বিশ্ব

বিশ্বকে বদলে দেওয়া ১০০ দিন

Byবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

তার মধ্যেই ফেলে আসা দিনগুলোর খেরোখাতা লেখা হচ্ছিল পত্রিকায়। বলা হচ্ছিল, গৃহযুদ্ধ, শরণার্থী সঙ্কট, সোশাল মিডিয়ার উত্থান, দেশে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের মত ঘটনাগুলো, যা কিনা গত এক দশকে বিশ্বের মানুষের বেদনাদায়ক অর্জন, সেগুলো নতুন বছরেও মাথাব্যথার বড় কারণ হবে।  

যারা সেসব লিখেছিলেন, তারা আসলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন ব্ড্ড তাড়াতাড়ি।

বছরের শেষ দিনটির শেষ মুহূর্তগুলোতে দেশে দেশে মানুষ যখন অধীর হয়ে রাত ১২টা বাজার অপেক্ষা করছে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ২০১০ এর দশকের সবচেয়ে বড় ঘটনাটির অঙ্কুরোদগম ঘটে গেছে, যার জের এই পৃথিবীকে টানতে হবে বহু বছর।

৩১ ডিসেম্বর বেলা ১টা ৩৮ মিনিটে চীনা একটি সরকারি ওয়েবসাইটে জানানো হল, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর উহানে একটি হোলসেল সি ফুড মার্কেট এলাকায় নতুন ধরনের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঘট্না ধরা পড়েছে, তবে সংক্রমণের কারণ জানা যায়নি।

চীনের বাইরে বাকি বিশ্বে ওই খবর একদমই গুরুত্ব পায়নি তখন।

কিন্তু এরপর ১০০ দিনে মানুষের মুখের হাসি মুছে গিয়ে সেখানে ভর করেছে তীব্র আতঙ্ক, মৃত্যুভয়। খালি চোখে দেখা যায় না, এমন এক ভাইরাস ভোজবাজির মতো পাল্টে দিয়েছে পৃথিবীর চেহারা।

সেই ভাইরাস আন্তর্জাতিক যোগাযোগ একপ্রকার অচল করে দিয়েছে; থামিয়ে দিয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে যার যার ঘরের মধ্যে।  

এক কোটি ১০ লাখ মানুষের শহর উহান থেকে ছড়ানো সেই নভেল করোনাভাইরাসের ছোবলে প্রায় পুরো পৃথিবী এখন মৃত্যুপুরীর চেহারা পেয়েছে।

১০০ দিনে সেই ভাইরাসের শিকার হয়েছে ১৪ লাখের বেশি মানুষ, প্রাণ গেছে ৮২ হাজার মানুষের। এই সংখ্যাগুলো স্থির নেই, বাড়ছে প্রতি মিনিটে।

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও বড় অসহায় এই ভাইরাসের কাছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধীকারী, ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্টও সংক্রমণ এড়াতে পারেননি।

২০২০ সালের প্রথম প্রহরে মানুষ যখন আতশবাজির খেলা আর পার্টিতে মেতে উঠেছিল, এর সবকিছুই ছিল তাদের কল্পনারও অতীত।

একটি ভাইরাস কীভাবে মাত্র ১০০ দিনে মানুষের চেনা পৃথিবীকে বদলে দিল, তার একটি ক্রমপঞ্জি তৈরি করার চেষ্টা করেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে গার্ডিয়ানের মাইকেল সাফি।

 

জানুয়ারি

উহানের সি ফুড মার্কেটটি ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম থাকে বরাবরই। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম দিনটি ছিল অন্যরকম। সেদিন সকালে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বাজারের চারদিকে টেপ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। দোকানগুলো বন্ধের তাগাদা দিতে দেখা গেল পুলিশকে। কিছু কর্মী তখন সতর্কতার সাথে নমুনা সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিচ্ছিলেন।

সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে ঘটনাটি ছড়াতে সময় লাগেনি। এরপর বিপজ্জনক লক্ষণ নিয়ে কিছু রোগীর উহানের হাসপাতালগুলোতে জড়ো হওয়ার খবর উসকে দেয় আতঙ্ক।

সোশাল মিডিয়ার একটি বার্তায় সে সময় লেখা হয়, “সার্স নিশ্চিত, নার্সদের বের হতে দেবেন না।”

আরেকটি বার্তা ছিল এরকম- “আপনার হাত ধুয়ে ফেলুন। মাস্ক। গ্লাভস।”

এখন সবাই জানে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিকল্প নেই; মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভসও এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সোশাল মিডিয়ায় ‘আতঙ্ক’ ছড়ানো ঠেকাতে চীনা কর্তৃপক্ষ সে সময় কঠোর হলেও বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেয় পার্শ্ববর্তী তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং।

ফ্লু’র মতো উপসর্গ থাকায় নতুন এই ভাইরাসটিও সার্সগোত্রীয় বলে ধারণার কথা জানিয়েছিলেন উহানের অপথালমোলজিস্ট লি ওয়েনলিয়াং। সার্সও এক ধরনের করোনাভাইরাস। এর আগে একবার সার্স এবং মিডল ইস্টার্ন রেসপিরেটরি সিনড্রোমের-মার্স নাড়িয়ে দিয়ে গেছে বিশ্বকে। 

জানুয়ারির নবম দিনে এসে চীনা বিজ্ঞানীরা স্বীকার করলেন, উহানের রোগীরা অজ্ঞাত এক করোনাভাইরাসে সংক্রমিত। তাদের ভাষ্যে, নতুন ভাইরাসটিও প্রাণঘাতী।

উহানের হাসপাতালে এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীটিও মারা যান আগের রাতে।

কিন্তু সে সময় কে নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত, কে সাধারণ নিউমোনিয়ার রোগী, তা নির্ধারণ করতে গিয়ে ধন্দ্বে পড়ে যান চিকিৎসকরা। ফলে এরপর চারদিনে নতুন রোগী পাওয়ার কথাও জানা যায়নি।

উহান কর্তৃপক্ষ এরপর এক সপ্তাহ চুপচাপ থাকলেও ভাইরাসটি ততদিনে পা রেখেছে চীনের গণ্ডির বাইরে। মাসের মাঝামাঝিতে (১৩ জানুয়ারি) থাইল্যান্ডে নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়।

মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়ার দাবি তখনও করে আসছিল চীন সরকার। ডব্লিউএইচওর বিবৃতিতেও একই কথা বলা হচ্ছিল।

বিশেষজ্ঞরা আশায় বুক বাঁধছিলেন। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক ব্যাধির অধ্যাপক গুয়ান ওয়াই তো নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেও দিয়েছিলেন যে, যদি আগামী কয়েকদিনে নতুন কেউ আক্রান্ত না হলে বলা যাবে যে এর প্রাদুর্ভাব কেটে গেছে।

কিন্তু উহানের চিকিৎসকরা দেখছিলেন ভিন্ন চিত্র। জানুয়ারির প্রথম ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে হাসপাতালগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পাচ্ছিল, যাদের সেই সি ফুড মার্কেটের সাথে যোগাযোগই ছিল।

এক সপ্তাহের মধ্যেই চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে খারাপ খবর নিয়ে হাজির হন দেশটির নামকরা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ জং ন্যানশান। ২০ জানুয়ারি তিনি খবর দেন, উহানের বাইরে গুয়াংডং প্রদেশেও ভাইরাসে আক্রান্ত দুজনকে পাওয়া গেছে।

“আমরা এখন বলতে পারি, এটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়,” প্রথমবারের মত স্বীকার করেন চীনা সরকারের ঘনিষ্ঠ এই বিশেষজ্ঞ।

এরপর ধীরে ধীরে বেইজিং, সাংহাই ছাড়াও চীনের অন্যান্য স্থানে সংক্রমণের খবর আসতে থাকে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায় নতুন ভাইরাসের অস্তিত্ব।

ওই সময়ই উহানফেরত এক ব্যক্তি কাশি আর তীব্র জ্বর নিয়ে ওয়াশিংটনের একটি ক্লিনিকে ভর্তি হন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনিই নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী।

চার দিন পর, ২৪ জানুয়ারি, চীনা নববর্ষের ছুটির আগের দিন অবরুদ্ধ করে ফেলা হয় উহান। বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের যানবাহন। ততদিনে শহরটিতে আক্রান্তের সংখ্যা আটশ ছাড়িয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের।

 

ভাইরাসের আগ্রাসী ছোবলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে উহান। আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলোতে দেখা দেয় প্রচণ্ড চাপ। শহরের সব বাসিন্দাকে বাধ্য করা হয় হোম কোয়ারেন্টিনে যেতে।

একদিনের মধ্যেই সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি মানুষকে অবরুদ্ধ করা হয় দেশটিতে। প্রথমবারের মত ‘সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে’ পড়ার কথা বলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

জানুয়ারির ওই সময়েই ভাইরাসটির ইউরোপে পৌঁছার খবর মেলে। ফরাসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী চীন থেকে ফেরা দুইজন এবং তাদের এক আত্মীয়র আক্রান্তের খবর দেন।

অন্যদিকে দুদিন আগেই দাভোসে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে চিন্তিত নন।

চার বছর ধরে পার্লামেন্টে বিস্তর বিতর্কের পর জানুয়ারির শেষ দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায় ব্রিটেন।

তবে দিনটি করোনাভাইরাসের কারণেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই সময়েই যুক্তরাজ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়। স্পেন, ইতালিতেও প্রথম রোগী ধরা পড়ে। দুটি দেশই এখন ভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত।

করোনাভাইরাস চীনের বাইরে তখনও কোনো মৃত্যুর কারণ না হলেও চীনে মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছিল।

ওই সময় চীন সফর করা লোকজনের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা নিষিদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ফেব্রুয়ারি

চীনের বাইরে করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ৪ ফেব্রুয়ারি, ফিলিপিন্সের ম্যানিলায়। চীন থেকে কারও দেশটিতে ঢোকার পথও বন্ধ হয়ে যায়।

ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক বললেন, করোনাভাইরাস মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, তবে চীন ভালোই লড়াই করছে। যেহেতু বিশ্বজুড়ে রোগটি ছড়ানোর মাত্রা চীনের মত অতটা নয়, তাই বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণার সময় আসেনি। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার শঙ্কা থাকলেও ব্যবসা বা ভ্রমণ বন্ধ রাখার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

উহানের যে চিকিৎসক প্রথম এই ভাইরাসের বিষয়ে সহকর্মীদের সতর্ক করেছিলেন, সেই লি ওয়েনলিয়া নিজেই আক্রান্ত হয়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় চলে যান। তিন দিনের মধ্যে তার মৃত্যু চীনজুড়ে শোক আর ক্ষোভের জন্ম দেয়।   

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন- সিডিসি পরদিন দেশজুড়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট সবরাহ শুরু করে। কিন্তু সেই কিট দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ফলে ওই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি যেখানে প্রতিদিন ১২ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে পেরেছে, সেখানে কিটের অভাবে যুক্তরাষ্ট্রে এক মাসে মাত্র ১২০০ নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

সে সময় করোনাভাইরাসে প্রাদুর্ভাব কমার ‘আবহাওয়া তত্ত্ব’ নিয়ে হাজির হন প্রেসিডেন্ট ট্রাস্প। নিউ হ্যাম্পশায়ারের এক সমাবেশে তিনি বলেন, “এপ্রিলে যখন কিছুটা গরম পড়বে, তখন এটা চলে যাবে।”

এ মাসেই ইরানের ‘পবিত্র শহর’ কোম-এ প্রথম দুজনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে।

মাসের শেষ দিকে (২৫ ফেব্রুয়ারি) সারাবিশ্বে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। চীনের বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।

চারদিনের মধ্যে ইতালিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয় ১১। ইউরোপের মধ্যে এ দেশটিতেই প্রথম ৫০ হাজার মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়।

ওই সময় চীনের বাইরে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল ইরানে। দেশটির উপ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইরাজ হারিসিসহ নেতৃস্থানীয় আরও কয়েকজনও ততদিনে আক্রান্ত হয়েছেন।

মার্চ

করোনাভাইরাসের বিস্তার ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে ইতালিতে। মাত্র ছয়দিনে মৃত্যুর হার ছয়গুণ বেড়ে যায়।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে (৬ মার্চ) দেশটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩০ এ। ইতালিতে দৈনিক গড়ে ১২০০ জনের দেহে ভাইরাস শনাক্ত হতে থাকে।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় বন্ধ করে দেওয়া স্কুল, সিরি-আ’র ফুটবল ম্যাচে দর্শকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, অবরুদ্ধ করে ফেলা হয় লমবার্ডি।

ব্রিটেনে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মারা যান ৭০ বছর বয়সী এক নারী। এরপরই ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বলা হয়, ভাইরাসটি বেশ ভালোভাবেই ছড়াচ্ছে।

অথচ এর তিনদিন আগেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছিলেন, আগের রাতে তিনি একটি হাসপাতালে গিয়ে কয়েকজনের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন, যেখানে করোনাভাইরাসের রোগীও থাকতে পারে। সেই জনসনই এখন ভাইরাসে আক্রান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে মার্চের মাঝামাঝিতে (১১ মার্চ) করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। ততদিনে সারাবিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে।

একদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, অন্যদিকে তেলের দাম নিয়ে সৌদি-রাশিয়ার লড়াই- দুইয়ে মিলে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় ধস নামে বিশ্ব পুঁজিবাজারে। 

এ মাসেই ইতালিতে একদিনে ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়, যা বিশ্বের যে কোনো জায়গার চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতি ডব্লিউএইচও ঘোষণা করে, সারাবিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।

ইউরোপের দেশগুলো একের পর এক নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দিতে থাকে। পুরো বিশ্বেই শুরু হয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের মড়ক। সময়টিকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সাথে তুলনা করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। 

ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসতে থাকে আক্রান্ত, মৃত্যু আর নতুন নতুন নতুন এলাকা অবরুদ্ধ করার খবর। ততদিনে করোনাভাইরাস হাজির হয়েছে আফ্রিকাতেও।

এক সপ্তাহের মধ্যে আফ্রিকায় আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়ায়। আর বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা তখন এক লাখ ৬০ হাজারের ওপরে।

এর পর মাত্রা ছয় দিনে (২৩ মার্চ) বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছায় তিন লাখ ৭০ হাজারে।

এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রয়োজনীয় নয় এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানান।

চীন, ইতালির পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় স্পেনে। সেখানে এক দিনেই রেকর্ড ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্কের অবস্থা ক্রমেই নাজুক হতে থাকে।

তবে এই সময়ে চীন পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে নিতে সক্ষম হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহের একটি দিনে কোনো নতুন রোগী পায়নি চীন।

সাড়ে তিন বিলিয়ন মানুষের দেশ ভারতেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে শুরু হয় লকডাউন। অফিস-আদালত আর যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে ঘরে থাকার নির্দেশনা আসে বাংলাদেশেও। এখনও সেই অবরুদ্ধ দশা চলছে।

এপ্রিল

এ মাসের শুরুতে (২ এপ্রিল) জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়ানোর খবর দেয়, আর মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৫০ হাজার।

নতুন আক্রান্তদের তালিকায় চলে আসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসনের নাম। পরিস্থিতি খারাপ হলে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়।

ভারতের মুম্বাইয়ের একটি বস্তি এলাকায় দ্বিতীয় আরেকজন দেহে ভাইরাস শনাক্তের পর সংক্রমণ ব্যাপক মাত্রা পাবে বলে শঙ্কা তৈরি হয়।

অন্যদিকে স্পেনে একদিনে ৯৫০ জনের মৃত্যু হয়, যা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে কর্মহীন পড়া মানুষের সংখ্যাও হু হু করে বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে ৬৬ লাখ মানুষ বেকার ভাতা পেতে আবেদন করেছেন।

মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপের দেশগুলোতে নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু করে। চীনও প্রথম মৃত্যুহীন দিন দেখে এ সপ্তাহে। দেশটির অবরুদ্ধ এলাকাগুলোও ধীরে ধরে খুলতে শুরু করে।

তিন মাস অবরুদ্ধ দশার পর বুধবার উহান থেকে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়। অন্যদিকে এক দিনেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৮০০ লোকের মৃত্যু হয়, তৈরি হয় নতুন রেকর্ড।

দরিদ্র এবং ঘনবসিতপূর্ণ কিছু দেশে এ ভাইরাসের প্রকোপ এখনও ততটা প্রকোট হয়নি। কিন্তু তারাও যে নিরাপদ থাকতে পারবে, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের গবেষণা চললেও এখনও নভেল করোনাভাইরাসের অনেক কিছুই মানুষের অজানা। এর কোনো প্রতিষেধক বা প্রতিরোধকও মানুষ তৈরি করতে পারেনি।

আর কত মানুষের মৃত্যু দেখার পর, অর্থনীতির কতটা ক্ষতি মেনে নেওয়ার পর পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে- সেই উত্তর এখনও অজানা।

SCROLL FOR NEXT