মহীউদ্দীনের অগ্রন্থিত আত্মজৈবনিক রচনা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 18 June 2015, 06:08 PM
Updated : 18 June 2015, 06:08 PM

কিছুদিন আগে দিল্লীতে দৈবের বশে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের আদিপর্বের প্রধান লেখকদের একজন কথাসাহিত্যিক অনুবাদক মহীউদ্দীন চৌধুরীর অগ্রন্থিত এই লেখাটি নজরে আসে। হাফিংটন পোস্ট (ভারত)-এর বার্তা সম্পাদক ইন্দ্রানি বসু, তার বাবা লেখক অধ্যাপক দিলীপ কুমার বসু এবং লেখিকা ও শিক্ষিকা নন্দিতা বসুর ব্যক্তিগত পাঠাগার দেখার সুযোগ করে না দিলে এই আবিষ্কার আদৌ সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। তাদের উদার আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলাম লোভনীয় পাঠাগারের ঘুমিয়ে পড়া বইগুলোর দিকে। নিতান্ত কৌতূহলবশত–পুরোনো বইয়ের প্রতি যা আমার সদাজাগ্রত–শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শ্রীপরেশ সাহার সম্পাদনায় কথাশিল্পী শীর্ষক ঘুমের অভিশাপে নিথর রাজকুমারীর গায়ে সোনারকাঠি ও রূপোরকাঠিসদৃশ প্রেমপ্রবণ আমার আঙুলের স্পর্শ মাত্র সে চোখ মেলে তাকালো। আমিও চোখ রাখলাম বইটির বারান্দায় (সূচীপত্রে)। দেখলাম সেখানে বসে অাছেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের লেখক আবুল ফজল, আবু ইসহাক, মহীউদ্দীন চৌধুরী, মবিন উদদিন আহমদ এবং শামসুদদীন আবুল কালাম। এই গ্রন্থের জন্য লিখিত আত্মজৈবনিক এই লেখাগুলো এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানা যায় না। আমরা এই পর্বে লেখক মহীউদ্দীন চৌধুরীর লেখাটি প্রকাশ করছি। স্মরতব্য যে মহীউদ্দীন চৌধুরী শেষের দিকে কেবল মহীউদ্দীন নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
শ্রীশৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শ্রীপরেশ সাহা সম্পাদিত কথাশিল্পী গ্রন্থ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য তথ্য হচ্ছে এই যে এটি প্রকাশ করেছিল কলকাতার ভারতী লাইব্রেরী, প্রকাশক ছিলেন জে. সি. সাহা রায়। কলকাতার লোয়ার সাকুর্লার রোডস্থ শতাব্দী প্রেস প্রাইভেট লি:-এর পক্ষে শ্রীমুরারিমোহন কুমারের তত্ত্বাবধানে মুদ্রিত হয়েছিল। এর প্রথম প্রকাশকাল ছিল পৌষ ১৩৬৪, আজ থেকে প্রায় সাতান্ন বছর আগে। ১৭০ পৃষ্ঠার সুমুদ্রিত এই বইটির দাম ছিল পাঁচ টাকা।


একেবারে মোটাদাগে লেখক মহীউদ্দীন (১৯০৬-১৯৭৫) সম্পর্কে আমাদের মনে পড়বে যে তিনি জন্মেছিলেন ঢাকার দোহারে। গ্রামের পাঠশালায় দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। আট বছর বয়সে পিতার মৃত্যু ঘটলে জীবিকা অর্জনের জন্য কলকাতায় চলে যান (১৯১৪)। কর্মজীবন শুরু হয় মির্জাপুরের এক পুস্তক বাঁধাই কারখানায়। কম্পোজ ও প্রুফ রিডিং শিখে বিভিন্ন প্রেসে কাজ করেছেন। নিজ চেষ্টায় ইংরেজি ও বাংলায় দক্ষতা অর্জন করেন। দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। অসহযোগ আন্দোলনেও যোগদান করেছিলেন তিনি। ১৯২৫-এ প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফফর আহমদের সান্নিধ্যে এসে সাম্যবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯২৮-এ খিদিরপুর জাহাজি শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগদান। মাসিক 'জাহাজি' (১৯২৮) ও সাপ্তাহিক 'নাবিক' (১৯৩১) পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৪ আগস্ট ১৯৪৭) পর কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকায় আগমন এবং স্থায়ীভাবে বাস। মাসিক 'অন্ন চাই, আলো চাই' (১৯৪৯) পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা। 'ইস্ট পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবারের' রিসার্চ অফিসার (১৯৫৪-১৯৫৭) কাজ করেন। সাম্যবাদ কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে:

কবিতাগ্রন্থ

পথের গান (১৯৩৬), স্বপ্ন সংঘাত যুদ্ধ বিপ্লব (১৯৪২), অন্ধকারে ষড়যন্ত্র (১৯৪২), এলো বিপ্লব (১৯৪২), দিগন্তের পথে একা (১৯৬০), গরীবের পাঁচালী (১৯৬২)।

উপন্যাস
নূতন সূর্য (১৯৪৬) আলোর পিপাসা, দুর্ভিক্ষ।

গল্প-সংকলন
নিরুদ্দেশের যাত্রী (১৯৫৩) ।

নাটক

রক্তাক্ত পৃথিবী (১৯৪২) ।

অনূদিত গ্রন্থ
প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস (১৯৭০), জরথুস্ত্র বলেন (১৯৭২), আধুনিক জগৎ মানবজ্ঞান (১৯৭৩), বিবর্তন (১৯৭৫)।

ইংরেজি কবিতাগ্রন্থ
Under The Shadow of an Anarchic World (1942) (1965), The Word The Poem of the Padma and the Prose of the Thems।

তাঁর 'কামিনীকাঞ্চন' উপন্যাস এবং 'অন্ন চাই আলো চাই' পত্রিকা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।

…………………………………………

মহীউদ্দীন চৌধুরী

আমার জন্ম ঢাকা জেলার খৈড়াখালপাড় গ্রামে ১৯০৬ সালের জানুয়ারী মাসে। বাবার নাম মনির উদ্দীন চৌধুরী। তিনি আমার নাম রেখে ছিলেন বান্দা-এ রসুল আলা মহীউদ্দীন। এই বৃহৎ নামটি আমি স্রেফ মহীউদ্দীন বলে চালিয়ে আসছি।

পদ্মা থেকে এক মাইল উত্তরে নির্জন আমবাগান ঘেরা এক গৃহে সুরু হয়েছিল আমার জীবন। সাত বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে আশ্রয় করেছিলাম বিধবা মায়ের বুক। জামাকাপড়ের অভাবে শৈশবটা আমার একরকম লেংটাই কেটে গেছে। কতদিন খিদেয় পেটের ভেতরটা চোকু চোকু করে উঠেছে। মায়ের দিকে তাকিয়েছি। মায়ের চোখে জল। কিছু বলিনি, বলতে পারিনি। এই অবস্থার মধ্যেই আমার সামান্য অক্ষর পরিচয় হয়–গ্রাম্য পাঠশালায় ও আমার এক ইংরেজি শিক্ষিত আত্মীয়ের কাছে।

সেই শৈশবকালেই মাঝে মাঝে বেরিয়েছি আড়িয়ল বিল ও পদ্মাতীরের পথে। পরিচয় হয়েছে পশু, পাখী, পানির মাছ ও সমাজের বিচিত্র অব নরনারীর সঙ্গে। অর্থ দিয়ে পূর্ণ হয়নি যে অভাব সেই সব অভাবকে পূর্ণ করেছি কল্পনা দিয়ে। এক একটি বাস্তব ঘটনা দেখেছি আর তার উপর রচনা করেছি অপূর্ব কল্পনার জগৎ।

ন' দশ বছর বয়সে কলকাতায় চলে গেলাম কোন একটা শিল্পের কাজ শেখবার জন্যে। কাজের কাজ কিছুই শিক্ষা হলো না, শিখলাম শুধু পথে ঘোরা, বই পড়া আর আজগুবি কল্পনা করা। কিন্তু কল্পনায় তো পেট ভরে না, পেট তো কথা শোনে না, চোঁ চোঁ করে। কাজেই গ্রহণ করলাম যে কোন রকম শ্রমের কাজ ক'রে পেট চালিয়ে নেওয়ার সহজ ধারা।

কিন্তু পড়াশোনা আমার বন্ধ হলো না। প্রথম– রামমোহন লাইব্রেরী ও পরে সরস্বতী লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়তাম। এ দু'টি লাইব্রেরীর মধ্যে কেবলমাত্র সরস্বতী লাইব্রেরীতে বাঙালী মুসলমান লেখকের লেখা একখানি গল্পের বই দেখেছিলাম।

তখন থেকেই কিছু কিছু আমি লিখি। 'প্রবাসী' 'ভারতবর্ষ' প্রভৃতি কাগজে পাঠাই। লেখা ফেরত আসে। এর পরে 'সওগাত'এ আমার গল্প ও 'মাসিক মোহাম্মদী'তে আমার উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তখন কোন প্রকাশক আমার লেখা প্রকাশের দায়িত্ব না নেওয়ায় উপন্যাসখানি তখন আর প্রকাশিত হয় না।

আমার প্রথম উপন্যাস 'মহামানবের মহাজাগরণ' প্রকাশিত হয় ১৩৪২ সালের বৈশাখ মাসে। এর পরে 'আলোর পিপাসা' 'দুর্ভিক্ষ',' নতুন সুর্য', 'শাদী মোবারক'; 'নির্যাতিত মানবতার নামে', 'রক্তাক্ত পৃথিবী', 'শিখির স্বপ্ন' প্রভৃতি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।

তরুণ বয়েস থেকে প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন ও পরবর্তীকালে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ রেখে ও সহযোগিতা করে চলতে হয়েছে। এই সব আন্দোলনে থেকে ভালো মন্দে মেশানো অনেক অাশ্চর্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। শ্রমিক নর-নারীর অভাবের সংসার, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকারী, পুলিশ স্পাই, বিপুল অর্থশালী ধনিক, দুরস্ত সাহসী বিপ্লবী সাম্যবাদী–এমনি অসংখ্য জীবনের ও মানুষের চেহারা দেখবার ও জানবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার উপন্যাসে তাদেরই ভিড়।

দেশ বিভাগের পর জন্মভুমি পুর্ব বাঙলায় এসে বাস করছি। এখানে এসে 'অন্ন চাই, আলো চাই' নামে একখানি মাসিক পত্রিকা বের করেছিলাম। কিন্তু সরকারী চাপে তার কণ্ঠরোধ হয়েছে। কাগজখানি উঠে গেছে।

আজ লিখছি, লিখেই চলেছি। আমি মনে করি দেশ ও দশের প্রতি লেখকের একটা দায়িত্ব আছে। শুধু লেখার জন্যেই লেখা নয়, শিল্পের জন্যেই শিল্প নয়, লেখা শিল্প দুই-ই মানুষের জন্যে। সেই মানুষের কথা যদি লিখে যেতে পারি, মানুষের কান্না-হাসির ইতিকথা যদি আমার লেখায় রূপ পায়, তাহলে আমার লেখার সাফল্য সম্পর্কে আশা রাখতে পারবো– নইলে নয়।
প্রকাশিত গ্রন্থ: মহামানবের মহাজাগরণ, আলোর পিপাসা, দুর্ভিক্ষ নতুন সূর্য, শাদী মোবারক, নির্যাতিত মানবতার নামে প্রভৃতি।