ফার্নান্দো পেসোয়া, বৈষ্ণব বিধাতা ও সত্তার অসহ্য কারাগার

মাহীন হক
Published : 12 June 2022, 06:21 PM
Updated : 12 June 2022, 06:21 PM

নিজেকে চার টুকরো করে একটাকে যাই রেখে
ঘরের মধ্যে চারদেয়ালের যত্ন দিয়ে ঢেকে
তিনটে নিয়ে শহর ঘুরি, একটা হঠাৎ হারায়
নাম-না-জানা শহর-বাজার গেরস্থালির পাড়ায়

–শক্তি চট্টোপাধ্যায়


আমাদের পুরাতন বৈষ্ণবেরা বলতেন আদিতে বিধাতা ছিলেন একজন। তারপর তার নিঃসঙ্গ বোধ হলো, তার ইচ্ছে হলো নিজেকে অপর-রূপে উপভোগ করবেন। তখন তিনি নিজেকে ভাগ করে ছড়িয়ে দিলেন গোটা ব্রহ্মাণ্ডে। ছিলেন এক, হলেন বহু: 'একোহম বহুস্যাম'। তিনিই সেই পুত্র যে অন্ধকারে জড়িয়ে ধরে মা'কে, এবং তিনিই সেই মা যে মাথায় রাখে হাত। তিনি হত, তিনিই হন্তারক। তিনিই দৃশ্য, তিনিই দ্রষ্টা। পল সেলানের কবিতায় আছে, "রুটি ছিঁড়ে দিয়েছিলেন প্রভু/ প্রভুকে ছিঁড়েছে রুটি।" অনেকটা এরকমই যেন প্রভু নিজেকে রুটির মত ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিলেন পথে। এইভাবে বিধাতা নিজের বহু সত্তাকে ভাগ করে নিজেকে বহু ভিন্নরূপে আস্বাদন করেন। কবিতায়, আমরা জানি, বিষয়বস্তুকে দান করতে হয় অপর-রূপ, চেনা বস্তুকেও করে তুলতে হয় অচেনা। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশন। বৈষ্ণবদের বিধাতা তবে নিজের সাথে নিজের এই দূরত্ব তৈরি করার মধ্য দিয়ে ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশনের প্রথম দৃষ্টান্ত রাখেন।

কিন্তু যে বিলাসিতা বিধাতার, তা মানুষের সাজে না। মানুষের পক্ষে সম্ভব না নিজেরে এইরকম বহুধা ভেঙে আলাদা করে ফেলা। মানুষের সাথে ঘটে উলটো: তার ছোট্ট শরীরের ভেতর ঠাসাঠাসি করে ঢুকিয়ে দেয়া হয় অসংখ্য সত্তা। আদিম দেবতারা, তাদের নিষ্ঠুর পরিহাসে মানুষের রক্তে দিল সর্প ও নেউল, এবং তারা চিরকাল যুদ্ধ করে আমাদের শিরার ভেতরে। এবং তারচেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, নিজের ভেতর এত অসংখ্য সত্তা বয়ে বেড়ালেও, মানুষ যাপন করতে পারে কেবল একটাই জীবন। চিন্তা করুন, আপনাকে আপনার গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে কেবলমাত্র একটি শরীরে, একটিমাত্র ব্যক্তি হিসেবে। আপনি কখনোই জানবেন না কোনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের চাষার সাথে তার জমির ঘনিষ্ঠতা, কিংবা প্যারিসের কোনো ব্যালেরিনার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নির্ভরযোগ্যতা। আপনি শুধু জানবেন নিজেকে, তাও পুরোপুরি না। সবাই, সবাই বন্দি অস্তিত্বের এই অসহ্য কারাগারে।

সবাই…কেবল পেসোয়া বাদে। ফার্নান্দো পেসোয়া ঘৃণা করতেন একক ব্যক্তিত্বের এই ফাঁদ। তাই তিনি নিজের জন্য আবিষ্কার করে নিয়েছিলেন সত্তুরটিরও বেশি সত্তা। ছদ্মনামের ব্যাপারটা হয়তো আমরা জানি: যখন একজন লেখক বেনামে কিছু লেখেন। পেসোয়া এই ব্যাপারটাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন। বহু অসংখ্য নামে লিখেছেন তিনি কবিতা, সমালোচনা, অনুবাদ, ইত্যাদি। কিন্তু এদেরকে ছদ্মনাম বলতে নারাজ ছিলেন তিনি। ছদ্মনামের ক্ষেত্রে যেই একটি কথা আমরা উহ্যভাবে স্বীকার করে নেই তা হলো: এখানে নামটা ছদ্মরূপ, এর পেছনে একজন আসল ব্যক্তি আছেন। কিন্তু এই 'আসল ব্যক্তির' ধারণাটাই পেসোয়ার কাছে মৌলবাদ মনে হয়েছে চিরকাল, তার লক্ষ্যই ছিল "abolition of the dogma of personality।" পেসোয়ার মতে, কবিকে হতে হবে একইসাথে বহুজন। কেবল 'একজন' থেকে যাওয়া কবির জন্য মর্মান্তিক। তাই নিজেকে তাসের মত বেটে পেসোয়া ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গোলটেবিল ঘিরে। এবং এদের কাউকে ছদ্মনাম বলতে নারাজ ছিলেন তিনি। ছদ্মনাম, ইংরেজিতে যাকে আমরা Pseudonym বলে চিনি, তাতে বিশ্বাস ছিল না পেসোয়ার। তিনি বরং ব্যবহার করতেন Heteronym শব্দটা, যার বাংলা হয়তো করা চলে অপর-নাম। অর্থাৎ এখানে প্রত্যেকটা নাম সমান বাস্তব; প্রত্যেকে প্রত্যেকের অপর, কিন্তু একজনও মূল না। এরকম সত্তুরটারও বেশি অপর-নামে লিখেছেন তিনি, প্রত্যেকটি নামকে দান করেছেন আলাদা ব্যক্তিত্ব, পেশা, লেখনশৈলী, জন্মস্থান ইত্যাদি। তার সবচেয়ে বিখ্যাত তিনজন অপর-সত্ত্বা হলেন যথাক্রমে আলবের্তো কায়েরো, রিকার্দো রেইস এবং আলভেরো দে ক্যাম্পোস।

আলবের্তো কায়েরোর জন্ম ১৬ই এপ্রিল, ১৮৮৯, রাশি মেষ। থাকতেন গ্রামে, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, এবং প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছিলেন খালি চোখে, কোনো দর্শন ছাড়া। তার মৃত্যু হয় ২৬ বছর বয়সে, যক্ষ্মারোগে।
ক্যাম্পোসের জন্ম ১৮৯০তে, পড়াশুনা করেছেন গ্ল্যাসগোতে নৌ-প্রকৌশল নিয়ে। কিছুকাল ইংল্যান্ডে কাটিয়ে এসে লিসবনে থিতু হন। ক্যাম্পোস ছিল পেসোয়ার সবচেয়ে পাব্লিক অপর-নাম। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধে প্রায়ই দেখা যেত তার নাম।
রিকার্দো রেইসের জন্ম ১৮৮৭ সালে ওপোর্টোতে। পরে ওখানকার রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ব্রাজিলে পালান এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।

শুধু এই না। পেসোয়ার অপর-সত্তাদের ভেতর রয়েছে একজন জ্যোতির্বিদ, একজন দার্শনিক, একজন অভিজাত যে আত্মহত্যা করে, একটা কুঁজো মেয়ে যার মৃত্যু হয় যক্ষ্মারোগে, এবং আরো অগণিত। বার্নার্ডো সোয়ারেস নামক এক বইয়ের দোকানদারের নামে প্রায় পাঁচশ পেজের একটা আত্মজীবনী/দিনলিপিও লিখে ফেলেন তিনি। এমন বিশদ পরিচিতি ও জীবনী দেখার পর বিশ্বাস হবে রক্তে-মাংসে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই, এদের জন্ম লিসবনের এক পেশাদার অনুবাদকের মাথায়?

সম্ভবত হুইটম্যানের প্রভাব ছিল পেসোয়ার উপরে। হুইটম্যানের Song of Myself-এ আছে ব্রহ্মাণ্ডের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার কথা। আর পেসোয়া তার উলটোপথে গিয়ে বললেন, "বহু হও—ব্রহ্মাণ্ডের মত।" পেসোয়া যেই সত্য টের পেয়েছিলেন তা হলো, মানুষের আত্মার ভেতরেও কোনো ঐক্য নেই। একজন মানুষের ভেতর বাস করে বহুজন। তাই পেসোয়া নিজের জন্য আবিষ্কার করে নিয়েছিলেন সেই প্রিজমের কাচ, যার মধ্য দিয়ে সত্তার একরঙা প্রবাহ ভেঙে আলাদা হয়ে যায় অসংখ্য বর্ণচ্ছটায়।

The Book of Disquiet-এর এক জায়গায় লিখেছেন তিনি, "নিজের ভেতরেই আমি অসংখ্য ব্যক্তিত্ব তৈরি করে নিয়েছি। আমার প্রতিটি স্বপ্ন, তা দেখার সাথে সাথেই তারা একেকটা ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যায়, এবং তখন সেটা সেই ব্যক্তিরই স্বপ্ন হয়ে যায়, আমার না। সৃষ্টির তাগিদে আমি নিজেকে ধ্বংস করেছি…আমি সেই ফাঁকা মঞ্চ যেখানে একের পর এক অভিনেতা নিজেদের অংশ অভিনয় করে চলে যায়।" রিচার্ড জেনিথ কর্তৃক অনূদিত A Little Larger Than The Entire Universe গ্রন্থ থেকে নিচে তার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো।- অনুবাদক


বাতাস, যেন দেবতার আজ্ঞাবিহীন,
সতর্ক সংকোচে
পরশ বুলিয়ে ফেরে সবুজের মাঠে,
সূর্যও অপরূপ ঝলমল হয়ে আছে।

এখন, এইখানে,
যেটুকু সূর্য আছে, যেটুকু বাতাস;
তার বেশি আর কিছু যেন
আমরা না চাই, লিডিয়া।


জীবনের কাছ থেকে আমি খুব অল্পই চেয়েছিলাম, তবুও আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে খালি হাতে। কাছাকাছি কোনো মাঠ, তাতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো, দু'এক টুকরো রুটি এবং তার সাথে একটু প্রশান্তি। চেয়েছি নিজেরই সত্তার জ্ঞানে দলিত না হতে, আর চেয়েছি যেন না হই কারো দাবি-দাওয়ার দাসে পরিণত, আর কেউও যেন না হয় আমার। চেয়েছি এইটুকুই – তবুও আমাকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে খালি হাতে, ঠিক যেমন মাঝে মাঝে কোনো ভিখিরিকে ফিরিয়ে দেই আমরা; তা এইজন্য নয় যে আমরা নিষ্ঠুর, বরং স্রেফ এইজন্য যে আমাদের পকেট থেকে খুচরো পয়সা খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করছে না।


আমি ভালোবাসি অ্যাডোনিসের বাগানের গোলাপগুলো।
হ্যাঁ, লিডিয়া, আমি ওই ডানাওয়ালা গোলাপদের ভালোবাসি,
যেদিন জন্ম, সেদিনই মৃত্যু তাদের।
অনন্ত আলোই তাদের ভাগ্যে জোটে,
যেহেতু তারা সূর্যোদয়ের আগে ফোটে
এবং ঝরে পড়ে
সূর্যদেবের ভ্রমণ শেষ হবার আগেই।

আমাদের জীবনও হোক একদিনের, লিডিয়া!
আমরা ভুলে যাই চলো রাতের অস্তিত্ব।


লিখতে বসা মানে নিজেরে হারানো, কারণ সবই হারায়ে যায়। তবে আমি নিজেরে হারাই কোনো আনন্দ ছাড়া – যেমন আনন্দে ধরো নদীরা হারায় সাগরে। আমি জোয়ারের তোড়ে তটে পড়ে থাকা এক টুকরা বিচ্ছিন্ন খাদ, যে কোনোদিন মিলবে না সাগরের সাথে গিয়ে। ধীরে ধীরে হারায়ে যাবে বালুর গভীরে।


হায়, আমার জীবনটা যদি ভোরের রাস্তায়
ক্যাঁচক্যাঁচ করে চলা একটা গরুর গাড়ি হতো!
খুব ভোরে, সেই একই রাস্তায় ফিরে যাওয়া
যেখান থেকে এসেছিলো সন্ধ্যায়…

তাহলে হয়তো আমার কোনো আশা থাকতো না,
থাকতো শুধু দুই জোড়া চাকা…
আমার বার্ধক্যে থাকতো না কোনো কুঁচকানো চামড়া,
ধবধবে সাদা চুল…
আর যখন আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতো, আমার চাকা খুলে নিয়ে
উলটো করে ছুঁড়ে ফেলা হতো কোনো আস্তাকুঁড়ে, ভীষণ ভাঙাচোরা।

অথবা আমারে ভেঙে গড়া হতো নতুন কিছু
আর আমি জানতামও না আমারে কী বানানো হয়েছে…
কিন্তু আমি তো কোনো গরুর গাড়ি নই, আমি আলাদা।
কিন্তু আমি ঠিক কীরকম আলাদা, তা কেউ বলে না আমারে।