মুক্তির রাতের অপেক্ষা

আটষট্টি বছর ধরে এক দেশের সীমান্তের ভেতরে অন্য দেশের ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’ হয়ে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের বাড়িতে বাড়িতে মধ্যরাতে জ্বলে উঠবে ৬৮টি করে প্রদীপ; বদলে যাবে পতাকা, পরিচয়; অবসান ঘটবে ৫০ হাজার মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2015, 06:35 AM
Updated : 31 July 2015, 05:22 PM

ভারত ও বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ক্যালেন্ডারের তারিখ ১ অগাস্টে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে ছিটমহল বিনিময়।

এর ফলে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১টি ছিটমহল হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর আয়তনের বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের মানচিত্রে মিলে যাবে।

এতদিন যে ছিটমহলের মালিক ছিল ভারত, সেখানে উড়বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। একইভাবে ভারতের পতাকা উঠবে এতদিন বাংলাদেশের মালিকানায় থাকা ছিটমহলগুলোতে।

দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এই সমস্যার অবসানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র পূর্ণতা পাওয়ার পথে এগিয়ে যাবে আরও এক ধাপ। মুক্ত জীবনের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে থাকা ছিটমহলগুলোতে চলছে সেই উৎসবের প্রস্তুতি।

শুক্রবার মধ্যরাতের পর বাংলাদেশে ছিটমহল শব্দটি ঠাঁই নেবে ইতিহাসের পাতায়। সীমান্তে আর কোনো জনপদকে ‘ছিটমহল’ হিসেবে পরিচিত হতে হবে না। বাসিন্দারা পাবেন নাগরিক সুযোগ সুবিধা, দেশের আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন তারা।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশ ভাগের সময় সিরিল রেডক্লিফ কমিশনের তাড়াহুড়োয় চিহ্নিত করা সীমান্তে ছিটমহল জটিলতার শুরু। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই সমস্যার অবসানে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়। এরপর তা কার্যকরে প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালে।

গত ৭ মে ভারতের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই চুক্তি বাস্তবায়নের পথ তৈরি হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরে অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হয়।

নিজ নিজ দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এসব ছিটমহলের সরাসরি কোনো যোগাযোগ না থাকায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ছিল না। আরেক দেশের সীমানার ভেতরে হওয়ায় হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, স্কুল-কলেজ বা বিচার- প্রশাসনও ছিল না সেখানে।

ফলে ছিটের বাসিন্দাদের ইচ্ছা থাকলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ ছিল সীমিত। অনেকেই বাংলাদেশি বা ভারতীয় ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করলেও ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় চাকরির সুযোগ তাদের এতোদিন হয়নি।

ভারতে সবগুলো ছিটমহলের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। আর বাংলাদেশে ছিটমহলগুলো পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায়।

গত ১৬ জুন দুই দেশের জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে ঠিক করা ছিটমহল বিনিময়ের কর্মকৌশল অনুযায়ী ৬ থেকে ১৬ জুলাই যৌথ সমীক্ষা চালানো হয়। সে সময় ছিটমহলগুলোর জনগণনার পাশাপাশি কে কোন দেশে থাকতে চান তা জানতে চাওয়া হয়।

এতোদিন বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের অধিকাংশ অধিবাসী বাংলাদেশে থাকতে চেয়েছেন। ঠিকানা বদলে ভারতের নাগরিকত্ব নিতে চেয়েছেন  ৯৭৯ জন। অন্যদিকে ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অধিবাসীর সবাই ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই থেকে যেতে চেয়েছেন।

যারা পুরনো আবাস বদলে ভারতের নাগরিকত্ব রেখে সে দেশে চলে যাবেন ঠিক করেছেন, তারা ১ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন ঠিকানায় চলে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। 

বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে দুই দেশের হাইকমিশনাররা বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে এক অনুষ্ঠানে  ৩০টি গুচ্ছ মানচিত্রে সই করেন। এর মাধ্যমে কেবল মুহুরির চরের দুই কিলোমিটার এলাকা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে ১ হাজার ১৪৪টি মানচিত্রে সই হল। ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নতুন করে চিহ্নিত এসব সীমান্তে সীমানা পিলার বসানোর কথা রয়েছে।

দিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী গুচ্ছ মানচিত্র হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বলেন, এর মধ্যে দিয়ে সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হল।

আর ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ একে উল্লেখ করেন ‘এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে।

ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সভাপতি ময়নুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাসের অবসান ঘটার এই দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে দুই দেশের সব ছিটমহলে শুক্রবার মধ্যরাতে ৬৮টি করে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালানো হবে।

“এছাড়া ছিটমহলের প্রতিটি অন্ধকার সড়কে মশাল জ্বালিয়ে আলোকিত করার পাশাপাশি ওড়ানো হবে ফানুস।”

স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিময় হয়ে যাওয়ার পরপরই প্রতিটি ছিটমহলে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হবে বলে জানান ময়নুল।

এছাড়া শুক্রবার সারাদিন ছিটমহলগুলোর নাগরিক কমিটির উদ্যোগে স্থানীয় বিভিন্ন খেলাধুলা, গান ও নাটকসহ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

কমিটির ভারত অংশের সভাপতি দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “দীর্ঘ ৬৮ বছরের কষ্ট আর নাগরিকত্বহীন জীবনের যন্ত্রণার অবসানের প্রতীক হিসাবে দুই দেশের ছিটমহলবাসী অভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।

“এ দিনটি হবে ছিটমহলবাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দিন ও উৎসবের রাত। এরপর প্রতিবছরই দিনটিকে স্মরণ করে ছিলমহলবাসী নানা কর্মসূচি পালন করবে।”