ফাঁসির পথের সাকা যে অভিযোগে খালাস

একাত্তরে হত্যা ও গণহত্যার দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আপিল বিভাগ বহাল রাখলেও রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন, যাতে তাকে ২০ বছরের সাজা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।

সুলাইমান নিলয়মহিউদ্দিন ফারুক ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 03:04 PM
Updated : 29 July 2015, 03:10 PM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বুধবার এ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে।

সংক্ষিপ্ত এই রায়ে বলা হয়, আপিল আংশিক মঞ্জুর হয়েছে। আপিলকারী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় ৭ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় তার সাজা বহাল থাকল।    

চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের চার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় বাংলাদেশের সাবেক এই মন্ত্রীকে ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ২৩ অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় দেয়।

এর মধ্যে ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা ও গণহত্যার ঘটনায় তার ফাঁসির রায় আসে। প্রথম তিনটি অপরাধ ঘটানো হয় ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল, অপরটি তার চার দিন পর।

ট্রাইব্যুনাল ২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছিল, যার মধ্যে প্রথম দুটিতে সাজা বহাল রেখেছে আপিল আদালত।

১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছরের সাজাও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বহাল রয়েছে।

সাকার আপিল মঞ্জুর হয়েছে কেবল ৭ নম্বর অভিযোগে। ট্রাইব্যুনাল দোষী সাব্যস্ত করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিলেও চূড়ান্ত রায়ে তিনি এ অভিযোগে খালাস পেয়েছেন।

অভিযোগ-৭: ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনাসদস্য রাউজান পৌরসভা এলাকায় সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে প্রবেশ করে। সতীশ ঘর থেকে বেরিয়ে এলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, তাকে মেরে ফেলতে হবে। এরপর সৈন্যরা সতীশকে ঘরের ভেতর যেতে বলে। তিনি পেছন ফেরার পর সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং কাঁথা মুড়িয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলে।

২০১০ সালে রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ে তদন্তকারীরা।

 

নির্মমতার চার অভিযোগে ফাঁসি

৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় আপিল আদালতে বহাল রাখা হয়েছে।

এসব অভিযোগের উপর আলোচনার পর ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, “এটা প্রমাণিত যে, অভিযুক্ত নিজে উপস্থিত থেকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আমরা এই বিষয়ে একমত যে, মানবতার নীতিবোধকে কাঁপিয়ে দেওয়া এ ধরনের গুরুতর অপরাধে আইন অনুযায়ী আসামির সর্বোচ্চ সাজাই প্রাপ্য।”

অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজানের গহিরা এলাকায় কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়। সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে প্রার্থনারত নূতন চন্দ্রকে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হয়। সাকার নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা নূতন চন্দ্রের ওপর গুলি চালায়। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাকে গুলি করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

এ ঘটনায় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সহযোগীরা পথ দেখিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের হিন্দুবসতিপূর্ণ বণিকপাড়ায় নিয়ে যান। সেখানে হিন্দুদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে নেপাল চন্দ্র ধর, মণীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনীল বরণ ধর নিহত হন। পরে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার সময় লুকিয়ে থাকা সনাতন বিশ্বাস ও তার পরিবার পরে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

এ ঘটনায় গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে রাউজানের হিন্দু বসতি ঊনসত্তরপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান সালাউদ্দিন কাদের ও তার কয়েকজন সহযোগী। বৈঠকে যোগ দেয়ার কথা বলে গ্রামের ক্ষিতিশ মহাজনের পুকুরপাড়ে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে চন্দ্র কুমার পাল, গোপাল মালী, সন্তোষ মালী, বলরাম মালীসহ ৫০ জনের পরিচয় জানা গেলেও বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনায় জানুতি বালা পাল নামে একজন গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান। আরও অনেক হিন্দু পরিবারসহ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তিনি।

এ ঘটনায় গণহত্যা, দেশান্তরে বাধ্য করাসহ তিনটি অভিযোগ আনা হয় আসামির বিরুদ্ধে।

অভিযোগ-৮: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফফর তার পরিবারসহ রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে হাটহাজারীর তিন রাস্তার মোড় এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় তাদের প্রাইভেট কার থেকে নামিয়ে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে তাদের মুক্তির জন্য সালাউদ্দিন কাদেরের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কারা দুজন কখনো ফিরে আসেনি। পরে তাদের দুজনকে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে শেখ মুজাফফর ও শেখ আলমগীরকে অপহরণ ও হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।

দুই অভিযোগে ২০ বছর

২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদণ্ডই আপিল বিভাগ বহাল রেখেছে।

অভিযোগ-২: আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজানের মধ্যগহিরা হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলে। পরে ডা. মাখনলাল শর্মার বাড়ির আঙিনায় নিরস্ত্র হিন্দুদের একত্রিত করে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতেই নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এ ঘটনায় পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, জ্যেতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মাখনলাল শর্মা ঘটনার তিন-চারদিন পর মারা যান। জয়ন্ত কুমার শর্মা গুরুতর আহত হন এবং পরে প্রতিবন্ধী হয়ে যান।

এ ঘটনায় গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ-৪: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিয়ে রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় যান সালাউদ্দিন কাদের। ওই দিন সকালবেলায় সালাউদ্দিনের অন্য দুই সহযোগীকে ওই গ্রামে পাঠিয়ে গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি মিটিংয়ে যোগ দিতে বলা হয়। পরে গ্রামটি ঘিরে ফেলে কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় জমায়েত হওয়া হিন্দুদের ওপর নির্বচারে গুলি চালানো হয়। এতে তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমীর কান্তি চৌধুরী, অশোক চৌধুরীসহ ৩২ জন নিহত হন।

এছাড়া অমলেন্দ্র বিকাশ চৌধুরী, জ্যোৎস্না বালা চৌধুরী ও ছবি রাণী দাস গুরুতর আহত হন। এরা প্রত্যেকে পরে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘর লুটপাট করা হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় পরিকল্পনা, সহযোগিতা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয় বিএনপি সাকার নেতার বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রাম নগরীর গণি বেকারির মোড়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন ‘গুডস হিল’।

 

দুই অভিযোগে ৫ বছর

দুই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে পাঁচ বছরের যে কারাদণ্ড দিয়েছিল, তাতে আপিল বিভাগও সায় দিয়েছে।

অভিযোগ-১৭: ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা-সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন সহযোগী ও পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি থেকে নাজিমুদ্দিন আহমেদ, সিরাজ, ওয়াহিদ ওরফে জানু পাগলাকে অপহরণ করা হয়। তাদের চট্টগ্রাম শহরের গুডস হিলে সাকা চৌধুরীর বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে ওয়াহিদ ওরফে জানুকে ছেড়ে দেওয়া হলেও নাজিমুদ্দিন ও সিরাজকে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত আটকে রাখা হয়।

এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ-১৮: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চাঁদগাঁও থানাধীন মোহরা গ্রামের মো. সালাহউদ্দিনকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে আটকে রেখে নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাকে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ।

রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।