আনন্দবাজার জানিয়েছে, গত ১৪ এপ্রিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ৮৯ বছর বয়সী এই কবি।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়। সেই সঙ্গে বাংলার কবিতায় একটি যুগের অবসান ঘটে।
শঙ্খ ঘোষের পারিবারিক নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে জন্ম। আর বাংলা কাব্য সাহিত্যে তার আর্বিভাব বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে।
বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গির খোঁজে চল্লিশের দশকের যে তরুণ কবিরা কৃত্তিবাস বা শতভিষা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুন এক রোমান্টিক জগতের সৃষ্টি করেছিলেন, শঙ্খ ঘোষ তাদের একজন।
শক্তি, সুনীল, শঙ্খ, উৎপল, বিনয় – এই পাঁচ কবিকে বলা হত জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডব।
মৃত্যুর পর শঙ্খের কবিতার কথাগুলো ফিরে ফিরে আসছে সোশাল মিডিয়ায়। ভক্ত-পাঠকরা লিখছেন তার সেই পংক্তি: ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/শব্দহীন হও/ শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর/ লেখো আয়ু লেখো আয়ু।
সেই রোমান্টিক শঙ্খের কাব্যভাষা প্রেমের লহরি বাজিয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের বাস্তবতায় ভিন্ন এক ব্যঞ্জনায়। আবার তা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে প্রায়ই।
জরুরি অবস্থার মধ্যে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শঙ্খের প্রতিবাদ এসেছে ছন্দের ছদ্ম আবরণে। আবার কখনও তা অনেক সরাসরি- তীব্র শ্লেষের তীর হয়ে বিঁধেছে।
শাসকের মুখোশ খুলতে সবিনয় নিবেদন কবিতায় তিনি লিখেছেন: আমি তো আমার শপথ রেখেছি/ অক্ষরে অক্ষরে/ যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে।
আবার কুচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলির প্রতিবাদে শঙ্খের কলম লিখেছে: নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে/ একটু আগুন দে।/ হাতের শিরায় শিখার মতন/ মরার আনন্দে।
হাল আমলে নাগরিকত্ব আইনেরও প্রতিবাদ এসেছে তার ‘মাটি’ কবিতায়। শঙ্খকে লিখতে হয়েছে: গোধূলিরঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান/ এ–দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান।/ এখনও পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ/ এ–মাটি আমারও মাটি সেকথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ।
শঙ্খ ঘোষের বাবা মণীন্দ্রকুমার ঘোষের পৈতৃক ভিটা ছিল বরিশালের বানারীপাড়ায়। তবে বাবার কর্মস্থলের সূত্রে তার কৈশোরের একটি অংশ পাবনায় কেটেছে। সেখানে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিক দিয়ে চলে যান কলকাতায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন শঙ্খ। পরে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন।
কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করার পর ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দেন শঙ্খ ঘোষ।
পরে ফিরে এসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতীতে তিনি অধ্যাপনা করেন।
তার চার ডজন গদ্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘ছন্দের বারান্দা’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘শব্দ আর সত্য’, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, ‘কবিতার মুহূর্ত’, ‘কবির অভিপ্রায়’, ‘সময়ের জলছবি’, ‘লেখা যখন হয় না’র মত বই। শঙ্খ ঘোষ ছোটদের জন্যও বিশটির বেশি বই লিখেছেন।
‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৭৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান শঙ্খ ঘোষ। কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত ‘রক্তকল্যাণ’ নাটকটির জন্য ১৯৯৯ সালে আবারও তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান।
এ ছাড়া রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়া এ সাহিত্যিককে ২০১১ সালে পদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত করে ভারত সরকার।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেছেন, “কোভিডে মারা গিয়েছেন শঙ্খদা। তা সত্ত্বেও যাতে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা যায়, মুখ্যসচিবকে তেমন নির্দেশ দিয়েছি।”
আর শঙ্খ ঘোষের ‘কাব্য শিষ্য’ কবি জয় গোস্বামী বলেছেন, “বাংলা সাহিত্যজগতে মহা বটবৃক্ষের পতন ঘটল। তরুণ কবি এবং লেখকদের মাথার উপর পিতা এবং অভিভাবকস্বরূপ বিরাজ করছিলেন উনি। জাতির বিবেক হিসেবে ছিলেন। মাথার উপর থেকে সেই আশ্রয় সরে গেল। নিঃস্ব হলাম।”
আর সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে শঙ্খ ঘোষের শূন্যতা ‘কৃষ্ণগহ্বরের’ মত।
“শঙ্খদাকে শুধু কবি বললে ব্যাপারটা একপেশে হয়ে যায়। তিনি আসলে সাহিত্যের অভিভাবক। সত্যিকারের অভিভাবক সবাই হতে পারে না, এক বার দেখলাম, জুনিয়র এক কবির কবিতা সংশোধন করছেন। এত বড় মাপের কবির কি এটা কাজ? কী দরকার ওঁর? কিন্তু ওই যে! দায়িত্ববোধ আর স্নেহ।”
আনন্দবাজার লিখেছে, বুধবার বিকেলে কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবির শেষকৃত্য হয়। তবে তাকে ‘গান স্যালুট‘ দেওয়া হয়নি, কারণ কবি পছন্দ করতেন না তোপধ্বনি। তার পরিবারও চেয়েছে আড়ম্বরহীনভাবে যেন শেষ বিদায় জানানো হয়।
কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়। আর মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন থেকে কী চেয়েছিলেন তিনি?
সেই সত্তরের দশকে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি লিখে গেছেন: এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম/আজ বসন্তের শূন্য হাত—/ ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।