সিমিন হোসেন রিমি’র আলোকচিত্রে ‘প্রকৃতি’ দর্শন

অলাত এহ্সান
Published : 24 Dec 2015, 12:54 PM
Updated : 24 Dec 2015, 12:54 PM

শিল্প-সাহিত্যের অপার বিস্ময়ের জায়গা হচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতি। এই দুইয়ের মধ্যে ডুব দিয়েই শিল্পী-সাহিত্যিক তুলে আনে মূল্যবান মনিমুক্তা। রাজধানীর গ্যালারি টুয়েন্টি ওয়ান-এ চলছে সিমিন হোসেন রিমি একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। শিরোনাম 'প্রকৃতি'। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত ১১৪ টি আলোকচিত্রে প্রকৃতির নিত্যদিনের সৌন্দর্যের অন্বেষণ করেছেন চিত্রী।

সিমিন হোসেন রিমি ইতোমধ্যে লেখক ও সমাজকর্মী হিসেবে খ্যাত। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ডাইরি, চিঠিপত্র সম্পাদনা, গবেষণা ও তাঁকে নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখার মাধ্যমে আমাদেরকে অনেক অজানা সত্য ও সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তবে আলোচিত্রী হিসেবে এবারই প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মতোই তার আলোকচিত্রের হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। এখানেও চিন্তার উন্মীলন তার ঘটেছে দেখায়। তার ছবির দিকে তাকালেই তা পরিস্কার বুঝা যায়।

তার আলোকচিত্রের বিষয়বস্তু হঠাৎ চমকে দেয়া কিছু না। নিত্যদিনের নিত্য সভা। আকাশ, সাগর, মেঘ, প্রকৃতি, ফুল, পাখি, সূর্যাস্ত ইত্যাদি। এই নিত্যবস্তু প্রতিনিয়ত রূপ বদলায়। একই আকাশের দিকে তাকিয়ে যেমন ক্ষণিক পরপরই নতুন রূপ দেখা যায়, সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়েও প্রতিটি ঢেউকে নতুন করে দেখা যায়, তেমনি প্রতিদিনের সূর্যাস্তকেও। প্রদর্শনীর ছবিগুলোর মধ্যে আকাশ, সূর্যাস্ত ও সাগর পাড়ের দৃশ্যই বেশি। এই ছবিগুলো আর সার্বজনীনও। পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কোনো সময়ে এই দৃশ্যগুলো উপভোগ করা যায়। এর মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে মানুষের নিয়ত দুঃখ-কষ্ট, ভাবনা ও উদাসীনতা।

ছবির আরেক একটি বিশেষত্ব মানুষের অনুপস্থিতি। ফলে প্রকৃতিকে প্রাকৃতিকভাবেই উপভোগ করা যায়। একই বিষয়ের একাধিক ছবি বিষয়বস্তুতে প্রবেশেও সাহায্য করে। ক্যামেরা সঞ্চালনায় কোনো দক্ষ হাতের কারিগরি না এঁটে বরং ছবিগুলোকে দারুন উপভোগ্য করে রেখেছেন। এসব মিলেই প্রকৃতি।

সিমিন হোসেন রিমি'র ভাষায়, 'প্রকৃতিতে সুন্দর যা কিছু অজান্তেই আমরা বলি ছবির মত। প্রকৃতি আসলে জীবন্ত ক্যানভাস। আমরা শুধু ক্যামেরায় ধরে রাখি কিছু মুহূর্তকে। বইপড়ার মতই আনন্দ আমার প্রকৃতির সাথে এই কথোপকথনে।'

সাগরপাড়ের আলোকচিত্রগুলোয় ধরা পড়েছে শীলা পাথরে আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউয়ের ব্যঞ্জনা। একটু তাকালেই দেখা যাবে জলের বুকে ঢেউ বুনে ওঠা, আছড়ে পড়ার আগমুহূর্ত, সাপের ফলার মতো তেড়ে ওঠা জলের বিস্তার, আবার ফনা নামিয়ে নতমুখী জলের পিছিয়ে যাওয়া। কখনো আছড়ে পড়া ঢেউয়ে ছলকে ওঠা জল একমুঠো কাশফুলের মতো বিভ্রম জায়গায়। অথচ সেখানে কাশবন থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং ছুটির ঘণ্টায় শিশুদের হুড়াহুড়ির মতো পাথর ঘেরা সৈকতে দেখা যায় আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গোপন উচ্ছ্বাস।


ছবির বিষয়বস্তুর আরেকটি দিক হচ্ছে আকাশের দৃশ্যধারণ। খণ্ড খণ্ড মেঘের বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতি নেয়া শৈশব পেরুনো মনে আকাশের দৃশ্যগুলো মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় রূপেই ধরা দেয়। সূর্যাস্তের দৃশ্য নিয়ে তার সিরিজ কাজগুলো রং ও বৈচিত্র্যে অনন্য। হলুদ, লাল, মেরুন, শাদা মেঘ কখনো কখনো উঁকি দিয়েছে তার লেন্সের ক্যানভাসে। প্রখর রৌদ্রে হালকা স্কেচের মতো মেঘের ভেসে বেড়ানো, কিংবা উড্ডীন বিমান বা চিলের বিচরণ পুরো ছবিকেই বাঙ্গময় করে তোলে। মেঘের অনেক রংয়ের মতো মানুষের জীবনেরও নানা সময়ে নানান রং বদলায়, সিমিন হোসেন রিমির আলোচিত্রে তাই আছে পুনরুল্লেখ। বলা যায়, হাজার বছর ধরে অজস্র মানুষের দেখা আকাশের রহস্য উদঘাটনের চেষ্ঠা করেছেন তিনি।
তার অন্যান্য ছবিরগুলোর মধ্যে আছে– পাথরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা গাঙ্গচিলের অপেক্ষা আর পালক সাজানোর কসরৎ। ব্যালকনিতে বসা প্যারোটের ঘাড় কাঁত করা কৌতুহলী চাহনী। সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে সবুজ ভূমি ও পাহাড়, পাহাড় ডিঙিয়ে আসা মেঘ।
ফুলের দৃশ্যগুলো চিত্রীর ক্যামেরায় এসেছে নানাভাবে। কৃষ্ণচূড়া ফুল, ফুলে ছাওয়া সজনের ডাল, একটা ম্যাগনোলিয়া, অর্ধেকটা রোদে-অর্ধেক ছায়ায় কচুফুলে ছাওয়া ডোবার সৌন্দর্য। কিংবা একটা পিঠ বাঁকানো গাছের পিঠে গজিয়ে ওঠা নতুন কুশি নিরেট ফুলের সৌন্দর্য নিয়েই ভাস্বর। হেমন্তে মেহগনি বনে মেরুনরঙা মরা পাতায় ছাওয়া গাছ, আধমরা হলুদ, সবুজ পাতা কিংবা পাতা ঝড়িয়ে উদ্বাহু গাছের সৌন্দর্য যে উপভোগ্য তা সিমিন হোসেনের একটা ছবি থেকে পাওয়া যায়।

প্রদর্শনীর অধিকাংশ ছবিই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর বা ভ্রমণকালে তোলা। তবে দেশের মেঠো ও মেঠো সৌন্দর্যও তার ক্যামেরা থেকে বাদ যায়নি। জলমগ্ন মাঠের সামনে দু'টি তালগাছ, পুকুর ও তার পাড়ের ঝোপের আড়ে সুর্যাস্ত, মেঘলা দিনে জলডোবা ফসলি মাঠ ইত্যাদি। খণ্ড খণ্ড দৃশ্যও দেখা যায়–আম গাছের কোটর, সজনে ও কদমের ডালে কাকের সংসার, কাঠালে পূর্ণ গাছ, চাম্বল গাছের মাথার ওপর দিয়ে নীল আকাশে সাদামেঘের বিচরণ ইত্যাদি। বেড় জাল, টইয়া জাল দিয়ে মাছ ধরা কিংবা রোদে শুকাতে দেয়া কর্মহীন ভেসাল ও ধর্মজাল আমাদের 'মাছে ভাতে বাঙালী' প্রবাদটাই মনে করিয়ে দেয়।

প্রকৃতির অনস্বীকার্য অংশের মতো পাখিও তার ছবির অন্যতম বিষয়বস্তু। সরালি, গাঙচিল, চিলের পাশাপাশি লাল শাপলা ফোঁটা পুকুরের ঘোলাজলে তিনটি হাঁসের সাঁতারের দৃশ্যও মনোরম।
তার ছবির ফ্রেমে যেমন জোর-জবরদস্তি নেই, তেমনি একটা খোলা মুখ সব সময় দর্শক ও চিত্রালোচকদের অনুভূতি ও বক্তব্য প্রকাশের বিশাল স্পেস করে দেয়। প্রকৃতি আমাদের অজস্র চিত্র দেয়, কিন্তু সেখানে থেকে ইমেজকে বেছে নিতে হয়। সিমিন হোসেন রিমির ছবিগুলো তাই নানা অর্থেরই প্রতীক বহন করে। তার কোনো ছবির আলাদা আলাদা শিরোনাম নেই।

রাজধানীর ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠের ঠিক উল্টো পাশেই অবস্থিত গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানের [৭৫১, সাত মসজিদ রোড (১১ তলা), ঢাকাÑ১২০৫।] ১৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই আলোকচিত্র চলবে আগামী ২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
চিত্রীর মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জন্ম-মৃত্যুদিনের (জন্ম: ২০ ডিসেম্বর ও মৃত্যু: ২৪ ডিসেম্বর) পূর্বে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনী তাঁর পূণ্য স্মৃতির প্রতিই নিবেদন করা হয়েছে। এমনকি এই প্রদর্শনীর ছবি বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া অর্থে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ ফাউন্ডেশনের একটি জাদুঘর করবার কাজে ব্যবহার করবেন এই চিত্রী। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উন্মুক্ত আছে এই প্রদর্শনী দর্শকদের জন্য।