‘মানুষই মানুষের গা ঘেঁসিয়া বসিয়া থাকে’

হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয় ২৫ নভেম্বর, ১৯৯৮, ঢাকাস্থ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টহাউজে। তারিখটি মনে রেখেছি দুটো কারণে। প্রথমত, ওটা ছিল তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম বিস্তারিত আলাপ। এর আগেই তাঁর প্রায় সমস্ত লেখা আমি পড়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু আলাপ করার কোনো সুযোগ হয়ে উঠছিল না।

>> আহমাদ মোস্তফা কামালবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2021, 04:57 AM
Updated : 16 Nov 2021, 04:59 AM

সুযোগটা এসে গেল ওই দিন, একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার ছলে। দ্বিতীয় কারণটি এই সাক্ষাৎকার। আমি তখন অতি-তরুণ লেখক, সারাক্ষণ টগবগ করে ফুটছে রক্ত, যে-কাউকে কেবল কথা দিয়েই ঘায়েল করতে পারি। তাঁর সঙ্গেও অনেক মিঠে-কড়া কথাবার্তা বিনিময় হয়েছিল সেদিন।

পুরোটাই তেতো বা কড়া হয়নি, কারণ তাঁকে আমি ভালোও বাসতাম গভীরভাবে। তার প্রায় দশ বছর পর ২০০৮ সালে আমি তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি ধারণ করি ক্যাসেট রেকর্ডারে। কিন্তু সেটির লিখিত রূপ আর দেওয়া হয়নি, ফলে এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে।

যা হোক, কারো মহাপ্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে লিখতে বসা আমার জন্য বেশ কঠিন ব্যাপার এবং খানিকটা নিষ্ঠুরও মনে হয় নিজেকে। কারণ, এমন অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে যেগুলো লেখার চেয়ে নীরবে বসে ভাবতেই ভালো লাগে। গুছিয়ে সেগুলো লেখাও প্রায় অসম্ভব। তবু আমাদের লিখতে হয়। নিয়তি আমাদের কাঁধে এই বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে যেন!

সেই প্রথম আলাপে অনেক মিঠে-কড়া আলাপের কথা আগেই বলেছি। যেমন আমি শুরুই করেছিলাম এভাবে: বাংলা সাহিত্যের একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়- আমাদের অন্তত কিছু লেখা আছে যেগুলো পাঠকের স্মৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে। যেমন পথের পাঁচালী। এই উপন্যাসটির নাম শুনলেই যেন অপু আর দুর্গা হাজির হয়ে যায় চোখের সামনে। তাদের নানারকম কীর্তিকলাপ, অপুর বড়ো হয়ে ওঠা বা দুর্গার মৃত্যু-দৃশ্য যেন দেখতে পাই।

কিংবা শেষের কবিতা’র কথা উঠলেই অমিত-লাবণ্য এসে যায় সামনে। অথবা ধরুন কাজলা দিদি কবিতাটির কথাই- বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই- বহুকাল ধরে এই কাজলা দিদি কোনো এক অব্যাখ্যাত কারণে বাঙালি পাঠককে বিষণ্ন করে যাচ্ছে।

এ উদাহরণগুলো টানলাম একটি বিশেষ কারণে- প্রায় কৈশোরকাল থেকে আমি আপনার আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পের কথা শুনে এসেছি। একটা সময় পর্যন্ত আমার কাছে হাসান আজিজুল হক ছিলেন ওই একটি গল্পেরই লেখক। এখন বিচার করে দেখলে মনে হয় আপনার ওই গল্পটি যেন স্মৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে, আমার এবং আমাদের। আপনি তো আরো অনেক গল্প লিখেছেন, এই গল্পটির শক্তি কোথায় যে শুধু এটাই এই পরিণতি পেলো?

প্রশ্নটি শোনার পর তাঁর মুখে খুশির আভা দেখেছিলাম, উত্তরে বলেছিলেন: “নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, সাহিত্য পাঠের এটাই একটা লাভ যে, তা শুধু স্মৃতির অন্তর্গত হয়ে যায় তা নয়, ব্যক্তিত্ব গঠনেও ভূমিকা রাখে। পৃথিবীকে তুমি কীভাবে দেখবে, সমাজকে কীভাবে দেখবে, মানুষকে কীভাবে বিচার করবে এর অনেক কিছুই সাহিত্য ঠিক করে দিতে পারে। আমার অভিজ্ঞতাও তোমার মতোই। অনেক রচনা যেন আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রেখেছে। ব্রাদারস কারামাজভ-এর অনেক চরিত্র অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আমার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখা, যে পথের পাঁচালীর কথা বললে সেটা- এগুলো নানাভাবে আমাকে তৈরি করেছে।

“এখন, আমি লেখক হিসেবে যদি তেমন একটি বাক্যও লিখে থাকি যার সম্বন্ধে এরকম কথা শুনতে পাই যে, এটা যেন স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে- যেমন তুমি বললে একটি গল্প সম্বন্ধে- একজন লেখকের জন্য এটার চেয়ে বড়ো পাওয়া আর নেই। আর শক্তিটক্তি কী আছে না আছে সেসব সমালোচকরা খুঁজে বের করবেন। সমালোচনা ইঞ্জিনের মালগাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো লেখা টেনে নিয়ে যায়, সৎপাঠক লেখায় বুলিয়ে দিতে পারেন সোনার স্পর্শ!”

আবার কড়া কথাও কম বলিনি। ক্ষুণ্ন স্বরে বলেছিলাম: আপনার অনেক গল্প যেমন বুকের ভেতরে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, তেমনই কিছু গল্প পড়ে হতাশ এবং বিরক্তও হয়েছি। ভেবেছি, এত অল্প লেখেন, এত যত্ন নিয়ে লেখেন, তাও কিছু গল্প এমন ম্লান কেন?

তিনি সহাস্যে বলেছেন: “এই প্রশ্ন মানিক বা বিভূতিকেও করা যায়, কেউই উত্তর দিতে পারবেন না। আমিও পারবো না।”

এরকমই ছিল আমাদের সম্পর্ক। বরাবরই। তিনি ছিলেন এমনই এক মানুষ, মুখের ওপর সমালোচনা করলেও তিনি ক্ষুণ্ন হতেন না। বরং ভালোবেসে কাছে টেনে নিতেন।

হাসান আজিজুল হক। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

বছর চারেক পরের কথা। হবিগঞ্জের এক সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দেবে। সেই অনুষ্ঠানে আমাকেও আমন্ত্রণ করা হলো। গেলাম তাঁর সঙ্গে।

আয়োজকরাই সব ব্যবস্থা করেছিলেন। ট্রেনের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে, জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে ভারি মনোহর লাগছিল। হঠাৎ করেই এক দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। প্রখর রোদে মাঠে কাজ করতে থাকা এক কৃষককে দেখিয়ে বললাম: হাসান ভাই, ওই কৃষককে দেখে মনে হচ্ছে না, খুব আনন্দ নিয়ে কাজটা করছে?

তিনি আমার মনোভঙ্গি বুঝতে পেরেছিলেন কি না জানি না, পূর্ণ দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন: “কথাটা শেষ করো। অসম্পূর্ণ রেখেছ কেন?”

বললাম: কথাটা হলো, এই যে এসি কামরায় বসে কৃষকদের দেখতে আমাদের ভালো লাগছে, অথচ ওরা রোদে পুড়ে যাচ্ছে, বছর শেষে ফসলের ন্যায্য দামও পাবে না। আপনার কখনো মনে হয়নি, আপনার গল্পগুলো ওরকমই? ড্রয়িংরুমের আরামদায়ক পরিবেশে বসে গরিবের দুঃখ নিয়ে লিখেছেন?

তিনি চোখ সরালেন না আমার চোখ থেকে, বললেন: “তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো। তবে এখন নয়।”

উত্তর দিয়েছিলেন তিনি, সেই অনুষ্ঠানে, তাঁর ঘণ্টাখানেকের দীর্ঘ বক্তৃতায়। তার আগে অবশ্য আরো একটা ব্যাপার ঘটেছিল। সেই অনুষ্ঠানে যখন আমাকে বক্তৃতার জন্য ডাকা হয়, তখন আমি তাঁকে ‘আমাদের গল্পরাজ্যের রাজপুত্র’ বলে উপাধি দিই, আর সেটি ব্যাখ্যা করি এভাবে: ‘রাজার পতন ঘটলেও জনমনে রাজপুত্ররা সারাজীবন রাজপুত্রই রয়ে যান। হাসান আজিজুল হক আমাদের সেই অমর রাজপুত্র।’ (আমার গল্পের বই ‘ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ্য’ তাঁকে, ‘আমাদের গল্পরাজ্যের রাজপুত্র’ সম্বোধন করেই)।

একইসঙ্গে এও বলি: তাঁর গল্প খুব নির্দয় এক জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই জগৎটি এমন যেন সেখানে ফুল ফোটে না, পাখি গায় না, শিশুরা হাসে না, মানুষ সংসারজীবন যাপন করে না। জীবন এমন নাকি? পৃথিবী এরকম নির্দয় নাকি? হাসান ভাইয়ের কথাই ধার করে বলি, চোখের কোনায় একটু দয়া-মায়া থাকা ভালো।

তিনি যখন বক্তৃতা দিতে এলেন, তখন প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বললেন এসব নিয়ে। সব তো এখানে বর্ণনা করা যাবে না, মোদ্দাকথাটি ছিল: “আমি সব মানুষের জন্য মুক্ত জীবন চাই, অবাধ জীবন চাই, মর্যাদার জীবন চাই। সেজন্যই ওরকম প্রচণ্ড ধ্বংসের ছবি আঁকি। হয়তো বোঝাতে চাই, এই জীবন আমাদের কাম্য হতে পারে না। কিছুতেই না।”

সে-বার ফেরার পথে, আমি দুষ্টুমি করে বললাম: বহুকাল ধরে রাজপুত্রের আসনটি দখল করে আছেন। ছাড়বেন কবে? আপনি রাজা হয়ে যান, নইলে আমরা রাজপুত্র হবো কীভাবে?

তিনিও দুষ্টুমিতে কম যান না। বললেন: “কেবলই তো আসনটা দিলে, এত ঠেলাঠেলি করছো কেন, কিছুদিন আরাম করে বসে থাকতে দাও, তারপর ভেবে দেখবো আসন ছাড়বো কি না!” 

হাসান আজিজুল হক। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

দীর্ঘ লেখক-জীবন তাঁর, কিন্তু লিখতেন খুব কম। এ নিয়ে একদিন অভিযোগ জানালে তিনি বলেছিলেন: “মানুষ হিসেবে আমি খুব সামাজিক। আর বেঁচে থাকাটাকে এনজয় করি। পছন্দের সুখাদ্য পেতে ভালো লাগে, পছন্দের মানুষটির সঙ্গে দীর্ঘদিন পরে দেখা হলে ভালো লাগে, বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে রাখতে চাই আমার পা, বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহে কাটাতে চাই অন্তত একটি দণ্ড। অর্থাৎ খুব ছড়ানো জীবনযাপন করতে চাই আমি।

“আর আমার জীবনও খুব ছড়ানো, দুই দেশ জুড়ে। আমি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, কিন্তু একেবারে হৃতসর্বস্ব হয়ে আসিনি, বুকের মধ্যে লুকানো সম্পদ কিছু তো আছেই। আমার আগ্রহ বহুদিকে ছড়িয়ে গেছে- অর্থনীতিতে, ইতিহাসে, সমাজবিজ্ঞানে, এমনকি বাচ্চাদের রচনা পর্যন্ত। ফলে হয় কি, সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র লিখতে বসা হয়ে ওঠে না।”

এরকম ছড়ানো জীবন বলেই হয়েতো তাঁর কাছে জীবনের অর্থ ধরা দিয়েছিল মানুষের মুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। জিজ্ঞেস করেছিলাম: আপনি জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসেন, আপনার গল্পের চরিত্ররা বেঁচে থাকতে ভালোবাসে, বেঁচে থাকতে চায়। জীবনের জন্য বহুমাত্রিক আয়োজন আমাদের। আসলে কী জীবনের কোনো অর্থ আছে? আপনি কী খুঁজে পান কোনো অর্থ?

উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “জীবন তো সত্যিকার অর্থে নাথিং- এটা হচ্ছে অস্তিত্ববাদ-ওয়ালাদের কথা, তাদের নাথিংনেস তো একটা ক্যাটাগরি। মূল কথা হচ্ছে আমার জন্মের আগের কিছুই জানা নেই, মৃত্যুর পরেরটাও জানা নেই, অথচ অস্তিত্ব আছে। এর যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে।

“আমার ইচ্ছাধীন কিছুই নয়, আমি যে স্বাধীনতা চাই না তাই আমাকে দেওয়া আছে। ইউ আর ফ্রি; অ্যান্ড ইউ মাস্ট ডিসাইড এভরিথিং ইন্ডিপেন্ডেন্টলি, বাট এন্টায়ার ম্যানকাইন্ড উইল বি এফেক্টেড বাই ইওর ডিসিশন।

“দেখ, কী জটিল একটি পরিস্থিতি। কোনটা পবিত্র, কোনটা কাম্য, কোনটা গ্রহণযোগ্য এটা কি কোথাও লিখে দেওয়া আছে? পুরোটাই আমাকে আরোপ করতে হবে। ইন ইটসেলফ, জীবনকে আমি নাথিং-ই বলবো, এটাকে সামথিং করতে হবে আমাকে। সেটা কীভাবে করতে পারি? ঈশ্বরকে ডেকে ডেকে করার চেষ্টা করতে পারি, তাহলে একটা কন্টিনিউয়েশন হয়ে গেল। জীবনের শেষ হলো না।

“কিন্তু যে নাস্তিক, তার কী হবে? তার তো ঈশ্বর নেই, তাহলে সে এই মিনিংলেসনেস থেকে মুক্তি পাবে কীভাবে? এটা একটা সাংঘাতিক সমস্যা। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের জন্য জীবনের অন্ত ঘটবেই, কিছুই নেই তাহলে, কিছুই নেই।

“এদিক থেকে দেখতে গেলে জীবনের কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাই না। অথচ জীবনটা প্রদত্ত, আই হ্যাভ বিন গিভেন, অতএব জীবনকে যাপনযোগ্য করে তুলতে চাই। সমগ্র জীবনকে যাপনযোগ্য করতে চাই। তার মানে শুধু আমার জীবন নয়, মানবজীবন। দেশে-কালে-সমাজে-শ্রেণিতে-ধনে-সম্পদে-দারিদ্র্যে-শোষণে আবদ্ধ মানবজীবন। সকলকে মুক্ত করতে না পারলে নিজে মুক্ত হয়ে লাভ নেই। অন্যের পরাধীনতা আমার মুক্তিকেও বদ্ধ করে তুলবে।”

আহমাদ মোস্তফা কামাল

তাঁর খুব ভিন্ন ধরনের একটি গল্প ‘সাক্ষাৎকার’-এর কথা মনে পড়ছে! এটি এমনই এক গল্প যা হাসানের ‘সমাজ-সচেতন’ শ্রেণি-সচেতন’ ‘রাজনীতি-সচেতন’ ইমেজের সঙ্গে যায় না।

যে ‘লোকটা গত শতাব্দীর কায়দামাফিক সূর্যাস্ত দেখছিল’ আর ‘তার চোখে ফুটে উঠেছিল তন্ময় কল্পনা’ তাকে ধরে নিয়ে যায় কতিপয় অচেনা লোক, তাকে ‘রহমান সাহেব’ সম্বোধনে শুরু হয় জেরা, যদিও তার নাম রহমান নয়, হুমায়ুন কাদির। তারা ঠিক কী জানতে চায় পুরো গল্পে তা পরিষ্কার হয় না, বোঝা যায় তারা তার কাছ থেকে একটি স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু কিসের স্বীকারোক্তি তা-ও বোঝা যায় না।

অবশেষে অজানা অপরাধে হুমায়ুন কাদিরের মৃত্যুদণ্ড হয়, এবং দণ্ড কার্যকর করার আগে তাকে দুমিনিট ভাববার সুযোগ দিলে সে ভাবে-

অনেককাল আগে একবার সবুজ ঘাসের মধ্যে শুইয়া আকাশের দিকে চাহিয়াছিলাম। উহার এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত দেখা গিয়াছিলো, উহা হালকা নীল ছিলো। পরে উহা চুম্বনের দাগের মতো মিলাইয়া যায়। ইহার পর মানুষের জগতে ফিরিয়া আসি- তাহাতে নোনা টক গন্ধ আছে এবং আক্রোশ ও ঘৃণা রহিয়াছে এবং ভালোবাসা ও মমতা রহিয়াছে। মানুষের জীবনে কোথায় অন্ধকার তাহার সন্ধান করিতে গিয়া আমি ঘন নীল একটি ট্যাবলেটের সন্ধান পাই- মানুষ যে সামাজিক, সে নিজের ইতিহাস জানিতে চাহিয়াছে, তাহাতে সর্বদাই অন্ধকার নর্তনকুর্দন করিতেছে। তবু আমি মানুষেরই কাছে প্রার্থনা জানাইব- কারণ মানুষেই মানুষের গা ঘেঁসিয়া বসিয়া থাকে- যদিও ওই দাগ দেখা যায় না। অসংখ্যবার সঙ্গম করিয়াও যেমন আমি নারীতে ঐ দাগ কখনো দেখি নাই। কোথাও কিছু পাই না বলিয়াই বাধ্য হইয়া আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাইব। ইতিমধ্যে সব কিছু চমৎকার ঘটিয়াছে। অবশ্য অনেক কিছুই বাকিও রহিয়া গেল কারণ কিছুই শেষ হইবার নহে।

আমরা যে অ্যাবসার্ডিটির ভেতরে বাস করি, বিনা কারণে, অজানা অপরাধে আমাদের মৃত্যুদণ্ড হয়ে যায়, আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয় কিন্তু আমরা বুঝেই উঠতে পারি না যে, আমাদের কাছে আসলে কী জানতে চাওয়া হচ্ছে- তার একটি প্রতীকি উপস্থাপন রয়েছে এই গল্পে। তবে স্বান্ত্বনা ওটুকুই- যা কিছুই ঘটুক না কেন, মৃত্যুমুহূর্তেও কোথাও কিছু পাইনি বলে আমরা মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাবো, কারণ মানুষই মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়! কারণ ‘মানুষই মানুষের গা ঘেঁসিয়া বসিয়া থাকে!’

একবার, এক অনুষ্ঠান শেষে পানাহারের সময় তিনি কী কারণে যেন খুব বিষণ্ন হয়ে বলেছিলেন: ‘আমার দিন তো শেষ হয়ে এলো। এবার যাবার পালা।”

শুনে খুব অভিমান করে বললাম: আমি খুব ছোটবেকলায় বাবাকে হারিয়েছি। আপনার মধ্যে আমি বাবার ছায়া দেখতে পাই। আপনি চলে যেতে চান কেন? আমাকে তাহলে কার কাছে রেখে যাবেন?

খুব আবেগভরে কথাটা বলেছিলাম, বলাই বাহুল্য। তিনি যেন বিহ্বল হয়ে গেলেন। বললেন, তোমার বাবা নেই? আমি জানতাম না। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললেন: ওটা কথার কথা বলেছি। যাবো না। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।

আজ খবর পেলাম, আপনি চলে গিয়েছেন! যদি বিদায় না দিই? যদি বলি, আমাকে ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে আপনি কোথায় যাবেন? যেতে পারবেন?

বিদায় আপনাকে দিলাম না আমি। আপনার স্নেহমাখা হাতটি আমার মাথার ওপর থেকে সরতে দিতে চাই না।

আপনি লিখেছিলেন, ‘মানুষই মানুষের গা ঘেঁসিয়া বসিয়া থাকে’, আমিও আপনার গা ঘেঁসে বসে থাকতে চাই আজীবন।