তারা তাদের লুটপাটকে ঢাকতে আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে আমাদেরকে গ্রহছাড়া করে চলেছে।
Published : 07 Jun 2024, 01:04 PM
৫ জুন ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। অন্যভাবে, এটিকে যদি বিশ্ব হত্যা দিবস বলা হয়, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? পৃথিবী তার স্থির জীবন চিত্র আঁকছে, বন মারা যাচ্ছে, মেরু অঞ্চল গলে যাচ্ছে, বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে, পানি বিষ হয়ে যাচ্ছে....। আমরা সবাই কম-বেশী জানি যে ভোগবাদ পৃথিবীকে নিঃশেষ করে চলেছে। কিন্তু আমরা যেটি জানিনা সেটি হল, আমরা যে গ্রহে বাস করি তার কত শতাংশ মানুষ এই পুঁজিবাদী, ভোগবাদী ব্যবস্থার চিপায় পড়ে টিকে থাকতে সক্ষম হব? যখন গ্রহটির জল, ভূমি, বায়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখন আমরা কোথায় যাব? লুনার ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানী ইতিমধ্যে চাঁদে জমি বিক্রি করা শুরু করেছে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে, রাশিয়ান কোটিপতি রোমান আব্রামোভিচ তার হবু পত্নিকে চাঁদের একটি ছোট প্লট উপহার দিয়েছিলেন!
“প্রকৃতি যদি একটি ব্যাংক হতো, তবে সেটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইতিমধ্যে সব কিছুই করা হতো।” কিংবা “দুর্যোগকে প্রাকৃতিক বলা হয়, যেন প্রকৃতিই একটা জল্লাদ, শিকার নয়।” লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গালেয়ানোর এই বিখ্যাত উক্তিগুলি বার বার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও কিংবা প্রকৃতির গর্ভে বেড়ে উঠেও তার উপর কী সীমাহীন অত্যাচারই না জারি রেখেছি।
২০ই এপ্রিল ২০১০। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের আহবানে, কোচাবাম্বাতে অনুষ্ঠিত “জলবায়ু পরিবর্তন ও জন্মদাত্রী পৃথিবীর অধিকার” সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পাঠ করে শোনান এদুয়ার্দো গালেয়ানোর পাঠানো একটি চিঠি।
গালেয়ানোর চিঠির শিরোনাম ছিল এ রকম: মানুষের অধিকার আর প্রকৃতির অধিকার, সমমর্যাদার দু’টি নাম। ১৪ বছর আগে লেখা গালেয়ানোর সেই চিঠিটি ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করেছেন অনুবাদক আসাদ মিরন।
“দুর্ভাগ্যক্রমে, যাত্রার প্রাক্কালে এমন কিছু উদয় হয়েছে, যে কারণে আমি আপনাদের সাথে থাকতে পারছিনা। তা সত্ত্বেও আমি যে কোনভাবে, আপনাদের এই অনুষ্ঠানের অংশ হতে চাই। এই অনুষ্ঠানে, আমি যা করতে পারি তা খুবই নগণ্য, এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই।
আর, না থেকেও সেখানে থাকার জন্য, নিদেনপক্ষে আমি এই কথাগুলি আপনাদের নিকট পাঠাচ্ছি।
আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই: যা কিছু সম্ভব, এমনকি তা অসম্ভব হলেও সেটি করা হোক। যেন এই সম্মেলন হতে পারে সেই সব জনগণের সম্মিলিত অভিব্যক্তির প্রথম পদক্ষেপ যারা নেতৃত্ব দেয় না, কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির কারণে ভোগে।
আমি আশা করি, যুদ্ধ ও বর্জ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত যে ক্ষমতাতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের জীবনকে অবজ্ঞার মাঝে আটকের রাখে এবং আমাদের পার্থিব সম্পদের উপর নিলামের পতাকা ঝুলিয়ে দেয়, তার বিরুদ্ধে আমাদের কমরেড ইভোর প্রস্তাব: জলবায়ু পরিবর্তনের উপর একটি বৈশ্বিক গণভোট এবং জলবায়ু বিচার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা, এই দুটি উদ্যেগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবো।
আমি এটাও আশা করি, আমরা কথা কম বলে বেশী কিছু করতে সক্ষম হব। বিতর্কিত কর্মস্ফীতি আমাদের সীমাহীন ক্ষতি করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে, যা লাতিন আমেরিকার আর্থিক মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও ভয়াবহ। তাছাড়া, আমরা সর্বোপরি ধনী দেশগুলির ভন্ডামিতে বিরক্ত। তারা তাদের লুটপাটকে ঢাকতে আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে আমাদেরকে এই বাসযোগ্য গ্রহছাড়া করে চলেছে।
কেউ কেউ বলেন, ভন্ডামি হল সেই শ্রদ্ধাঞ্জলী যেখানে পাপকে পূণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ভন্ডামিই অসীমের অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ। এবং তথাকথিত লগোরিয়া বা বাচাল “আন্তার্জাতিক সম্প্রদায়ের” ব্যাংকার ও সৈন্যদের ক্লাব, প্রমাণ করে যে এই দু’টি সংজ্ঞাই সঠিক।
আমি উদযাপন করতে চাই। কেননা, সত্যের শক্তি প্রকৃতির সাথে মানুষের মিলনে জন্ম নেয়া শব্দ এবং নীরবতা থেকে বিচ্ছুরিত হয়। আর এটা কোন দুর্ঘটনা নয় যে এই মাদার আর্থ সম্মেলন বলিভিয়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কেননা, এটি হল সেই জাতিসত্তার দেশ, যে দুই শতাব্দী মিথ্যে জীবনযাপনের পর নিজেকে আবিষ্কার করেছিল।
বলিভিয়া সবেমাত্র জলযুদ্ধে জনগণের বিজয়ের দশম বার্ষিকী উদযাপন করেছে। কোচাবাম্বার মানুষরা জিতেছিল। তারা ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সর্বশক্তিমান কর্পোরেশনকে পরাজিত করতে পেরেছিল। বলিভিয়ার জলের মালিক এমন একটি সরকারকে ধন্যবাদ, যারা নিজেদের বলিভিয়ান বলে দাবী করেছিলেন কিন্তু বিনিয়োগকারীদের প্রতি খুবই উদার ছিলেন।
এই জলযুদ্ধ ছিল এমনই এক যুদ্ধ যেখানে স্বদেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল- অন্যকথায়, প্রকৃতির সাথে তার অভিন্নতা রক্ষায়।
অতীতের কন্ঠস্বর আছে যে ভবিষ্যতের সাথে কথা বলে।
বলিভিয়া হলো আমেরিকান দেশগুলির মধ্যে একটি যেখানে আদিবাসী সংস্কৃতিগুলি টিকে থাকতে পেরেছে। আর দীর্ঘদিন ধরে তিরস্কার ও নিপীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তাদের কন্ঠস্বর এখন আগের চেয়ে আরও বেশী জোরে বেজে উঠছে।
সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত, ক্রসফায়ারের মাঝখানে তারা অন্ধের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই কন্ঠস্বর শুনতে হচ্ছে। তারা আমাদের শেখায় যে মানুষ নামক ক্ষুদ্র প্রাণীরা প্রকৃতির অংশ, যাদের পা, থাবা, ডানা বা শিকড় রয়েছে তাদের সকলের আত্মীয়। ইউরোপ বিজয়ীরা আদিবাসীদের অপরাধী বলে রায় দিয়েছিল। কারণ, তারা প্রকৃতির সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতো, মূর্তি পূজা দিত। সম্প্রদায়ের এ ধরণের বিশ্বাসের কারণে তাদের বেত্রাঘাত করা হয়েছিল, গলা কেটে ফেলা হয়েছিল কিংবা জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় থেকেই, প্রকৃতিকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে কিংবা মানুষের অগ্রগতির পথে একটি বাধা হিসেবে ধরা হয়েছে। আর সেই থেকে আজও অবধি তার সাথে আমাদের এই বিচ্ছেদ পর্ব অব্যাহত আছে। এই বিচ্ছেদের ব্যাথা এতটাই তীব্র যে এখনও ভালো মনের কিছু মানুষ আছে, যারা দুর্ভাগা প্রকৃতির দ্বারা তাড়িত হয় এবং সীমাহীন নির্যাতন, আঘাত সহ্য করেও তাকে কেবল দূর থেকে দেখে যায়।
আদিবাসী সংস্কৃতি তাকে ভেতর থেকে দেখে। তার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পাই। তার বিরুদ্ধে যা করা হয়েছে, তা আমার বিরুদ্ধে করা হয়েছে। তার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, আমার পা হল সেই পথ, যে পথে তারা হাঁটে।
তাহলে আসুন, আমরা এই মাদার আর্থ সম্মেলন উদ্যাপন করি। এবং বধিররা শুনুক: মানুষের অধিকার এবং প্রকৃতির অধিকার, সমমর্যাদার দু’টি নাম।
মন্টিভিডিও থেকে ডানায় মেলে দিলাম আমার আলিঙ্গন। গ্রহণ করুন।
এদুয়ার্দো গালেয়ানো, ২১শে এপ্রিল, ২০১০