শ্রীলংকার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ চেখভ দেশটিকে স্বর্গ বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, শ্রীলংকা থেকে তিনি তিনটি বেজী (mongoose) রাশিয়া নিয়ে যান
Published : 09 Jan 2025, 03:52 PM
১.
মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) আগেই আন্তন চেখভও (২৯শে জানুয়ারি ১৯৬০ - ১৫ই জুলাই ১৯০৪) বলতে পারতেন ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোকে’ রুশ মঞ্চে, ‘নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়,’ এবং সেটা তাঁর জীবনের গোড়ার দিকেই। কথাটা এই কারণে বলা যে প্রথমত, আন্তন চেখভ নামটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মনের ভেতর সাধারণত একজন অসামান্য ছোট গল্পকারের ছবি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু এটা একটা ভুল ধারণা যে চেখভ ছিলেন মূলত একজন ছোট গল্প লেখক যিনি তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শেষ দিকে নাটক রচনায় মন দেন এবং তা নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। দ্বিতীয়ত, তরুণ বয়সেই চেখভ নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু সে-সময়ের রুশ থিয়েটারে দুর্বল অভিনয়, প্রাণহীন নির্দেশনা, গতানুগতিক মোলোড্রামা এবং চেষ্টাকৃত বাস্তবতার প্রতি আনুগত্য, ইত্যাদির রমরমা দেখে তিনি এ-জগৎ সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এই পরিবেশ একজন কল্পনাপ্রবণ নাট্যকারের জন্য নয়, এবং এখানে কাজ করে রুটি-রুজির সংস্থান হবে না। অথচ উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকতেই তিনি লিখেছিলেন একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের একটি নাটক—পিতৃহীন -- (যদিও সেটা হারিয়ে গেছে বা তিনি নষ্ট করে ফেলেছিলেন)। এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র থাকাকালিন চেখভ চার অঙ্কের অতি দীর্ঘ একটি নাটক রচনা করেছিলেন -- তাঁর মৃত্যুর ঊনিশ বছর পর ১৯২৩ সালে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। ইংরেজিতে সেটা দ্যাট ওয়ার্থলেস ফেলো প্লাতোনভ নামে পরিচিত। নাটকটি তেমন রসোত্তীর্ণ না হলেও, পরবর্তী সময়ে তাঁর নাটকে যেসব বিষয়বস্তু, চরিত্র ইত্যাদির আনোগোনা দেখা যাবে, তার সবই সেখানে ছিল। এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ার গোড়ার দিকে তিনি অন্তত আরো একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক এবং একটি একাঙ্কিকা রচনা করেছিলেন। কিন্তু সে দুটোর-ও কোনো হদিস পাওয়া যায় না।
২.
তাঁর শৈশব ছিল বড্ড নিষ্করুণ; ছাত্রাবস্থাতেই ঘাড়ে এসে পড়েছিল পরিবারের গুরুতর দায়ভার; মধ্য কুড়িতেই আক্রান্ত হলেন এমন এক রোগে যা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে জীবন তাঁর দীর্ঘ হচ্ছে না। জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের এক বছর আগে, ১৮৬০ সালে, যে বছর চেক সঙ্গীত শিল্পী গুস্তাভ মাহলার-ও জন্মগ্রহণ করেন), আজোভ সাগরের তীরে দক্ষিণ রাশিয়ার একটি নোংরা ছোট্ট সমুদ্রবন্দর তাগানরগে। দীর্ঘ জীবন তিনি পাননি। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো সে-জীবন মধুরও ছিল না, সহজও না । তাঁর মাত্র ৪৪ বছরের এই ছোট্ট জীবনে তিনি এন্তার মানেুষের সান্নিধ্যে এসছিলেন, অযুত সংযোগ তৈরি করেছিলেন। যদিও, হয়ত এটাই স্বাভাবিক যে, এদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই তাঁর প্রকৃত বন্ধু এবং সুহৃদ ছিলেন) ।তাঁর জীবনীকার ডোনাল্ড রেফীল্ডের ভাষায়: ‘শিক্ষক, চিকিৎসক, ধনকুবের, বণিক, কৃষক, ভবঘুরে, ভাড়াটে লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, বিদ্বজ্জন, ভূস্বামী, সরকারী কর্মকর্তা, আমলা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, পাদ্রী, সন্ন্যাসী, নানান দপ্তরের কর্মচারী-কর্মকর্তা, পাদ্রী, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, বেশ্যা, বিদেশী লোকজন -- অসংখ্য কক্ষপথে বিচরণ করেছেন চেখভ। প্রতিটি শ্রেণী এবং অবস্থার মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর, কেবল অভিজাতবর্গীয় এবং রাজদরবারের লোকজন ছাড়া); অবলোকন করেছিলেন প্রাক-বিপ্লব রাশিয়ার নির্জীব দশা – বিশেষ যে-ক’টি বাহ্যিক শক্তি তাঁর শিল্পী সত্তাকে রসদ যুগিয়েছিল, তা এই। আর তাঁর অন্তরে ছিল সহমর্মিতা, আশাবাদ, হাস্যকৌতুক, আর এমন এক মাধুর্য্য যা তাঁকে ব্যক্তিগত প্রবল সমস্যাগুলোর মাঝেও ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করেছিল। এইসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাঁর রচনাবলি হয়ে উঠেছে উষ্ণ, সংকেতময়, আশাসঞ্চারী, আর বাস্তবধর্মী, একাধারে বিষণ্ণ আর কৌতুকপূর্ণ।
তাঁর দাদা অর্থাৎ পিতামহ ছিলেন ভূমিদাস, যিনি বহু মেহনতে পরিবারের মুক্তি ‘ক্রয়’ করেছিলেন। বাবা পাভেল ইয়েগোরোভিচ চেখভ এবং মা ইয়েভগিনিয়া চেকভের তৃতীয় সন্তান ছিলেন আন্তন চেখভ। মুদী দোকানদার বাবা ছিলেন খুব রগচটা, সন্তানদের রাখতে চাইতেন কড়া শাসনে, ধর্মীয় অনুশাসনের কড়া শৃঙ্খলে, ওদিকে মুনাফা করতেন ওজনে কম দিয়ে লোক ঠকিয়ে। বড় দুই ভাইয়ের নাম আলেক্সান্দার আর নিকোলাই। পরে, এই পরিবারে জন্মেছিল এক বোন এবং আরো দুই ভাই। ফলে, ছোট্ট এক মুদীর দোকানের আয়ে এই আটজনের মুখের অন্ন জোগাড় করা মোটেই সহজ ছিল না চেখভের বাবার পক্ষে।
তাঁর স্কুলজীবন তো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। আট বছর বয়সে তাঁকে এক কামরা বিশিষ্ট একটা প্যারিশ বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। গ্রীক বণিকেরা তাগানরগের গরীব-গুর্বোদের শিশু সন্তানদের জন্য এই পাঠশালাটি খুলেছিলেন। সেই বিদ্যালয়ের এক মূর্খ এবং বর্বর শিক্ষক শিশু চেখভকে এমনভাবে নিপীড়ন করেছিলেন যে বালকটি এমনকি বর্ণমালা পর্যন্ত শিখতে পারেনি বা শিখতে চায়নি। তাই পরের বছর তাকে একটা ‘জিমনেসিয়ামে’-তে পাঠানো হয় (পরে যেটার নাম হয় চেখভ জিমনেসিয়াম)। জিমনেসিয়ামটি থেকে বার্ষিক ৩০০ রুবলের একটা বৃত্তি পেতেন চেখভ। রাশিয়ার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যার একটি ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনার পর তাগানরগ নগর পরিষদ এই বৃত্তিটি চালু করেছিলেন। তার তিন ভাই – নিকোলাই, মিখায়েল এবং আলেকজান্ডার চেখভ-ও এই জিমনেসিয়ামে-তে পড়াশোনা করেছিলেন; তাঁদের মধ্যে মিখাইল ছিলেন সবার ছোট, এবং পরে তিনি আন্তন চেখভের একটি জীবনী লিখেছিলেন। তাছাড়া, নিকোলাই চেখভ ছিলেন চিত্রশিল্পী আর বাকি দুজন লেখক। বাসার আর বাবার মুদির দোকানে নানান কাজ-কর্ম করে পড়ালেখা করার খুব কম সময়ই পেতেন তিনি, আর সেকারণে পরীক্ষার ফল-ও হয়েছিল ভয়ংকর খারাপ। তাঁর বয়স যখন ষোল, বাবার দোকান গেল উঠে। একটা বাড়ি বানাতে গিয়ে মেরোনভ নামের এক ঠিকাদারের প্রতারণায় দেউলিয়া হয়ে গেলেন। পাওনাদারদের পয়সা না মেটাতে পারলে জেলে যেতে হবে, তাই পরিবার নিয়ে মস্কোতে পালাতে হলো পাভেল ইয়েগোরোভিচ চেখভ, সপরিবার, কেবল আন্তনকে ছাড়া--পরিবারের অল্প যতটুকু সয়-সম্পত্তি ছিল সেগুলো বিক্রি করার জন্য আর তার পড়াশোনা শেষ করতে। তাগানরগে আরো তিন বছর থাকতে হলো তাকে, সেলিভানভ নামের একজনের সঙ্গে এক বাড়িতে। পেট চালাতে চেখভ তখন টিউশনি শুরু করলেন আর মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে স্কুলের পড়া শেষ করলেন। ১৮৭৯-এ অবশেষে মস্কোতে পরিবারের সঙ্গে থাকার সঙ্গতি বা ফুরসত মিলল, এবং চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হলেন। তবে মস্কোতে তার পারিবারিক জীবন যে তাগানরগের চাইতে ভালো কাটছিল, তা নয়। সেখানে তাঁকে পরিবারের কর্তার দায়িত্ব নিতে হলো, কারণ বাবা তখন আর সেই ভূমিকা পালন করার মতো সবল ছিলেন না। এই নৈতিক এবং আর্থিক দায়িত্ব চেখভ আজীবন পালন করে গেছেন। যাই হোক, নেহাত বেঁচে থাকার তাগিদে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নকালে শস্তা স্থানীয় পত্রিকার জন্য সেইসব লেখা লিখতে শুরু করেন পরে যেগুলোকে তিনি ‘ছাইপাশ’ বলে বর্ণনা করবেন: কৌতুকপূর্ণ গল্প, রেসিপি, কিংবদন্তি, কৌতুক, ভডভিল (vaudeville) আর প্রহসন। আর এসব লেখার পেছনে তাঁর বড় ভাই আলেকজান্ডার তাঁকে উৎসাহ জোগাতেন। তাঁর প্রথম গল্পটি বের হয় ১৮৮০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি পত্রিকা স্ত্রেকোজা (ঘাসফড়িং)-তে। পরবর্তী চার বছর, মস্কোর রাস্তাঘাটের নানান ঘটনা ও চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চেখভ মস্কো আর সেন্ট পিটার্সবার্গের রম্য সাময়িকীগুলোতে শত শত অ্যানেকডোট, স্কেচ, গল্প, কৌতুক, নিবন্ধ আর নাটকীয় দৃশ্য পাঠিয়ে গেলেন। তাঁর ছোটগল্প আর নাটকের চরিত্র বাছাই করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অগ্রাধিকার তাঁর সাহিত্যিক জীবনে কখনোই ক্ষুণ্ণ হয়নি।
৩.
১৮৮৪ সালে অবশেষে মেডিকেল ডিপ্লোমা মিলল, এবং তিনি মস্কোতে তাঁর প্র্যাকটিস শুরু করলেন। কিন্তু তার রোগীরা ছিল দরিদ্র, ফলে তার পেট চালানো মুশকিল হয়ে পড়ল। আর্থার কোনান ডয়েলের মতো, আয় বাড়াতে তিনি লিখতে শুরু করলেন। তবে চিকিৎশাশাস্ত্রে ডিপ্লোমা লাভের আগে ১৮৮২ সালে তাঁর দুটো গুরুত্বপূর্ণ গল্প প্রকাশিত হয়: ‘দ্য লেডি অভ দ্য ম্যানর’ (Barynya), ‘লেইট ব্লুমিং ফ্লাওয়ার্স’ ‘Tsvetyzapozdalye’; গল্প দুটোতে পরিণত চেখভের শ্লেষপটু এবং ঘনবিন্যস্ত শৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৮৩ সাল থেকে ১৮৮৬ সাল অব্দি চেখভ নিকোলাই লেইকিনের মালিকানাধীন জার্নাল অসকোল্কি (খণ্ডাংশ)-র জন্য তিন শতাধিক রচনা লিখলেন। সেসবের মধ্যে ছিল ‘মস্কোর জীবনের খণ্ডাংশ’ নামে একটি কলাম যেখানে শহরজীবনের বহু কিছুর কড়া সমালোচনা করলেন তিনি। তাঁর এই প্রস্তুতিমূলক সৃজনশীল বছরগুলোতেই চেখভ এই সিদ্ধান্তে এলেন যে দৈনন্দিন জীবনের অস্তিত্বের মধ্যেই রয়েছে জীবনের করুণ রস।
ছাত্রজীবন থেকে শুরু করা এবং তার পরেও চালিয়ে যাওয়া তাঁর এসব রচনার পরিমাণ বিপুল। আর এই রচনাগুলোই তাঁকে মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলল। ১৯৮৬ সালের মধ্যে দেখা গেল জনপ্রিয় লেখকে পরিণত হয়ে গেছেন তিনি। আঠাশ বছর বয়েসে তাঁর সাহিত্যিক কীর্তির জন্য পেলেন ‘পুশকিন পুরস্কার’। যদিও আগের বছর ইভানভ নামক তাঁর নাটকটি মোটেই দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। আর, ১৮৮৫ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে পত্রিকা মালিক সেই নিকোলাই লেইকিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে চেখভ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন যে তিনি প্রকাশনা জগতের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে বেশ নাম করে ফেলেছেন, এবং সাহিত্য অঙ্গনের অনেকেই তাঁর ভক্ত। ১৮৮৬ সালের মার্চ মাসে ঔপন্যাসিক দিমিত্রি গ্রিগোরিভিচ তাকে এক চিঠিতে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাঁর প্রতিভা অপচয় না করেন, এবং ছদ্মনামে না লিখে স্বনামে লেখালেখি করেন (উল্লেখ্য, চেখভ ‘আন্তোশা চেখন্তে’ বা ‘ক্রোধহীন মানব’ নামে লিখতেন) এর পর থেকে চেখভ রম্য সাময়িকীগুলোর জন্য লেখা বন্ধ ক’রে সুভোরিনের নোভোয়ে ভেরনিয়া (নতুন সময়) পত্রিকার জন্য গল্প লিখতে শুরু করেন। তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত গল্পগুলোর কয়েকটি এই সাময়িকীতে ছাপা হয়: ‘সার্জেন্ট প্রিশিবীফ’, ‘শিকারী’ এবং ‘দুঃখ’। ১৯৮৮ সালে সেভেরনি ভেস্তনিক (উত্তরের সংবাদবাহক) পত্রিকায় ‘স্তেপ’ গল্পটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তিনি গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক মাসিক পত্রিকার লেখকের কাতারে নাম লেখালেন। আর এই সময়েই তিনি তলস্তয়ের অশুভের প্রতি অহিংসা বা প্রতিরোধহীনতার নীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
সেই ১৮৭৮ সালে, ছাত্রাবস্থায় লেখা প্লাতোনভ-এর পর তিনি বেশ কিছু একাঙ্কিকা আর তাঁর প্রথম প্রযোজিত নাক ইভানভ দিয়ে নাট্যজগতে তাঁর পদচারণা শুরু করেন। এরপর একের পর আসতে থাকে তাঁর ‘কৌতুক’ নামে খ্যাত তাঁর জনপ্রিয় একাঙ্কিকাগুলো: ভল্লুক (১৯৮৮), বিবাহ প্রস্তাব (১৯৮৮), ইত্যাদি। পরের বছর, ১৮৮৯ সালে তিনি তলস্তয় প্রভাবিত গীতধর্মী প্রথম নাটক বনদৈত্য মঞ্চস্থ হয়; কিন্তু মোরালিটি প্লে ধরনের সেই নাটকটি দর্শকের কাছে সাড়া জাগাতে একবারেই ব্যর্থ হলে চেখভ বেশ কিছুদিন নাট্যাঙ্গন থেকে দূরে থাকেন এবং তলস্তয়ের বিশ্বদৃষ্টি বা weltanschauung অনুসারী ছোট গল্প রচনা করেন। এই সময়ের আগে লেখা কিছু ছোটগল্পগুলো নিয়ে মোট চারটে গল্প সংকলন বের হয় তাঁর: Motley Stories (Pyostrye rasskazy, ১৮৮৬), Innocent Speeches , (Nevinnye rechi, ১৮৮৭), In the Twilight (V sumerkakh, ১৮৮৭; এই গল্প সংকলনটির জন্যই তিনি পুশকিন পুরস্কার লাভ করেন) এবং Stories (Rasskazy, ১৮৮৭)।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না চেখভ তাঁর জীবন নিয়ে। অন্যদিকে, কিছু কিছু রুশ লেখক এবং বুদ্ধিজীবী এই বলে সমালোচনা করছিলেন যে চেখভের স্বচ্ছ রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত বিশ্বাসের অভাব রয়েছে। ফলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মস্কো থেকে ৬,০০০ মাইল দূরে, সাইবেরিয়ার অন্য ধারে রুশ সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী শ্রম শিবির বা কার্তোগা পরিদর্শনে যাবেন।
১৮৯০ সালে বেড়িয়ে পড়েন তিনি এই দুরূহ যাত্রায়, ট্রেন, ঘোড়ায় টানা কোচগাড়ি, আর স্টিমার চেপে সাইবেরিয়া পেরিয়ে শাখালিন দ্বীপের উদ্দেশে, জাপানের কাছে; উদ্দেশ্য, সেখানে রুশ সাম্রাজ্যের সুদূর পুব প্রান্তে যে শ্রমশিবির বা কাতোরগা আছে, সেটার অবস্থা স্বচক্ষে দেখে আসা। আগের বছর থেকেই পরিকল্পনা চলছিল সাইবেরিয়া যাওয়ার, যক্ষ্মায় তাঁর এক ভাই মারা যাওয়ার পর পরই, আর এটা জানার অল্প কিছুদিন পরে যে তিনি নিজেও একই রোগে আক্রান্ত, এবং তিনি নিজেও হয়ত একই পরিণতি বরণ করবেন। চেখভের এই ভ্রমণ পরিকল্পনা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেই প্রশংসা করেছিলেন। একথা তো ঠিক যে বহু রুশ লেখকই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাইবেরিয়া গমন করেছিলেন, এবং তাঁদের কারো কারো ক্ষেত্রে তা ছিল অগস্ত্য যাত্রা; কিন্তু কেউই সম্ভবত চেখভের আগে স্বেচ্ছায় সেখানে যাননি।
মাস তিনেক ছিলেন তিনি সেখানে। কথা বলেছিলেন কয়েক হাজার বন্দির সঙ্গে। সেই ভয়ংকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ফসল শাখালিন (১৮৯৩)। যদিও সে বই কোনো সাড়া জাগালো না। এই বইয়ে চেখভ শ্রমশিবিরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের দূরদৃষ্টির অভাব এবং অযোগ্যতার ফল স্বরূপ সেখানকার বন্দিদের জীবনযাত্রার নিম্নমান, সরকারী ফান্ডের অপচয় আর উৎপাদনশীলতা হ্রাসের কঠোর সমালেচনা করেছিলেন। বইটি বের হওয়ার পরে রুশ কারাগারগুলোতে বেশ কিছু সংস্কার সাধন করা হয়। অবাক করা ব্যাপার হলো এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনার ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ৭৪ বছর পর, ১৯৬৭ সালে। বাংলা কোনো অনুবাদ হয়েছে বলে জানা নেই। চেখভের দেখে আসা কার্তোগা ব্যবস্থা যে-সময়ের তার পরে এসব শ্রম শিবিরের জীবনযাত্রার পরিস্থিতির কতটা অবনমন হয়েছে, বন্দিদের সংথ্যা কতটা বেড়েছে সেটার তুলনামূলক চিত্র দেখাবার জন্য নোবেলজয়ী রুশ সাহিত্যিক আলেকসান্দর সলঝেনিৎসিন তাঁর গুলাগ আর্কিপেলাগো –তে চেখভের শাখালিন থেকে লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতি দিয়েছেন ।
শাখালিন থেকে রাশিয়া ফেরার পথে চেখভ তিন দিন এবং দু’রাত শ্রীলংকায় অবস্থান করেন, তবে দেশটি তখন সিলোন নামে পরিচিত ছিল। হংকং এবং সিঙ্গাপুর হয়ে তিনি সেখানে যান। শ্রীলংকার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ চেখভ দেশটিকে স্বর্গ বলে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য, শ্রীলংকা থেকে তিনি তিনটি বেজী (mongoose) রাশিয়া নিয়ে যান; প্রাণীগুলো তাঁর আবাসে বেশ কয়েক বছর ছিল, এবং পরে তিনি সেগুলোকে মস্কো চিড়িয়াখানায় দান ক’রে দেন। শ্রীলংকা অবস্থানের দ্বিতীয় রাতটি তিনি ক্যান্ডি শৈলশহরে কাটান।
শাখালিনের অভিজ্ঞতা চেখভকে শিখিয়েছিল জোর-জবরদস্তির সম্মুখীন মানব মনের কাছে বিভ্রম বা মায়ার গুরুত্ব কতটুকু। কিন্তু যে বিভ্রম বা মায়া শাখালিনের হতভাগ্য বন্দিদেরকে বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়েছিল, সেই একই বিভ্রমের ওপর প্রবল নির্ভরতা সেন্ট পিটার্সবার্গের অভিজাতশ্রেণীর সদস্যদের তথা তিন বোন নাটকের অধিকাংশ চরিত্রের জীবনে ধ্বংসাত্মক একটি শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে অক্ষমতা তাদেরকে অথর্ব ক’রে দিয়েছে। শাখালিনের অভিজ্ঞতার পরেই চেখভ তলস্তয়ের দর্শন পুরোপুরি পরিত্যাগ করেন। যুদ্ধ ও শান্তি-র লেখকের খৃষ্টীয় ভালোবাসা ও মন্দের প্রতি নিষ্ক্রিয়তা বা তার প্রতিরোধহীনতার ধারণার বিরুদ্ধে চেখভের সবচাইতে জোরালো রচনা হচ্ছে ‘দ্য ডুয়েল’ (১৮৯১) এবং ‘ওয়ার্ড নম্বর ৬’ নামের দুটো গল্প। শাখালিনের অভিজ্ঞতা চেখভের মধ্যে রুশ সমাজের যতসব মন্দ ও অশুভ--তার বিরুদ্ধে বাস্তবিক কিছু করার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলেছিল। ক্রমেই তিনি কেবল দার্শনিক বুলি আওড়ানো নিশ্চেষ্ট রুশ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রতি অধৈর্য্য এবং বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিলেন, যারা অন্যদের ভাগ্যোন্নয়নে কিছু করতে অক্ষম।
অস্থির, সংক্ষুব্ধ চেখভ ১৮৯১ সালের মার্চ মাসে আবার ভ্রমণে বের হন। এবার লক্ষ্য ইউরোপ। কিন্তু মাস ছয় পর বাড়ি এবং কাজ এই দুইয়ের জন্য আকুল হয়ে ঘরে ফিরে আসেন। শাখালিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে রুশ সমাজের যাবতীয় মন্দ তথা নেতিবাচক দিকগুলো সংস্কারে কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
১৮৯২ সালের বসন্তে মস্কোর কাছে মেলিখভো নামের একটি ভূসম্পত্তি কেনেন চেখভ: উদ্দেশ্য, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাস করা এবং লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু অচিরেই এক কলেরা মহামারি দেখা দিলে তিনি পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষকদের চিকিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দুবছর পর, যক্ষ্মা আক্রান্ত শরীর বেহাল হয়ে পড়লে তাঁকে বাধ্য হয়ে ইয়াল্টায় যেতে হয়। ততদিনে তিনি দ্য সী গাল (Chayka) নাটক রচনা করতে শুরু করে। রচনা শেষে মঞ্চায়নের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গের আলেকজান্দ্রিন্সকি থিয়েটারকে দেয়া হলো সেটা। কিন্তু নাটকটির পরিচালক এবং অভিনেতাদের কেউই প্লট এবং ঘটনাবলির ওপর মুড এবং কথার প্রাধান্য বিস্তার করে, নাটক সম্পর্কে চেখভের এই চিন্তা-ভাবনার প্রতি সহানুভতিসম্পন্ন ছিলেন না । ফলে, প্রযোজনা হিসেবে এটি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলো। (কিন্তু নাটকটি থিয়েটার পরিচালক ভ্লাদিমির নেমিরোভিচ-দানচেঙ্কোকে এতটাই অভিভূত করেছিল যে ভদ্রলোক ১৮৯৮ সালে তাঁর সহকর্মী কন্সতান্তিন স্তানিস্লাভস্কিকে রাজী করিয়েছিলেন যেন তিনি উদ্ভাবনকুশল মস্কো আর্ট থিয়েটারের জন্য একটি নতুন প্রযোজনার নির্দেশনার ভার গ্রহণ করেন।) এদিকে স্বাস্থ্য ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল চেখভের, আর ১৮৯৭-এর মার্চে প্রথমবারের মতো তাঁর ফুসফুস থেকে রক্তপাত ঘটে। এই সময়েই, সারা বিশ্বে আলোড়নসৃষ্টিকারী ‘দ্রেইফুস মামলা’ ফের চালু হতে চেখভ সুভোরিনকে নিয়ে ফ্রান্সে গেলেন। সেখানে তিনি এমিল জোলা এবং ফরাসী উদারপন্থীদের জোরালো সমর্থন জানালে রক্ষণশীল সুভোরনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে।
সে যাই হোক, মেলিখোভো ফিরে আসার পর চিকিৎসকরা চেখভকে শীতকালটা একটা নমনীয় জলবায়ু সম্পন্ন স্থানে বাস করার ব্যাপারে রাজী করান। অতএব বাবার মৃত্যুর পর চেখভ এস্টেটটা বিক্রি ক’রে দিয়ে মা এবং বোনকে নিয়ে ইয়াল্টায় চলে গেলেন। এর মধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গের এক প্রকাশক ফিওদর মার্কসের সঙ্গে যোগাযোগ হলো তাঁর। তিনি চেখভের রচনা সমগ্র প্রকাশে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অতএব তিন বছর ধরে চেখভ ব্যস্ত রইলেন নিজের ছোটগল্পগুলো সম্পাদনা, পরিমার্জন, এবং ক্ষেত্র বিশেষে, পুনর্লিখনের কাজে যাতে সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা যায়। তিনি তাঁর বাকি জীবনভর নতুন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী ছোট গল্প লিখে গেছেন, এবং তাঁর রচনার কলাকৌশল পরিমার্জিত ক’রে গেছেন ঠিকই, কিন্তু ১৮৯৫ সাল থেকে ১৯০৪, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর বছর অব্দি, এই মোটামুটি দশ বছরের কাল পরিসরটি বিশিষ্ট হয়ে আছে আধুনিক রুশ জীবনের আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর রচনার জন্য। এদিকে মস্কোয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মস্কো আর্ট থিয়েটার, প্রতিষ্ঠাতা তাঁরই বন্ধু নেমিরোভিচ-দানচেঙ্কো এবং কন্সতান্তিন স্তানিস্লাভস্কি। উল্লেখ্য, শেষোক্ত দুজনের প্রথম সাক্ষাত ১৮৯৭ সালের ২২শে জুন, স্লাভিয়ানস্কি বাজারে, মধ্যাহ্ন ভোজনের উদ্দেশ্যে; সেই সাক্ষাত ঘটে বেলা দুটোয়, আর শেষ হয় আঠারো ঘণ্টা পরে, পরদিন সকাল আটটায়। সেই দীর্ঘ আলাপেরই ফলাফল ওই আর্ট থিয়েটার। স্তানিস্লাভস্কি এবং দানচেঙ্কো জড়ত্ব জর্জরিত রুশ থিয়েটারের মরণমুঠির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং তাঁরা সফল হয়েছিলেন। তাঁদের নতুন পদ্ধতি মোতাবেক, প্রধান অভিনেতাদের আর নিয়ম-কানুন জারি করে পাদপ্রদীপের পুরো আলো চুরি করবার উপায় রইল না। অভিনয়, পোশাক-আশাক, দৃশ্যপট, প্রপার্টি, সঙ্গীত আর অভিনয় শৈলীর দিক থেকে প্রযোজনাগুলোকে হতে হবে সমরূপী। আর সর্বোপরি, অভিনেতারা বক্তৃতা বা আবৃত্তির মতো ক’রে সংলাপ বলবেন না, বরং স্বাভাবিক এবং আন্তরিকভাবে পারফর্ম করবেন। এই নতুন নিয়ম-কানুন চেখভের মূল নাট্যশৈলীর সঙ্গে এমন চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে গেল যে, নাট্যনির্দেশক এবং নাট্যকার সব সময় ইন্টারেপ্রেটেশনের সঙ্গে একমত না হলেও, সার্বিক মতৈক্যটা এত চমৎকার ছিল যে তা একই সঙ্গে এক অসাধারণ নাট্যকার আর এক অসাধারণ থিয়েটারকে রসদ যুগিয়েছিল।
এই দু’জনের সঙ্গে পরিচয় চেখভের সাহিত্যিক জীবনের শেষ বছরগুলোর সবচাইতে মূল্যবান এবং ফলপ্রসূ সাহচর্য হয়ে দাঁড়ায়। মস্কো আর্ট থিয়েটারের প্রথম সীজনের রিপারটোয়ারে দ্য সী গাল-এর একটি নতুন প্রযোজনার জন্য চেখভের অনুমতি পাওয়ার পর, নেমিরোভিচ-দানচেঙ্কো এবং স্তানিস্লাভস্কি মহড়া শুরু করলেন। এসব মহড়ার কয়েকটিতে চেখভ নিজেও উপস্থিত ছিলেন, মস্কো ছাড়ার আগে। আর এই মহড়াতেই অভিনেত্রী ওলগা নিপারের সঙ্গে প্রথম আলাপ নাট্যকারের; পরে তাঁরা বিয়ে করবেন। আমাদের মনে আছে, বছর দুই আগে আলেকজান্দ্রিন্সকি থিয়েটারে এই নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন কী রকম মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু মস্কো আর্ট থিয়েটারে এই প্রযোজনা দুর্দান্ত রকমের মঞ্চসফল হয়েছিল। থিয়েটারের প্রথম সিজনে আলেক্সেই তলস্তয়, হেনরিক ইবসেন এবং উইলিয়াম শেক্সপীয়রের নাটকও অভিনীত হয়েছিল, কিন্তু ১৮৯৮-এ দ্য সীগাল দিয়ে শুরু হয়ে চেখভের চারটে প্রধান নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পরেই থিয়েটারটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। যাই হোক, পরের বছর স্তানিস্লাভস্কি আংকল ভানিয়া-র (Dyadya Vanya) সফল প্রযোজনা সম্পন্ন করেন, এবং ১৯০০-তে নাট্যদল নিয়ে ক্রিমিয়ায় পাড়ি জমালেন, যাতে চেখভ তাঁর নিজের নাটকের মঞ্চায়ন দেখতে পারেন। এরই সুবাদে ওলগা নিপারের সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় হয় নাট্যকারে, আর তারই পরিণতিতে ১৯০১-এর ৬ই মে তাঁদের পরিণয় ঘটে। দম্পতিটি কেবল গ্রীষ্মকালেই এক সঙ্গে থাকতেন: কারণ চেখভ চাইতেন থিয়েটার সিজনে তাঁর স্ত্রী যেন নিজ পেশা অব্যাহত রেখে মস্কোতেই থাকেন, এবং তিনি দক্ষিণে। মস্কোর বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন থেকে নিজেকে নির্বাসিত মনে করলেও, সে-সময় ক্রিমিয়ায় বসবাসরত তলস্তয় এবং গোর্কীর উষ্ণ সান্নিধ্য ছিল তাঁর জন্য একটা বড় ক্ষতিপূরণ। ১৯০০ সালে তিনি রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সেস-এর সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার দুই বছর পর যখন জারের নির্দেশে অ্যাকাডেমিতে গোর্কিকে সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত করা হলো তখন চেখভ প্রতিবাদস্বরূপ পদত্যাগ করেন।
এদিকে, মস্কো আর্ট থিয়েটারের জন্য লেখা চলছে। চেখভ যখন তিন বোন তথা ত্রি সেস্ত্রি লিখছেন তখন তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা এতই নাজুক যে তিনি তাঁর নাটকের চরিত্রগুলোর মতোই মস্কো থেকে দূরে। শহরটির আবহাওয়া এবং জীবনযাত্রার গতি যক্ষ্মা রোগের জন্য রীতিমতো সর্বনাশা। এবং নাটকাটর মহড়ার জন্য শহরটিতে তাঁর ঘনঘন যাতায়াত তাঁর অসুস্থ শরীরের জন্য মোটেই ভাল হয়নি। নাটকটিতে মস্কোর জন্যে তিন বোনের আকুলতার একটা বড় অংশই আসলে চেখভের নিজের, তাঁর প্রিয় শহর থেকে দূরে থাকার কারণে। চেখভ ১৯০০ সালে ৯ই সেপ্টেম্বর তাঁর বোনকে লেখেন: ‘তিন বোন লিখতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আগের নাটকগুলো লিখতে এত কষ্ট হয়নি।’ তবে তাঁর আগের নাটকগুলোর ক্ষেত্রে যা ঘটেনি, মস্কোতে তিন বোন অসাধারণ মঞ্চ সফল হয়েছিল। ১৯০১ সালের জানুয়ারি। চেখভের তুখোড় সমসাময়িকদের মধ্যে অন্যতম গোর্কি এই নাটকটিকে চেখভের রচনাগুলোর মধ্যে সবচাইতে গভীর এবং প্রভাবসঞ্চারী বলে উল্লেখ করেছেন। নাটকের মাশা চরিত্রটি লেখক তাঁর প্রিয় অভিনেত্রী ওলগা নিপারের কথা ভেবে সৃষ্টি করেছিলেন, এবং নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হওয়ার চার মাস পর তিনি তাঁর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালে, এই তিন বোন-এরই একটি মঞ্চায়নের সময় স্তানিস্লাভস্কি মঞ্চে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থিয়েটার থেকে প্রায় অবসর গ্রহণ করেন)। ওদিকে, চেখভেরও জীবনী শক্তি শেষ হয়ে আসছিল। দ্য চেরি অর্চার্ড শেষ করতে তাঁর প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়েছে (১৯০৩)। কখনো কখনো দিনে দুই আড়াই লাইনের বেশি লিখে উঠতে পারতেন না। আর চিকিৎসকের বারণ সত্ত্বেও মাঝে মাঝে মস্কো গিয়ে নাটকের মহড়া দেখার মূল্য স্বরূপ ১৯০৩-০৪-এর শীতে তিনি একেকবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য তাঁর স্ত্রী তাঁকে দক্ষিণ জার্মানীর বাডেনভাইলার স্বাস্থ্য নিবাসে নিয়ে যান। কিন্তু বৃথাই। ১৯০৪ সালের ১৫ই জুলাই চেখভ মৃত্যুবরণ করেন। চেখভের মৃতদেহ এই জর্মন স্বাস্থ্য নিবাস থেকে জাহাজে ক'রে মস্কোতে পাঠানো হয়, একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে রেখে; সেই গাড়িটি সাধারণত শামুক পরিবহনে ব্যবহৃত হতো। উল্লেখ্য, এখানেই চার বছর আগে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত আমেরিকান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক স্টিফেন ক্রেন (জন্ম ১৮৭১) মারা গিয়েছিলেন; এখানেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা নেহেরুর চিকিৎসা হয়েছিল; তিনিও একই রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
৪.
নাট্যকার হিসেবে চেখভের বিকাশটি বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসুরীদের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পেলে আমাদের সুবিধে হতে পারে। এক্ষেত্রে তাঁর স্বদেশের বাইরের বিচিত্র প্রভাব রয়েছে – শেক্সপীয়র থেকে এমিল জোলা অব্দি। এছাড়াও রয়েছে অষ্টাদশ শতক থেকে তার সময় অব্দি স্বদেশী নাট্যের প্রভাব, যেসবের শেকড় হয়ত আরো গভীরে প্রোথিক। জর্জ আর. নয়েস তাঁর মাস্টারপিসেস অভ রাশান ড্রামা (১৯৩৩) গ্রন্থে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের আগে অব্দি রুশ সাহিত্যকে মোটা দাগে চারটি পর্বে ভাগ করেছেন:
প্রথম পর্ব, যা ছিল প্রবলভাবে ফরাসী ধ্রুপদী আদর্শ অনুসারী (১৭৬০ থেকে ১৮২০), দ্বিতীয় পর্ব, যাকে বলা যেতে পারে রুশ রোমান্টিক ধারা ১৮২০ থেকে ১৮৪০, ১৮৪০ থেকে ১৮৯০, এবং ১৮৯০ থেকে ১১৯১৭ ।
সবচাইতে ফলদায়ী তৃতীয় পর্ব যা রুশ বাস্তববাদের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে (১৮৪০-১৮৯০)। আর ১৮৯০ থেকে ১৯১৭-র বিপ্লব অব্দি চতুর্থ পর্ব, যা বাস্তববাদী ধারা অনুসরণ করলে তাতে হানা দিয়েছে সিম্বলিজম এবং ফিউচারিযমের আধুনিক প্রবণতাগুলো।
পরবর্তী কালে যা রুশ সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হবে তা বিখ্যাত জার পিটার দ্য গ্রেটেরই (রাজত্বকাল ১৬৮২-১৭২৫) হাতে গড়া মূলত, রাশিয়ার মধ্যযুগীয় এবং কৃষিভিত্তিক বনিয়াদ থেকে সেটাকে শিক্ষা-দীক্ষায় উৎসাহিত করে ইউরোপীয় ধারায় তিনিই নিয়ে এসেছিলেন। এর কয়েক প্রজন্ম পর, ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট-এর (রাজত্বকাল ১৭৬২-১৭৯৬) হাত ধরে রাশিয়া প্রবেশ করছিল তার স্বর্ণ যুগে। তখনো প্রবলভাবে ফরাসী সংস্কৃতি প্রভাবিত রাশিয়াতে গড়ে উঠেছিল একটা শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান অভিজাত শ্রেণী।
অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকের নাটকের দিকে তাকালে আমরা দেখব ফরাসী ট্র্যাজেডি তথা রাসিনের (১৬৩৯-১৬৯৯) প্রভাব সেখানে খুব বেশি তখন। আর রুশ কমেডির উত্থানও ঘটবে ফরাসী আদর্শ অনুসরণ ক’রেই। গুরুত্বপূর্ণ প্রথম রুশ কমিক নাট্যকার ছিলেন দেনিস ইভানভ ফনভিযিন (১৭৪৪-১৭৯২), পরের জন হচ্ছেন, আলেক্সান্দর গ্রিনয়েদভ (১৭৯৫-১৮২৯), তাঁর Wit Works Woe (১৮২৩) নামের কমেডি অভ ম্যানার্সকে মলিয়ের-এর দ্য মিসানথ্রোপ-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়, যদিও সেটার চরিত্রগুলো শহরবাসী রুশ অভিজাত শ্রেণীর। এই নাটকটি প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছিল, এবং নাট্যকারের জীবদ্দশায় সেটা মঞ্চস্থ হয়নি; প্রথম পূর্ণাঙ্গ মঞ্চায়ন হয়েছিল ১৮৬৯ সালে।
উনবিংশ শতক রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে খ্যাত। রোমান্টিক আর বাস্তববাদী এই দুটো কালপর্ব নিয়েই এই গৌরবোজ্জ্বল যুগ। এই যুগেই আবির্ভূত হয়েছিল মহত্তম রুশ কবি আলেক্সান্দর পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭)। ফরাসী ধ্রুপদী আদর্শ-র বদলে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল দুই ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপীয়র আর লর্ড বায়রন। তবে তাঁর নাটক -- ক্লজেট ড্রামা --বরিস গুদুনভ (১৮২৫) ততটা রিসোত্তীর্ণ নয় বলেই মনে করেন অনেকে যেটা এখন একই মুসোরগস্কি-র একই নামের অপেরার মধ্যে দিয়েই বেঁচে আছে। এযুগের অন্য সেরা করি মিখাইল লেরমন্তভ (১৮১৪-১৮৪১) অবশ্য কোনো নাটক লেখেননি।
রুশ বাস্তববাদী সাহিত্যের ‘সেন্টিমেন্ট, স্যটায়ার আর ক্যারিকেচার’-এর সাহিত্যিক নিকোলাই গোগলকে (১৮০৯-১৮৫২) নয়েস চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনিই প্রথম রুশ সাহিত্যিক যিনি সাধারণ মানুষকে তাঁর রচনার বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়ে এসেছেন। তাঁর বিখ্যাত নাটক দ্য গভর্নর জেনারেল এমনকি জার দ্বিতীয় নিকোলাসেরও খুব প্রিয় ছিল। তাঁর নেকনজর থাকার কারণেই গোগোলের নাটকগুলো সেন্সরের কোপ থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
রুশ প্রথম পেশাদার নাট্যকার ছিলেন আলেক্সান্দর অস্ত্রোভস্কি (১৮২৩-১৮৮৬), মোট ৪২টি নাটক রচনা করেছিলেন তিনি, এবং সেগুলোর পাত্র-পাত্রী ছিল মধ্যবিত্ত আর নীচু শ্রেণীর লোকজন। চেখভের জন্মের বছর প্রকাশিত ও মঞ্চস্থ তাঁর দ্য থান্ডারস্টর্ম (১৮৬০) নাটকটিই নাট্যকারের সেরা কাজ বলে মনে করা হয়। আর ১৮৭০ সালের নাটক দ্য ফরেস্ট চেখভের দ্য অর্চার্ড নাটকের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বাস্তবতাবাদপন্থী যুগে রাশিয়ার সবচাইতে বিখ্যাত তিনজন লেখক হচ্ছেন দস্তইয়েভস্কি, তুর্গেনেভ এবং তলস্তয়। ফিয়োদর দস্তইয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) কোনো নাটক রচনা করেননি। কিন্তু ইভান সেরগেইভিচ তুর্গেনেভ (১৮১৮-১৮৮৩, কার্ল মার্কস এবং তিনি একই বছরে জন্ম গ্রহণ এবং মৃত্যু বরণ করেন) কিছু দিনের জন্য করেছিলেন। তাঁর আ মান্থ ইন দ্য কান্ট্রি (১৮৫০) ফরাসী সাহিত্যিক অনরে দ্য বালজাকের মেলোড্রামা দ্য স্টেপমাদার অনুসরণে লেখা, যদিও রুশ অনুপুঙ্খ যোগ ক’রে তুর্গেনেভ সেটাকে নয়েস-এর ভাষায় একটি ‘গার্হস্থ্য কমেডি’-তে রূপান্তরিত করেছিলেন।।
রাশিয়ার সেরা লেখক হিসেবে অনেকেই যাঁকে এক বাক্যে স্বীকার করে নেন তিনি লেও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০)। তাঁর ১৮৮৬ সালে রচিত এবং ১৯০২ সাল অব্দি রাশিয়ায় প্রদর্শন নিষিদ্ধ নাটক অন্ধকারের শক্তি সম্ভবত মহত্তম রুশ ট্র্যাজেডি।
লেও তলস্তয়ের দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই কাউন্ট আলেক্সেই তলস্তয় (১৮১৭-১৮৭৫) তাঁর ঐতিহাসিক ত্রয়ী নাটকের জন্য বিখ্যাত: দ্য ডেথ অভ ইভান দ্য টেরিবল (১৮৬৪), জার ফিয়োদর ইভানোভিচ (১৮৬৮) এবং জার বরিস (১৮৭০)। উল্লেখ্য, মস্কো আর্ট থিয়েটারের যাত্রা সূচিত হয় ১৮৯৮ সালে, আলেক্সেই তলস্তয়ের জার ফিয়োদর ইভানোভিচ মঞ্চায়নের মাধ্যমেই।
নয়েস ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ এই দশ বছরকে রুশ সাহিত্যের তুলনামূলকভাবে একটা খরার কাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন, এবং একই সঙ্গে একটা নতুন যুগের সূচনা বিন্দু হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। দস্তইয়েভস্কি, তুর্গেনেভ, অস্ত্রভস্কি কেউ-ই আর বেঁচে নেই তখন। আর তলস্তয় বেঁচে থাকলেও তাঁর মানস ও সাহিত্যিক জগৎ বদলে গেছে। ঊনবিংশ শতকের এই আটের দশক সমাজে বৃহত্তর পরিবর্তনের কাল, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কাল, এবং পুঁজিবাদের বিস্তারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিকাশের কাল।
আশাহীনতা আর ব্যর্থতার কারণে যে বিশাল জনগোষ্ঠী চলৎশক্তিরহিত হয়েছিল আটের দশকে, তারাই পরের দশকে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে জেগে উঠল, এবং চেখভের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে ১৯০৫ সালে তাঁরা বিপ্লব সংঘটনে আশাবাদী ও শক্তিশালী হয়ে উঠল।
আন্তন চেখভের জন্মের পরের বছর, ১৮৬১ সালে, উদারপন্থীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার ক’রে জার দ্বিতীয় আলেক্সান্দর ভূমিদাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এক দশকব্যাপী নানান সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের সুবাদে সাবেক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা পিছু হঠে গিয়ে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু নতুন যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো তার জন্য প্রস্তুতি ছিল না তেমন: সঞ্চিত পুঁজি ছিল খুব কম, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, শিল্প কারখানার, বাণিজ্য আর স্বনির্ভর প্রশাসন অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই চলে, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত দক্ষতা আর রিসোর্সের অভাব।
এর মধ্যে ১৮৬৬-তে সম্রাটকে হত্যার একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার ধীরে ধীরে আরো বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে আর তার ফলে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরিসর-ও ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। ১৮৭০-এর দশকে সর্বত্র সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গজিয়ে উঠতে থাকে। আর শেষমেষ ১৮৮১ সালে – চেখভ যখন চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করছেন – তখন দ্বিতীয় আলেক্সান্দর আততায়ীর হাতে খুন হন।
ঊনবিংশ শতকের আটের দশকে রাজা তৃতীয় আলেক্সান্দর রাজ্য শাসনে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখান, এবং তাঁর আগে সংস্কার কার্যক্রমের যুগে যেসব ব্যাপারে সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছিল সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেন। জাতীয়বাদ, অর্থডক্সি, স্বৈরতন্ত্র, এই তিন ছিল সরকারের মূলমন্ত্র। কিন্তু আলেক্সান্দরের এবং পরে দ্বিতীয় নিকোলাসের স্বৈরতন্ত্র পশ্চিমীকরণ, শিল্পায়ন, এবং মার্কসবাদের ঢেউ ঠেকাতে পারেনি।
চেখভ যখন ১৮৮০ সালের দিকে রম্য সাময়িকীগুলোতে লেখা শুরু করেন, রুশ সাহিত্যের দিকপালেরা -- দস্তইয়েভস্কি, তুর্গেনেভ, এবং তলস্তয় -- তখনো জীবিত। কিন্তু সফল, সংস্কৃতিমনা অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত এই লেখকদের সঙ্গে ভূমিদাসের পরিবার থেকে উঠে আসা এই চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রের সঙ্গে সাযুজ্যের জায়গা ছিল খুব কম। চেখভ দস্তইয়েভস্কির লেখা একবারেই পছন্দ করতেন না, সেগুলো তার কাছে রীতিমতো অসুস্থ্যকর রকমের অ-রুচিকর বলে মনে হতো। তলস্তয়ের চরমপন্থী তত্ত্বগুলো তাঁকে কিছু সময়ের জন্য বেশ মুগ্ধ করেছিল, এবং ধারণা করা হয় সেসব ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তিনি সাইবেরিয়া পার হয়ে শাখালিন দ্বীপ যাওয়ার মতো কষ্টকর সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তলস্তয় ততদিনে শিল্পের প্রতি বিমুখ হয়েছেন্, আর চেখভ মনে প্রাণে একজন শিল্পী ছাড়া আর কিছু নন। তলস্তয়ের ওসব দার্শনিক ধারণা থেকে তাঁর কিছু শেখবার ছিল না। গোগোলের হাস্যরস এবং তুর্গেনেভের ঘনবিন্যস্ততা তরুণ চেখভের সামনে নিশ্চয়ই রচনার পারদর্শিতার উদাহরণ হাজির করেছে। কিন্তু চেখভের আরেক জীবনী রচয়িতা আর্নেস্ট সিমন্স –এর ভাষায়: ‘চেখভ তাঁর পূর্ববর্তী কোনো কিছুর অনুকরণকারী ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন অসাধারণ উদ্ভাবক, রূপ বা কাঠোমো এবং বিষয়বস্তু দুই ক্ষেত্রেই, আর তার মাধ্যমে তিনি রুশ সাহিত্যে এক নতুন ধারার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।’
পেশায় চিকিৎসক এই সাহিত্যিক বলতেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্র হচ্ছে তাঁর বৈধ স্ত্রী, আর সাহিত্য তাঁর রক্ষিতা। একজনকে একঘেয়ে লাগতে শুরু করলে আমি আরেকজনের কাছে গিয়ে রাত্রিযাপন করবো।’ থিয়েটারে আধুনিকতাবাদের গোড়ার দিকের তিন প্রধান পুরুষদের মধ্যে চেখভকে একজন বলে গণ্য করা হয়, বাকি দুজন নরওয়ের হেনরিক ইবসেন আর সুইডেনের অগাস্ট স্ট্রীন্ডবার্গ।
তাঁর নাটকের প্রথম পাঠ যেমন বেশ অ-নাটকীয় ঠেকে পাঠকের কাছে, তাঁর জীবনকাহিনীও দৃশ্যত সেরকমই সাদামাঠা বলেই মনে হয়। কনস্তানতিন স্তানিস্লাভস্কি তাঁর মাই লাইফ ইন আর্ট -এ বলেছেন:
‘চেখভের নাটকের কাব্যশক্তি প্রথম পাঠে ধরা পড়ে না। নাটকগুলো পড়ার পর আপনি আপন মনে বলে ওঠেন: ভাল, কিন্তু...তেমন বিশেষ কিছু নয়, এমন কিছু নয় যা পড়ে আপনি মুগ্ধ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাবেন। সব কিছুই যা হওয়া উচিত ঠিক তেমন। পরিচিত... সত্যনিষ্ঠ... নতুন কিছুই নয়...’
‘প্রায়ই দেখা যায়, প্রথম পাঠটা এমনকি হতাশাজনক। আপনার মনে হবে সেসব সম্পর্কে আপনার কিছুই বলার নাই। প্লট? বিষয়বস্তু? গুটি কতেক শব্দেই আপনি সেসব বলে দিতে পারেন। অভিনয়ের ভূমিকাগুলো/অংশগুলো? অনেকগুলোই ভালো, কিন্তু একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনেতাকে উদ্দীপ্ত করতে পারে এমন কিছু নয়।
‘তারপরেও, কিছু শব্দবন্ধ আর দৃশ্যের কথা যখন আপনি আবার মনে করবেন, আপনার মনে হবে, সেগুলো নিয়ে আপনি আরো ভাবনা-চিন্তা করতে চান, আরো সময় নিয়ে। মনে মনে আপনি অন্যান্য শব্দবন্ধ অন্যান্য দৃশ্য নিয়ে, পুরো নাটকটা নিয়ে ভাবতে থাকেন... নাটকটা আবার পড়তে চান আপনি – আর তখন আপনি উপরিতলের নীচে লুকিয়ে থাকা গভীরতা উপলব্ধি করেন।
চেখভ ‘অপ্রত্যক্ষ ক্রিয়া’-র (ইনডিরেক্ট অ্যাকশন) কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন: গুরুত্বপূর্ণ নাটকীয় ঘটনাগুলো ঘটে মঞ্চের বাইরে (গ্রীক ট্র্যাজেডিগুলোর মতন অনেকটা), এবং সেগুলো অনুভব করা যায় বা দেখা যায় সেসব ঘটনার প্রেক্ষিতে নানান চরিত্রের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এবং এই প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রমাণ রয়ে যায় অভ্যন্তরীণ সংলাপের মধ্যে; অর্থাৎ আপাতভাবে দুজনের কথোপকথনে দুজনের তারা সংলাপে অংশ নিচ্ছে না, বরং দুটো স্বগত সংলাপ বা মনোলগে যোগ দিচ্ছে, অর্থাৎ তাদের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে না, বরং তারা এক অন্যের কাছে তাদের ভেতরের সত্তাকে প্রকাশ করছে যা পরস্পরের কাছে লুকানো ছিল । দুই স্তর বিশিষ্ট বাচন (স্পীচ) হচ্ছে চরিত্র-উন্মোচনকারী আরেকটি কৌশল যেখানে কণ্ঠের একটি স্বরে বাইরের চিন্তার প্রকাশ ঘটানো হয়, আর অন্যদিকে মনের কথা বা চিন্তা-ভাবনা সরাসরি প্রবাহিত হয় নিম্ন কণ্ঠে (sotto voce), সঙ্গে থাকে মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন।
প্রাক-চেখভীয় রুশ নাটকে দেখা যেত পাত্র-পাত্রীর জীবনে একের পর এক একটি ইমোশনাল সংকট আসছে যাচ্ছে আর আর দর্শকদের সামনে ক্রমাগম মারামারি, ঝগড়াঝাটি, স্বীকারোক্তি, ব্যভিচার, আত্মহত্যা, খুন, বা সেরকম কিছু উপস্থাপিত হচ্ছে। তাঁর ১৮৮৭ সালে লেখা একটি বিখ্যাত চিঠিতে তিনি বলছেন:
একটা দাবি করা হয় যে নায়ক–নায়িকাকে নাটকীয়ভাবে কার্যকর হতে হবে। কিন্তু মুশকিল হলো, বাস্তব জীবনে লোকে সর্বক্ষণ এক অন্যকে গুলি করে না, নিজেদের ফাঁসীতে চড়ায় না, বা সর্বক্ষণ প্রেম নিবেদন করে না, বা সারাক্ষণ তারা মজার মজার কথা বলে না। তারা খায়, পান করে, খুনসটি করে, বোকা বোকা কথা বলে—আর মঞ্চে এ-ধরনের জিনিস-ই দেখানো উচিত। এমন নাটক লেখা উচিত যেখানে লোকে আসাযাওয়া করে, নৈশ ভোজ সারে, আবহাওয়া নিয়ে কথা বলে, তাস পেটায়। বাস্তবে জীবন যেমন নাটকেও জীবন ঠিক তেমনই হতে হবে। আর মানুষ হিসেবেও তাদের তেমনই দেখাতে হবে বাস্তবে তারা যেমন – রণ-পা পরা নয়। মঞ্চে সবকিছু তেমনই জটিল ও সরল হোক যেমন জটিল আর সরল সেগুলো জীবনে।
বহু বছর লেগেছে চেখভের নাটকে এই বাস্তবাদের প্রতিফলন ঘটাতে, জীবন যেমন ঠিক সেভাবে তা প্রতিফলিত করতে, তাঁর প্রথম দিকের নাটকের প্রকাশ্য বা প্রত্যক্ষ মেলোড্রামা ঝেড়ে ফেলতে।
তিন বোন-এর চরিত্রদের মধ্যে -- তিন বোন ওলগা, মাশা ও ইরিনা, আর তাদের ভাই আন্দ্রেই -- এদের অসাধারণত্ব কিছু নাই। তাঁরা সঙ্গীত শিল্পী বা সঙ্গীতজ্ঞ নয়, চিত্রশিল্পী নয়, নয় কোনো মহা পণ্ডিত। ভূমিদাসের মালিকানার অধিকারী পরিবারগুলোর সন্তান হিসেবে তাদের অনেকেই অপরিসীম অবসরের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। আর সেটা সবচাইতে প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে প্রথম অঙ্কে তুজেনবাখের কথায়:
কাজের জন্য এই ব্যাকুলতা! ...ঈশ্বর! ব্যাপারটা আমি কি ভালো করেই না বুঝতে পারি। জীবনে একটা কুটো্ও নেড়ে দেখিনি আমি। আমার জন্ম পিটার্সবার্গে, বিরূপ অলস একটা শহরে, আর জন্মেছিলাম এমন একটা পরিবারে যেখানে কাজ আর দুশ্চিন্তা বলতে কী বোঝায় সে-ব্যাপারে কারও বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। এক চাকরের কথা মনে আছে, আমি ক্যাডেট স্কুল থেকে ফিরে এলে সে টেনে আমার জুতো খুলে দিত... যেভাবে সে কাজটা করত তাতে আমি রাগে গজগজ করতাম, আর আমার মা স্নেহভরে চেয়ে থাকতেন, এবং অন্যরা যখন ব্যাপারটাকে ভিন্ন চোখে দেখত তিনি সেটা ঠিক বুঝতে পারতেন না। কাজ থেকে কী সযত্নেই না আড়াল করে রাখা হয়েছিল আমাকে!’
এই ভদ্দরলোক, নিষ্কর্মা শ্রেণীর শেষ সময় যেন সমাগত। সেই একই সংলাপে তুজেনবাখ বলে: ‘সময় হয়ে এসেছে -- ভয়ংকর একটা কালো মেঘ এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।’ তাদের এই ঝড়টাকে সামলাতে না পারা নিয়েই মূলত চেখভের নাটক তিন বোন। তবে এই চরিত্রগুলো প্রমাণ আকারের না হলেও তাদের আত্মম্ভরিতা তাদেরকে একে অপরের দুখে সহানুভূতি প্রদর্শন করতে বাধা দেয়।
কোনো কোনো সমালোচক লেখকের এই দর্শনের পেছনে ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী আবিষ্কার করলেও চেখভ যে সেরকম কিছু মনে করতেন সে-ব্যাপারে কোনো জোরোলো সমর্থন পাওয়া যায় না।
তলস্তয় শেক্সপীয়রের নাটক পছন্দ করেননি। চেখভের নাটকের ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য ছিল এই যে সেগুলো শেক্সপীয়রের নাটকের চাইতেও খারাপ। আর চেখভের জীবদ্দশায় তাঁর রচনা ব্রিটিশ এবং আইরিশ সমালোচকদের কাছে তেমন সমাদর পায়নি। তাঁর মৃতুর পর তিনি পুনর্মূল্যায়িত হন। কন্সটান্স গারনেটের অনুবাদের মাধ্যমে তিনি ইংরেজভাষী পাঠকের মন জয় করেন এবং জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ ও ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের মতো লেখকের কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠেন। ম্যান্সফিল্ডের ছোট গল্প ‘দ্য চাইল্ড হু ওয়ায টায়ার্ড’ চেখভের ‘স্লিপী’ গল্পের বেশ কাছাকাছি। রুশ বিপ্লবের অব্যবহিত পরবর্তীকালে চেখভের নাটক ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আউট অভ ফ্যাশন’ হয়ে পড়লেও কিছুদিন পর সেগুলো সোভিয়েত ক্যাননভুক্ত হয়।
৫.
বাংলা ভাষায় আন্তন চেখভের সাহিত্য পাঠের প্রসঙ্গ এলে অবশ্যম্ভাবীভাবে বাংলা ভাষায় সোভিয়েত বা রুশ সাহিত্য অনুবাদের কথা না এসে পারে না। তার কারণ বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে রুশ ভাষায় রচিত সৃজনশীল এবং মননশীল রচনা একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে, এবং এসব রচনার সঙ্গে অযুত বাঙালির রয়েছে আবেগ আর স্মৃতিকারতার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত অনুবাদক অরুণ সোমের ‘প্রগতির পথরেখা’ নামের একটি লেখা (৩০.০১.২০১৪) থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করা যাক:
১৯৩১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রকাশন সমিতির উদ্যোগে বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় সোভিয়েত সাহিত্যের এবং রুশ ভাষায় বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ — মূলত মানববিদ্যা সংক্রান্ত এবং সর্বোপরি ভাবাদর্শগত গ্রন্থাদি প্রচারের উদ্দেশ্যে মস্কোয় ‘বিদেশী শ্রমজীবীদের প্রকাশন সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে সংস্থাটি নাম বদল করে ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ এবং ১৯৬৩ সাল থেকে ‘প্রগতি প্রকাশন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্য এবং আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রন্থাদির অনুবাদ ছাড়াও সোভিয়েত তথা রুশ সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রচারও ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ এবং ‘প্রগতি’র অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত অনুবাদের অন্তত এক-চতুর্থাংশ হত সোভিয়েত ও রুশ সাহিত্যের; আবার তার সিংহভাগ ছিল শিশু ও কিশোর সাহিত্যের, যেহেতু শিশু ও কিশোর মনে নির্দিষ্ট কোন ভাবাদর্শ গাঁথা হয়ে গেলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সুদূরপ্রসারী হওয়া খুবই সম্ভব। প্রকাশের তৃতীয় স্থানে থাকত রুশ ও সোভিয়েত ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ।
তবে বাঙালির কাছে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আদরের ছিল ছোটদের বই। ১৯৮২ সালে প্রগতি প্রকাশনার একটি শিশু বিভাগ গড়ে ওঠে, নাম ‘রাদুগা’। রুশ ভাষায় যার অর্থ রামধনু। ‘দাদুর দস্তানা’, ‘নাম ছিল তার ইভান’, ‘রুপোলী খুর’, ‘পীত দানবের পুরী’, ‘মোরগছানা’, ‘বাহাদুর পিঁপড়ে’, ‘আলতাজবা’— নামে আর বিষয়বস্তুতে বাঙালিয়ানা মাখা রঙিন বইগুলো ঘুরত বাচ্চাদের হাতে হাতে।”
… আজ দু’দশকের বেশি সময় হতে চলল (এখন ২০২৪। তার মানে তিন দশকের বেশি।--জি এইচ হাবীব) ‘প্রগতি’ বা ‘রাদুগা’ অতীতের বস্তু। আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্ম ‘প্রগতি’ বা ‘রাদুগা’ থেকে প্রকাশিত সেই সমস্ত অনুবাদের সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নয় — অনেকে তাদের নাম পর্যন্ত শোনেনি।”
এই বইগুলোর বিষয়, অনুবাদ ইত্যাদির ব্যাপারে একটা সাধারণ মুগ্ধতার বাইরে কিছু সমালোচনা হয়ত অনেকেরই আছে। কিন্তু যে ব্যাপারে নিরঙ্কুশ ভালো লাগা এই অনুবাদকের আছে তা হলো বাংলা অনুবাদগুলো শিরোনামের বঙ্গীকরণ, এবং টাইপোগ্রাফি, অলংকরণ আর অঙ্গসজ্জা। আর এই সুযোগে সেই অসামান্য সময়ের বরেণ্য সব অনুবাদকদের নামগুলোও একটু মনে করা যাক:
অনিমেষকান্তি পাল, অভিজিৎ পোদ্দার, অরুণ দাশগুপ্ত, অরুণ সোম, ইলা মিত্র, কানাইলাল মুখোপাধ্যায়, কান্তি চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা রায়, ক্ষিতীশ রায়, খালেদ চৌধুরি, গিরীন চক্রবর্তী, ছবি বসু, দেবী শর্মা, দ্বিজেন শর্মা, ননী ভৌমিক, নীরেন্দ্রনাথ রায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, পুষ্পময়ী বসু, পূর্ণিমা মিত্র, প্রদ্যোৎ গুহ, প্রফুল্ল রায়, ফল্গু কর, বদরুল হাসান, বিজয় পাল, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, মাহবুবুল হক, রবীন্দ্র মজুমদার, রাধামোহন ভট্টাচার্য্য রেখা চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর রায়, ডাঃ শান্তিকান্ত রায়, শান্তিশেখর সিংহ, শিউলি মজুমদার, শুভময় ঘোষ, শৈলেন দত্ত, সত্য গুপ্ত, ডাঃ সন্তোষ ভট্টাচার্য, সমর সেন, সিদ্ধার্থ ঘোষ, সুপ্রিয়া ঘোষ, সুবীর মজুমদার, সেফালী নন্দী, হায়াৎ মামুদ, হীরেন্দ্রনাথ সান্যাল, প্রমুখ।
বিখ্যাত প্রগতি বা রাদুগা থেকে বের হয়েছিল ননী ভৌমিকের অনুবাদে (মূল রুশ থেকে) কাশতানকা। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলম থেকে এসেছিল চেখভের সাতটি একাঙ্কিকার অনুবাদ। নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজ উদ্দিন আহমেদের চমৎকার অ্যাডাপ্টেশনে চেখভের দ্য বেয়ার হয়েছে ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’; দ্য জুবিলি, বুড়িগঙ্গার সিলভার জুবিলী; দ্য প্রপোজাল, এই রোদ এই বিষ্টি; এবং দ্য সোয়ান সং, যামিনীর শেষ সংলাপ। শেখভের গল্প (১৯৬৯) কবীর চৌধুরীর অনুবাদ গ্রন্থের নাম শেখভের গল্প। মোবারক হোসেন অনুবাদ করেছেন নাটক ইভানভ। সুঅভিনেতা এবং শিক্ষক এনামুল হক অনুবাদ করেছেন চেখভের দুটি নাটক দ্য চেরি অর্চার্ড , এবং দ্য সী গাল। শেষোক্ত নাটকটি অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ-ও অনুবাদ করেছেন।
৬.
সাহিত্যে নোবেলজয়ী সীমাস হিনি চেখভের শাখালিন ভ্রমণে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন: ‘চেখভ ইন শাখালিন’। আর নাট্যকার, অনুবাদক ও সাহিত্য সমালোচক ক্যারল রোকামোরা চেখভ আর তাঁর স্ত্রী ওলগা নীপারের পত্রালাপের ওপর ভিত্তি ক’রে রচনা করেছেন চার অংকের একটি নাটক আন্তন চেখভ: আ লাইফ ইন ফোর অ্যাক্টস (২০০১)। থিয়েটার-শিল্পী, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষার্থী, দর্শক, এবং চেখভের অসামান্য নাটকগুলোর রহস্য যাঁরা আবিষ্কার করতে চান তাঁদের জন্য রোকামোরার নাটকটি একটি অতি মূল্যবান উৎস।
যেসব গ্রন্থ বা সূত্র থেকে অকাতরে সাহায্য নেয়া হয়েছে:
১. ম্যাকগ্র-হিল ইনকরপোরেট প্রকাশিত MCGRAW-HILL ENCYCLOPEDIA OF WORLD DRAMA: AN INTERNATIONAL REFERENCE WORK IN FOUR VOLUMES: VOL 1, EDITED BY BERNARD DUKORE (১৯৭২)
২. ANTON CHEKHOV: SELECTED WORKS, VOL.2, PLAYS. TRANSLATED FROM THE RUSSIAN BY KATHELEEN COOK. PROGRESS PUBLISHERS, MOSCOW, 1973 (FIRST PRINTING)
৩. ANTON CHEKHOV: PLAYS. TRANSLATED, WITH AN INTRODUCTION BY ELISAVETA FEN. (PEN NAME OF LYDIA JIBURTOVICH-JACKSON), PENGUIN BOOKS
৪. THE MAJOR PLAYS OF CHEKHOV BY JANE WEXFORD, MONARCH PRESS, INC, 1965
৫. ANTON CHEKHOV: A LIFE BY DONALD RAYFIELD. FABER AND FABER, 2000
৬. ‘CHEKHOV’S BEAUTIFUL NONFICTION’ BY AKHIL SHARMA, FEBRUARY 2, 2015, THE NEW YORKER
৭. ‘CRIME OR PUNISHMENT: RUSSIAN NARRATIVES OF INCARCERATION’ BY JOSÉ VERGARA
৮. HTTPS://SOVIETBOOKSINBENGALI.BLOGSPOT.COM/P/BLOG-PAGE.HTML