রাষ্ট্রের অবহেলা তবু স্মরণের প্রান্তরে কে জি মোস্তফা

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 10 May 2022, 07:43 AM
Updated : 10 May 2022, 07:43 AM


খন্দকার গোলাম মোস্তফা উরফে কে জি মোস্তফা জীবনের সায়াহ্ন লগ্ন অতিবাহিত করেছেন গান ও কলাম লেখা, সাহিত্য চর্চা, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দেওয়া- এসব কাজে। প্রেস ক্লাবের মিডিয়া সেন্টারে নিজের কাজ করতেন সপ্তাহে দুইদিন। ৮৪ বছর বয়সেও এসব কাজ থেকে একদিনের জন্যও অবসর নেননি তিনি। প্রেসক্লাবের সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা সহ 'কবিতা পত্র'র কাব্য-সাহিত্য আসরও পরিচালনা করেছেন। কর্মের প্রতি ছিলেন নিরলস এবং ব্যক্তিত্বে ছিলেন সরল ও নির্লোভ। অজাত শত্রু এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন হাজার গানের এই গীতিকবি। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও চাকচিক্যহীন সাধারণ মানুষের জীবন কাটিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় বত্রিশ বছর ধরে আজিমপুর কবরস্থানের পাশে মসজিদ গলির একটি বাড়ির নীচতলায় আড়ম্বরহীন জীবনযাপন করেছেন তিনি। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে অতি সম্প্রতি লিখিত একটি কবিতায়-
"আমার কপালে কী আছে লেখা কে জানে-
কোন আকাঙ্ক্ষার দরকার নেই, কোন দুঃখ স্বীকারও নয়,
এমনকি চাই না কাউকে প্রতিনিবৃত্ত করার…"
(উল্লাস)

যতটা সান্নিধ্য তাঁর পেয়েছি, তাতে জেনেছি তাঁর কোন শারীরিক রোগ ছিল না। ৮৪ বছর বয়সে পদার্পণ করেও তিনি এই বয়সে কোন হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন না। বয়সের ভার থাকলেও কোন রোগের ভার বহন করেননি তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও শারীরিক জটিলতাবিহীন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ ছিলেন। বয়সজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর। তাঁর শেষ মুহূর্তের দৃশ্যাবলী ছিল খুবই আকস্মিক। তাঁর ছোট ছেলের স্ত্রীর (শিরিন) বর্ণনা অনুযায়ী, "বিছানায় বসে আব্বা হোমিওপ্যাথি ঔষধের বই পড়ছিল, রাজুও (কেজি মোস্তফার আড়াই বছর বয়সী নাতি) আব্বার ঘরেই খেলছিল। হঠাৎ শুনি রাজু চিৎকার করে কাঁদছে। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি আব্বা বিছানা থেকে পড়ে যাচ্ছিল। আব্বাকে ধরে শুইয়ে দিলাম। আব্বার বুক দিয়ে খুব জোরে জোরে কেমন যেন ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। তিনি কোন কথা বলতে পারছিলেন না। চোখ বুজেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম শব্দটা থেমে গেল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তের মধ্যে এসব ঘটে গেল। শব্দ থামার পরে বুঝলাম তিনি আর নেই। আমাকে নিজের মেয়ের মতন দেখতেন তিনি। তাঁর স্নেহ-মায়া আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না। খুবই সরল স্বভাব আর ভালো মনের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর জন্য সবাই দোয়া করেন, আল্লাহ্‌ যেন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করেন"।


আলোকচিত্র: কে জি মোস্তফার কোলে নাতি রাজু

কে জি মোস্তফার প্রাণ ছিল সংগীত। তাঁর ভাষায়, "প্রিয় গ্রন্থাবলী আমার সম্পদ। প্রিয়তমা স্ত্রী আমার জাগ্রত বিবেক। যোগ্য পুত্র একমাত্র ধন। প্রেমই মানবধর্ম। এ বিশ্বাসে গাছপালা ফুলপাখি যাবতীয় প্রাণীকূলে খুঁজে পাই নিজস্ব আমিকে। এতেই প্রশান্তি। স্রষ্টা আমার প্রাণেশ্বর এবং এটাই প্রার্থনা"। এই অকপট কথাগুলো তাঁর গ্রন্থ শুভেচ্ছার শিউলিমালা-তে পাওয়া যায়। গীতিকাব্য রচনার জন্য দেশব্যাপী তিনি অগণিত সম্মাননা, পদকে ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ললিত কলা বিভাগের 'সফেন' এর সম্মাননা ও পদক (২০০৪), সৃজনী সংগীত গোষ্ঠীর সম্মাননা ও পদক (২০০৫), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগ প্রদত্ত 'দেশবরেণ্য গীতিকার'(২০১৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক (২০২০), বাংলদেশ গীতিকার সংসদের আজীবন সদস্য পদক (২০২০) ইত্যাদি অন্যতম। গীতিকবি কে জি মোস্তফার গান নিয়ে যেসব এ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যে 'তোমারে লেগেছে এত যে ভাল', তৃষ্ণা আমার হারিয়ে গেছে', 'কাছে থাকো ছুঁয়ে থাকো', 'কখন আসবে তুমি' অন্যতম। এ যাবত তাঁর গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তালাত মাহমুদ, কলিম শরাফী, মাহমুদুন নবী, আঞ্জুমান আরা, আবদুল জব্বার, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লাসহ একালের জনপ্রিয় অনেক শিল্পী। তাঁর লেখা গানের দুইটি সংকলন বই রয়েছে, তোমারে লেগেছে এত যে ভাল (প্রকাশিত) এবং তৃষ্ণা আমার হারিয়ে গেছে ( সম্ভবত অপ্রকাশিত)। ১৯৬০ সাল থেকে চলচ্চিত্র, বেতার এবং টেলিভিশনের জন্য গীতিকার হিসেবে নিয়মিত গান লিখেছেন। তোমারে লেগেছে এত যে ভাল, আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন, কে স্মরণের প্রান্তরে, ওগো লাজুক লতা শুধু এই লগনে, এ কী চঞ্চলতায় মন ভরেছে, শহরবাসী শোনো তোমরা যাদের মানুষ বলো না, একটি কথা বলবো বলে ভাবি মনে মনে, রংধনু রঙে আঁকা আগুনে আবীর মাখা ইত্যাদি তাঁর রচিত চলচ্চিত্র গানগুলো আজকের যুগেও সমান জনপ্রিয়। এ ছাড়াও তিনি প্রেসক্লাবের সূচনা সংগীত রচয়িতা। ২০১৩ সাল থেকে 'প্রেসক্লাব আমাদের সেকেন্ড হোম/ যখন তখন আসি কিবা শুক্র সোম' গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে আসছে। এই গানের সুর করেছেন বিশিষ্ট সুরকার সুজেয় শ্যাম এবং কণ্ঠ দিয়েছেন- শুভ্রদেব, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, আফসানা রুনা, স্বপন ও অপু। প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার (১৯৫৪ সাল) প্রায় ৫৭ বছর পর তাঁর রচিত এই সূচনা সংগীত নতুন ইতিহাসও সৃষ্টি করেছে।

লেখক এবং কবি হিসেবেও তিনি ছিলেন দেশবরেণ্য এবং বিভিন্ন সামাজিক সম্বর্ধনা প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় "ডাকসু'র শ্রেষ্ঠ কবি" সনদ (১৯৫৯),'জাতীয় প্রেসক্লাব লেখক সম্মাননা ও পদক' (২০০৩ ও ২০০৯), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ প্রদত্ত 'শ্রেষ্ঠ লেখক পুরস্কার' (২০১০), লক্ষীপুর সাহিত্য সংসদ পদক ও সম্মাননা (২০১৭) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘকাল তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের মুখপত্র 'অগ্রদূত' এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ স্কাউটসের দ্বিতীয় সর্বচ্চ পদক প্রদান করা হয়। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ- কাছে থাকো ছুঁয়ে থাকো, উড়ন্ত রুমাল, চক্ষুহীন প্রজাপতি, সাতনরী প্রাণ, আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন, এক মুঠো ভালোবাসা, প্রেম শোনে না মানা, একটু তুমি একটু আমি (অপ্রকাশিত)। এই কাব্যগ্রন্থসমূহ ব্যতীত তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে। ছড়ার বই- শিশু তুমি যিশু, কন্যা তুমি অনন্যা, মজার ছড়া শিশুর পড়া। আত্মকাহিনীমূলক গদ্যগ্রন্থ- কোথায় চলেছি আমি, যেতে হবে কত দূর, কত দূর অচিনপুর

বিভিন্ন কবি ও লেখক রচিত গ্রন্থের পাঠ-প্রতিক্রিয়ামূলক গ্রন্থ হল শুভেচ্ছার শিউলিমালা। তাঁর সমকালীন বিগত কয়েক দশকের লেখক ও কবিদের গ্রন্থ সহ বিভিন্ন অনুবাদ গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা সম্বলিত এটি একটি অনুপ্রেরণামূলক আলোচনা গ্রন্থ, যা প্রায় বিরলও। এই গ্রন্থেই বিখ্যাত সুরকার রবীন ঘোষকে নিয়েও স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি। গ্রন্থটির শেষে রয়েছে ভাষা সৈনিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি আহমদ রফিক রচিত "একজন কে জি মোস্তফা জীবন মৃত্যুর বিস্ময় নিয়ে ভাবনা" শীর্ষক কে জি মোস্তফা রচিত কোথায় চলেছি আমি গ্রন্থ সম্পর্কে প্রাঞ্জল আলোচনা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত কবি ও গীতিকবি কে জি মোস্তফার সৃজনশীলতা সম্পর্কে সুধীজনদের আলোচনা সংকলন করে জ্যোতি প্রকাশন থেকে একজন কে জি মোস্তফা শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ পেয়ছে।

ব্যক্তিগত সময় কাটাতেন রবীন্দ্রনাথের গান ও লেখা পড়ে। রবীন্দ্রভাবনায় তিনি ছিলেন উদ্ভাসিত। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী বিয়োগের দুঃখ সইতে না সইতেই পেয়েছেন পুত্র হারানো শোকের মতন বড় বেদনার ধাক্কা। জীবনের দুঃখকে অতিক্রম করেও তিনি গান লিখতেন, বই পড়তেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দিতেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। আমি নিজেও তাঁর কাছে চিকিৎসা করে এজমা রোগের তাণ্ডব থেকে মুক্ত হয়েছি। একজন রোগী হিসেবে আমি তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির গুণমুগ্ধ। দেশ-বিদেশ জুড়ে রয়েছে তাঁর চিকিৎসাপ্রাপ্ত অসংখ্য রোগী। প্রেসক্লাবের মূল গেটের কাছেই ছিল তাঁর চিকিৎসালয়। বড় পুত্রের মৃত্যুর পর তিনি সেই চেম্বারের কাজ ছেড়ে দেন। কিন্তু নিজ বাসগৃহে হোমিওপ্যাথি চর্চা ধরে রেখেছিলেন শেষ নিঃশ্বাসের আগ পর্যন্ত।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন, কর্মনিষ্ঠা এবং সৃষ্টিশীলতা কে জি মোস্তফাকে স্মরণের প্রান্তরে ঐতিহাসিক করে তুলেছে। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর রচিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৮ সালে তিনি সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন দৈনিক ইত্তেহাদে এবং এর কিছুকালের মধ্যেই দৈনিক মজলুম পত্রিকায় সহসম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। দৈনিক মজলুম বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এই সময় থেকেই তিনি বেতার, টেলিভিশনে নিয়মিত গান রচনা করেতে শুরু করেন গীতিকবি হিসেবে। দৈনিক মজলুম বিলুপ্তির পর দীর্ঘদিন পর তাঁকে আবার সহ সম্পাদক হিসেবে ১৯৬৮ সালে সাপ্তাহিক জনতা পত্রিকায় দেখা যায়। এর ঠিক দুই বছর পরে তাঁকে আর এক ভূমিকায় পাওয়া যায়, ১৯৭০ সালে তিনি সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ দলের প্রবীণ নেতা কফিলউদ্দীন চৌধুরীর প্রেস সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। সেকালের পাকিস্তান সার্ভিস কমিশন থেকে প্রথম শ্রেণির বেতার অফিসার হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কারণে তিনি সেই চাকরীতে যোগদান করেননি। দেশ স্বাধীনের পর যথাক্রমে দৈনিক গণকণ্ঠ – চিফ রিপোর্টার, দৈনিক জনপদ- কূটনৈতিক রিপোর্টার, বিনোদন পত্রিকা 'মাসিক নূপুর' সম্পাদনা ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি সাংবাদিক হিসেবে বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারভুক্ত হন। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করে পরবর্তীতে সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সম্পাদক পদে উন্নীত হয়ে ১৯৯৬ সালে যুগ্মসচিব পদমর্যাদায় অবসর নেন। উক্ত সময়ের মধ্যে তিনি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের কিশোর পত্রিকা নবারুণ, সাহিত্য মাসিক পূর্বাচল, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সংবাদ, সচিত্র বাংলাদেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সম্পাদক হিসেবে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সময়ে তিনি অগ্রদূত-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এক সাথে বিচিত্র সৃজনশীল কাজের সাথে তিনি নিজেকে নিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে রেখেছন কোন ত্রুটি ছাড়াই।


আলোকচিত্র: প্রেসক্লাব মিডিয়া সেন্টারে বর্তমান লেখকের সাথে ইন্টার্ভিউর এক মুহূর্ত

আমরা দেখেছি, দেশের প্রথম সারির পদক প্রদানকারী সামরিক কি বেসামরিক সংস্থাগুলো অনেক সময় অনেককে উচ্চ মর্যাদার পুরস্কারে মনোনয়ন কিম্বা প্রদান করে কট্টর সমালোচনার তোপে পড়ে যায়। সম্প্রতি এমনও দেখা গেছে, পদক প্রদানকারী সংস্থা বাধ্য হয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে। দেশের এমন দৃশ্য দেখে প্রশ্ন জাগে, এই সংস্থাগুলোর বিবেক, বিচার এবং দৃষ্টিতে কি কখনোই কে জি মোস্তফার কোন কর্ম প্রশংসার স্থান পায়নি? চলচ্চিত্রে এত জনপ্রিয় গান রচনা সত্ত্বেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও পদক প্রাপ্তির যোগ্যতা কি আজও কে জি মোস্তফা অর্জন করতে পারেননি? কাব্যশক্তির কোন ঘাটতির জন্য বাংলা একাডেমি পদকদাতা কমিটি তাঁকে যোগ্য হিসেবে মনে করেননি? বাংলা ভাষাসাহিত্যের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে যিনি সংগীত ও সাহিত্য উভয় অঙ্গনেই নিষ্ঠা ও শ্রম দিয়ে অতিবাহিত করেছেন, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও তাঁকে নিয়ে রাষ্ট্রের অবহেলার নমুনা নিশ্চয়ই আর বলতে বাকী থাকে না। মাঝেমাঝে এমনও প্রশ্ন মনে জাগে, এসব পদক-পুরস্কারগুলোই কি যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে একজন কে জি মোস্তফার গুণ বিচারে? তবে এও সত্য, রাষ্ট্রের অবহেলা যেখানে প্রবল ও প্রতীয়মান, সেখানে বাঙালির স্মরণের প্রান্তরে একজন কে জি মোস্তফা দাঁড়িয়ে থাকবেন বহুমাত্রিক পরিচয়ে। কারণ তিনি একাধারে কবি, গীতিকবি, কলামিস্ট, আলোচক, লেখক ও সাংবাদিক সমাজের অনুপ্রেরণাদাতা। কেবল জনপ্রিয় গীতিকার কথিত শিরোপা দিয়ে তাঁকে আবদ্ধ করে রাখা দায়।

সাক্ষাৎ ও আলাপনের মাধ্যমে আমি যে কে জি মোস্তফাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেছে তিনি দুর্মদ, দুরন্ত। বার্ধক্যকে তিনি কখনোই প্রশ্রয় দেননি। পড়াশুনা, গান শোনা, গল্পে মশগুল থাকা, গান লেখায় নিবেদিত থাকা, নিজের সদ্যজাত গানের প্রতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা, চা খাওয়া–এসবে ছিলেন তারুণ্য ভরপুর। অহেতুক কারো সাথে কথা বলতেন না, আবার কেউ কিছু জানতে চাইলে তাকে ফিরিয়েও দিতেন না যদি সেই বিষয়ে তিনি অবগত থাকেন। কারো সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখা যায়নি তাঁকে। যা অপছন্দ তা তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। যার কাজকর্ম দেখে অনুপ্রেরণা দেওয়ার যোগ্য ভেবেছেন তাকে অনুপ্রাণিত করতে কুন্ঠিত হননি। আমার একটি অভিজ্ঞতা এখানে না বললেই নয়। সেই ঘটনাটি বলে বর্তমান লেখাটির সমাপ্তি টানবো।


আলোকচিত্র: কে জি মোস্তফার বাসায়

এ বছরই জানুয়ারি মাসে আমি তাঁকে একদিন কিছুটা নত স্বরে ইচ্ছে প্রকাশ করে বলি, "কে জি ভাই, আমি তো বেশ কয়েকজনের ইন্টার্ভিউ নিয়েছি, আপনি সেগুলো পড়ে প্রশংসাও করেছেন। আমি আপনারও একটি ইন্টার্ভিউ নিতে চাই"। সেদিন তিনি হ্যাঁ না কিছুই না বলে আমার দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বল তো বিদগ্ধ কোন পদ? বিদগ্ধ শব্দের মানে কি? তাঁর প্রশ্নটি শুনে আমি একটু কচলেই গেছিলাম মনে মনে। অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমাকে এমন প্রশ্ন করার মানে কী হতে পারে। যা হোক ভাবনার পাটি গুটিয়ে তাঁকে স্কুল শিক্ষার্থীর মতো করে উত্তরে বললাম, বিদগ্ধ শব্দটি বিশেষ্য পদ। যিনি নিপুণভাবে বিদ্বান কিংবা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন তাকে বিদগ্ধ বলা হয়"। উত্তর শুনে গম্ভীর মুখশ্রীতেই 'ভেরি গুড' বলে খুশি প্রকাশ করলেন ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে একটা আক্ষেপও প্রকাশ করলেন। আক্ষেপটি ছিল, কারো একটি কবিতা পড়ে তিনি তাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। কারণ সেই ব্যক্তি তার কবিতার লাইনে বিদগ্ধ শব্দটির ভুল প্রয়োগ করেছে। কবিতার স্তবক অনুযায়ী যার অর্থ দাঁড়ায় হাত বা শরীর অনলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে গেছে। ফলে পদ তো দুরকি বাত বিদগ্ধ শব্দটির অর্থ কি- এর উত্তর দিতে গিয়ে সেই কবিতা লেখক যে বিদগ্ধ শব্দের মানে জানেন না তাই প্রমাণ করেছিলেন, সেটাই স্বাভাবিক। কাহিনীটি এতই হাস্যকর ছিল যে হাসি থামানো মুশকিল। আর কে জি ভাই তো নিজেই হাসতে হাসতে তাঁর মুখশ্রীর সমস্ত গাম্ভীর্য গায়েব করে দিলেন নিমেষেই। কিন্তু হাসির রেশ কেটে যাওয়া মাত্রই আমার মনে মনে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এই ভেবে যে, তিনি আমার ইচ্ছেটাকে এড়িয়ে গেলেন কি না এই কাহিনীর দেওয়াল টেনে। তিনি অবশ্য বুঝতে পেরে মিটমিট করে হাসতে হাসতে রসিক সুরে বললেন, "তুমি কোন কাননের ফুল, আমি তো তোমার কাছে ইন্টার্ভিউ দেওয়ার জন্য বসেই আছি। রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা আছে না "এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুণে…" কথাগুলো বলে নিজে গুনগুন করলেন, আমাকেও গাইতে বললেন। এতটাই স্বভাব-রসিক ছিলেন তিনি। কথায় কথায় তিনি নিজের গানের যেমন বাণীর উদাহরণ দিতেন, রবীন্দ্রনাথেরও গানের উদাহরণ দিতেন। স্ত্রীর মৃত্যু, সন্তানের মৃত্যুর বেদনাভার তিনি লাঘব করে রাখতেন রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী আউড়ে। কোন কোন দিন দেখা হওয়ার আগেই বায়না রাখতেন রবীন্দ্রনাথের অমুক গানটা শুনিয়ো তো, 'কাল রাত থেকে গানটা মনের ভিতর খুব টানছে'।

১ জুলাই ১৯৩৭ সালে এই বহুমাত্রিক গুণী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয় নোয়াখালী জেলার একটি থানায়, বেগমগঞ্জের প্রসিদ্ধ খন্দকার বাড়িতে। কিন্তু ২০২২ সালের ৮ মে তাঁর পার্থিব তিরোধান ঘটেছে সমগ্র বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সংগীত জগত থেকে, বাংলাদেশের সাংবাদিক জগত থেকে, বাংলাদেশের সাহিত্য জগত থেকে এবং বাংলাদেশের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা জগত থেকে। তবুও তিনি ইতিহাসে সংগীত ও সাহিত্য শিল্পের ইতিহাসে স্মরণের প্রান্তরে এক অমর গীতিকবি। অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে শোকের ঢেউ তুলে তাঁর অন্তিমযাত্রা ৯ মে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাপ্ত হয়। এই গুণীর চিরবিদায়ে বাংলাদেশের শিল্পের জগত হারালো একজন সৎ ও যোগ্য সৃজনশীল ব্যক্তিকে। তাঁর পার্থিব তিরোধানে অনন্ত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।