঞ্চনার গল্প।

এবার নতুন পরিচয়ে নতুন দিনের প্রত্যাশায় মধ্যরাতে বাড়ি বাড়ি ৬৮ মোমবাতি বা ৬৮ প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে সারাদিনের এসব উৎসব ও প্রার্থনা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।

কুড়িগ্রাম সীমান্ত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় ছিটমহলগুলোর একটি। ছিটমহল হস্তান্তরের বড় আয়োজন এখানেই চলছে।

ছিটবাসী সব বয়সের নারী-পুরুষ অংশগ্রহণে বিকাল থেকে দাশিয়ারছড়ার তিনটি মঞ্চে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে এই ছিটের কালিরহাট বাজারে ছিল মূল আয়োজন।

ছিটমহল বিনিময়কে সামনে রেখে দিনব্যাপী উৎসবে কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের নীলকমল নদীতে নৌকাবাইচ

এর আগে শুক্রবার সকাল থেকেই লাঠি খেলা ও নৌকাবাইচসহ আনন্দ মিছিল করে এই ছিটের বাসিন্দারা। পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়ি বাড়ি চলে ভাল খাবারের আয়োজন।

দাশিয়ারছড়া ছিটের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত নীলকমল নদীতে ছিল নৌকাবাইচের আয়োজন। নদীর দুই তীরে শতশত মানুষ নৌকা বাইচ উপভোগ করেন।

পরে ছিটের কামালপুর গ্রামের বটতলায় অনুষ্ঠিত হয় মনোমুগ্ধকর লাঠিখেলা। এতে ছিটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়।

এরপর রাত ১২টা ০১ মিনিটে দাশিয়ারছড়ার ১০টি পয়েন্টে ৬৮টি করে মোমবাতি জ্বালিয়ে পূর্ণতা পায় ছিটবাসীদের আনন্দ উৎসব।

ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের সমন্বয় কমিটির দাশিয়ারছড়া ইউনিট সভাপতি আলতাব হোসেন বিডিনিউজ টোয়ন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দে ছিটমহলবাসীরা বিভিন্ন স্থানে লাঠি খেলা, নোকাবাইচ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এসব আয়োজন করে।”

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিতরকুটি, বসপচাই ছিটমহল, পাটগ্রামের ভেতর ১১৯-বাঁশকাটা এবং হাতীবান্ধার গোতামারী ছিটমহলেও দেখা যায় বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস।

জুমার নামাজের পরপরই লালমনিরহাটের এসব ছিটমহলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা, ব্যান্ড পার্টির বাজনা এবং স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় লোক সংগীত শুরু হয়। ছিটের শিশু-কিশোরদের নিয়েও ছিল নানা আয়োজন।

ছিটমহল বিনিময়কে সামনে রেখে দিনব্যাপী কর্মসূচিতে কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের মসজিদে মসজিদে বিশেষ প্রার্থনা, মন্দিরগুলোতেও ছিল প্রার্থনার একই আয়োজন

পাটগ্রামের ১১৯-বাঁশকাটা ছিটমহলের বাসিন্দা হাফিজার রহমান (৬০) বলেন, “এখানে ছিটবাসীরা বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডির আয়োজন করে, যাতে ‘ছিটমহল’ বনাম ‘বাংলাদেশ’ দল প্রতিযোগিতা করে।

“এছাড়া লাঠি খেলার প্রতিযোগিতার পর সন্ধ্যায় জারি-সারি আর ভাওয়াইয়া গানের আসর বসে।”

বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হওয়ার আনন্দে শুক্রবার রাত ১২টার পর তারা ‘বিজয় দিবস’ আনুষ্ঠানিকতা শুরু করা হয় বলে জানান হাফিজার।

গত ৭ মে ভারতের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের পথ তৈরি হয়।  এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরে ছিটমহল বিনিময়ে অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হয়।

ছিটমহল বিনিময়ের আগে শুক্রবার কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়া ছিটের নয়টি মসজিদ ও ছয়টি মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনায় আয়োজন করা হয়।

ভারতীয় ভূখণ্ডে শুক্রবারই ছিল ছিটের মুসলমান অধিবাসীদের শেষ জুমার নামাজ। নামাজ শেষে মিলাদ মাহফিল ও আখেরি মোনাজাত এবং মন্দিরে মন্দিরে পূজা অর্চনা করে ছিটমহলবাসীরা।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাশিয়ার ছড়া ছিটমহলে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সীদের আনন্দ মিছিল

প্রার্থনায় সময় ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর সুস্বাস্থ্য কামনা করেন ছিটবাসীরা।

একইভাবে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় চার ছিটমহল এবং পঞ্চগড়ের ছিটমহলেও রয়েছে নানা উৎসব-আয়োজন।

ডিমলার ২৯ নম্বর বড়খানকি গিলাইদহ ছিটের বাসিন্দা আবদার রহমান বলেন, এখানে শনিবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।এরপর মিষ্টি বিতরণ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ শিশুদের খেলাধুলা ও পুরস্কার বিতরণ হবে।

বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা

ছিটমহল বিনিময়কে কেন্দ্র করে দাশিয়ারছড়ায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দিন-রাত সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশের দুই স্তরের নিরাপত্তা টহল দেখা যায়।

এছাড়াও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ দলের সঙ্গে বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে তদারকিতে দেখা যায়। তাদের সহযোগিতা করেন স্থানীয় ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক।

কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ বলেন, ছিটমহলবাসীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের অনুমতি পেলে ভবিষ্যতে এ ছিটে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য পাঠিয়েছেন কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আহসান হাবিব নীলু, লালমনিরহাট প্রতিনিধি আনিছুর রহমান, নীলফামারী প্রতিনিধি বিজয় চক্রবর্তী কাজল)