Published : 24 Apr 2018, 11:13 AM
মেধাসম্পদ কি? – খুব সহজ কথায় বলা যায়, মানুষ নিজে যে মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেই মেধা সচেতনভাবে খাটিয়ে যে ধরনের সম্পদ তৈরি করতে সক্ষম, তা-ই মেধাসম্পদ। রবীণ্দ্রনাথ জন্মসূত্রে কবিতা লেখার মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই মেধা খাটিয়ে তিনি 'গীতবিতান' রচনা করেছেন। অতএব তাঁর সৃষ্ট 'গীতবিতান' তাঁর মেধাসম্পদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এই সম্পদ মানুষের গতানুগতিক সম্পদ অর্থাৎ জমিজমা, টাকাপয়সা বা সোনারূপার চেয়ে আলাদা এক সম্পদ। জমিজমা, দালানকোঠা ইত্যাদিকে আমরা বলি স্থাবর সম্পদ; অন্যদিকে টাকা-পয়সা কিংবা সোনা-রূপা ইত্যাদিকে বলি অস্থাবর সম্পদ। এগুলোর মালিকানা সহজেই হস্তান্তরযোগ্য। মেধা-সম্পদ ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অস্তিত্ব, সক্ষমতা ও তার প্রয়োগ-কুশলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় তাকে ব্যক্তি-স্রষ্টা থেকে আলাদা করা যায় না। তাই ব্যক্তির সত্তালীন সৃষ্টিশীলতাই এই সম্পদের উৎস।
এই ব্যক্তিলীন সৃষ্টিশীলতার দুই প্রধান উপাদান : স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞা। স্বজ্ঞা তার জন্মগত জ্ঞান; আর প্রজ্ঞা তার অধীত, চর্চিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ বোধ-বুদ্ধি, বিদ্যা, চর্চা ও প্রয়োগকৌশলের ফসল। এ দুয়ের সমন্বয়েই তার সৃষ্টিশীলতার ফলপ্রসূতা। এই সৃষ্টিশীলতাই ব্যক্তিস্রষ্টার অস্তিত্বের সমার্থক। তাই তার অধিকার বা সুফল-কুফলও একমাত্র তারই কর্তৃত্বাধীন। আসলে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, যেমন জমিদারের জমিজমা বা লেখকের কালি-কলমের চেয়েও ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতার উৎসজাত ও স্রষ্টার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ-কর্ম কতো বেশি মূল্যবান তা একবিংশ শতাব্দীর ধনীগরীবসহ জগতের সকল সম্প্রদায়ই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে চলেছেন। আশার কথা, বাংলাদেশেও সেই বোধ-বুদ্ধিকেন্দ্রিক সৃষ্টিসম্পদের অপরিহার্যতার বার্তা এসে পৌঁছেছে। তাই মেধাসম্পদকে সুরক্ষা দেয়া আজ যুগের দাবি।
মেধাসম্পদের বিকাশ, সুরক্ষা ও সুফলের জন্য সময়ানুগ আইন চাই, আইনের প্রয়োগ চাই, এবং প্রাপ্ত সুফল প্রকৃত স্রষ্টা তথা অধিকারের মালিকদের মাঝে সুবন্টিত হওয়ার সুব্যবস্থা চাই। তাই আজ আমরা এখানে মেধাসম্পদ বিকাশে কপিরাইট আইনের ভূমিকার বিষয়টিই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবো। এই আইনটি বাংলাদেশে দীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত থাকলেও তা সময়ের প্রয়োজনে হালতকীকরণ করা হয়নি এবং এ সম্পর্কে অংশীজনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে সচেতনতাও ন্যূনতম।
২
মেধাসম্পদের অধিকারই মেধাস্বত্ব, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় আইপিআর বা ইন্টেলেকচুয়্যাল প্রপার্টি রাইট্স। সৃষ্টিশীলতার প্রকৃতি-বিচারে এই সম্পদকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে দুই ধরনের আইন প্রচলিত আছে। পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অ্যাক্ট আর কপিরাইট অ্যাক্ট। পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অ্যাক্ট সব ধরনের বৈজ্ঞানিক, কারিগরি ও ইন্ডাস্ট্রিয়্যাল সৃষ্টির সুরক্ষার জন্যে কাজ করে। এই বিষয়িগুলির বাণিজ্যিক উপযোগিতা অতি সুপ্রত্যক্ষ ও বহুলপ্রচলিত বিধায় এই আহনটির প্রয়োগ আমাদের দেশেও অপেক্ষাকৃত ব্যাপকতর। ফলে মূর্ত শিল্পবাণিজ্যিক মেধাসম্পদের বিকাশে এই আইন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
অন্যদিকে কপিরাইট আইন বিশেষত সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, নান্দনিক ও মনোদৈহিক অতি সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয় কাজ নিয়ে করে। এই বিষয়গুলির বাণিজ্যিক ও অর্থকরী পরিপ্রেক্ষিত আমাদের দেশে নিকট অতীতেও তেমন গভীরভাবে উপলব্ধি করা হয়নি। তাই মেধাসম্পদের বিকাশে, বিশেষত যাবতীয় বিমূর্ত অভিব্যক্তির নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক বিকাশে কপিরাইট আইনের ভূমিকা নতুনভাবে ব্যাখ্যা ও অনুধাবন করা অত্যাবশ্যক। কেননা এই আইনের বিকাশ না হলে আমাদের দেশের মেধাসম্পদের অর্ধেকাংশ অবিকশিত থেকে যাবে। পৃথিবীর সব উন্নত ও প্রাগ্রসর দেশেই এই দুটি আইন সমানভাবে সক্রিয়। যে দেশ শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, লোকসম্পদ, সফটওয়্যার ইত্যাদিতে যত বেশি সমৃদ্ধিশালী সে দেশে কপিরাইটের ভূমিকা তত বেশি প্রযোজ্য। এ কারণে জাপান, কোরিয়া, চীনসহ পৃথিবীর সব প্রাগ্রসর দেশ কপিরাইটের বিকাশ ও দ্রুততম সময়ে এই আইনের হালতকীকরণে আগ্রহী। এমনকি জনগণের মধ্যে মেধাসম্পদের বিষয়টি সুবোধ্য করার জন্যে সে সব দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষার সর্ব স্তরে তা পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশেও তা-ই করা অত্যাবশ্যক।
৩
কপিরাইটের ভূমিকা প্রতিনিয়ত নবায়িত হচ্ছে। কেননা এই আইনের আওতায় আছে সব ধরনের সাহিত্যকর্ম, সংস্কৃতিকর্ম, নাট্যকর্ম, সংগীতকর্ম, শিল্পকর্ম, স্থাপত্যকর্ম, চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র-কর্ম, রেকর্ড-কর্ম, প্রকাশনা, অডিও-ভিডিও ও অন্যান্য পদ্ধতির ক্যাসেট বা কর্মধারক, বেতার-টেলিভিশন তথা মিডিয়া সম্প্রসার, ক্যাবল-নেট ওয়ার্ক, কম্পিউটার, সফটওয়ার, ইউ-টিউব, ফেসবুক বা তজ্জাতীয় নিত্যসম্প্রসারণশীল ধারণ-মাধ্যম ও প্রচার-মাধ্যম ইত্যাদি। আর এ-সব ক্ষেত্রে সৃষ্ট সব কর্মের অধিকার, তার সুফল ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে তিনিটি বিষয় আনুপূর্বিকভাবে জরুরি: ১. অধিকারের পরিচয় ও স্বীকৃতি ২. সুরক্ষা ও ৩. আদায়।
একটি কর্ম সৃষ্ট ও যে-কোনো মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অধিকার স্বীকৃত হয়ে যায়। তবে সুনিশ্চিতভাবে কর্মটির বাণিজ্যিক সুফল পেতে হলে তা যথাযথভাবে নিবন্ধন করা প্রয়োজন। তারপর সুরক্ষার জন্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্ররিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। তৃতীয় স্তর : অধিকার আদায় ও লঙ্ঘনের প্রতিকার বিধান। বাংলাদেশে কমবেশি সব-স্তর আছে, তবে তা সময়োপযোগী কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আদায়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীর সচেতনতা, উদ্যোগ ও প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্ঘবদ্ধতার মারাত্মক অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে এখানো সবক্ষেত্রে অংশীজনদের কপিরাইট সোসাইটি সক্রিয় নেই। ফলে স্বীকৃতি, সুরক্ষা বা আদায় পদে পদে বিঘ্নিত। সুফল পেতে হলে এই বাধা দূর করার কোনো বিকল্প নেই।
৪
কপিরাইটে স্বীকৃত প্রতিটি ক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়ন ও অংশীজনের অধিকার আদায় হলে সুফল অবশ্যম্ভাবী। সাহিত্য ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে এর সুফল পায় প্রত্যেক লেখক ও প্রকাশক। আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লাভজনক করতে হলে আমাদের প্রকাশকদের ভিনদেশি প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তিসম্পাদন করতে হবে। তবে তারও আগে দেশের অভ্যন্তরে মূল লেখকদের সঙ্গে সুষম চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হবে। স্বত্বাধিকারী, প্রকাশক, প্রযোজক, বিক্রেতা, সরবরাহকারী প্রমুখের সঙ্গেও আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অত্যাবশ্যক। একটি চলচ্চিত্রে লিখিত ও গীত গানের স্বত্বাধিকার কার, তা নির্ভর করবে যথাযথভাবে সম্পাদিত চুক্তির ওপর। তা নাহলে এই বিরোধের অবসান হবে না। এই মুহূর্তে সংগীত, চলচ্চিত্র ও ডিজিটাল মিডিয়া সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সেক্টর। কেননা এই সব মিডিয়ায় ভোক্তার সংখ্যা অগণিত। সাহিত্য-সংগীত-চিত্র-আলোকচিত্র-চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে সব সৃষ্ট কর্মই ডিজিটাল মিডিয়ায় পাইরেসি করার সুযোগ অবারিত। এই পাইরেসি ঠেকাতে পারলেই জাতি ও ব্যক্তিস্রষ্টা ও নির্মাতা অশেষ লাভবান হবেন। যেমন, ইউ-টিউবে সম্প্রসারিত যে কোনে গান, কবিতা, ভাষণ, নাটক বা অন্য কিছু যে কোনো স্রষ্টার ভাগ্যবদল করতে পারে খুব দ্রুত। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের, সততার ও বৈধতার। প্রাপ্ত এই সুফল সাধারণত ভাবমূর্তিগত, একাডেমিক ও আর্থিক। তবে এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান বিবেচনা আর্থিক সুফল। আর সেই সুফল পেতে হলে আমাদেরকে আন্ত-সম্পর্কযুক্ত যে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে তা প্রধানাংশে নিম্নরূপ : ১. মেধাস্বত্ব সম্পর্কে সব অংশীজনের সচেতনতা ও বিভ্রান্তি-মুক্তি; ২. সময়োচিত আইন প্রণয়ন ও নবায়ন; ৩ সব মহলে বাস্তবায়নের সদিচ্ছা; ৪. পরিকল্পিত উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন; ৫. সব ক্ষেত্রে পাইরেসি উৎখাত ৬. পৃথক আইপি আদালত গঠন ও বিরোধের দ্রুত প্রতিকার; ৭. প্রাপ্ত সুফল সর্ব পর্যায়ে বিতরণের জন্যে কপিরাইট সোসাইটি গঠন; এবং ৮. বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সফলতা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্যে মূল্যায়নমূলক মাঠজরিপ।
৫
পরিশেষে বলা যায়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মেধাসম্পদের বিকাশে কপিরাইট আইনের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। কেননা আমাদের লোকমেধা, লোকসৃষ্টি, লোকপণ্য, সঙ্গীত, সাহিত্য, চিত্রকলাসহ তাবৎ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Intangible Cultural Hertage) জাতি-গৌরব ও জাতিসমৃদ্ধির প্রধান উৎস হতে পারে। আমাদের জনগোষ্ঠিকে সৃষ্টিশ্রদ্ধাশীল পাইরেসিমুক্ত একটি উন্নত জাতিতে পরিণত করতে হলে কপিরাইট আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। অন্যের অনুকৃতি বা তস্করবৃত্তি নয়, বরং নিজের উদ্ভাবিত পুনপৌণিক সৃষ্টিকর্ম ও সংস্কৃতিপণ্য, তার সামষ্টিক স্বীকৃতি ও সুষম উপকার বণ্টনের মাধ্যেমে টেকসই প্রবৃদ্ধির সূচক হতে পারে। বিদ্যায়তনিক স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিকল্পিত জ্ঞানানুশীলন, স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞার ব্যবহার, অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও নবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেধাস্বত্ববান জাতিতে পরিণত হতে হবে। কেননা একবিংশ শতাব্দীর মানুষের সমৃদ্ধি মানে মেধাবান মানুষের অবদানজাত সমৃদ্ধি। ভারসাম্যময় কপিরাইট আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ একালের মানুষের মেধা লালন ও ফলপ্রসূ রাখার এক প্রধান অস্ত্র। মেধার জয় হোক।
২৩.০৪.২০১৮