)
খেলা

আমি চাই বাংলাদেশ বৈচিত্রময় দল হয়ে উঠুক: কাবরেরা

Byমোহাম্মদ জুবায়ের

দুয়ারে কড়া নাড়ছে সিশেলসের বিপক্ষে ম্যাচ। সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হাভিয়ের কাবরেরা। প্রস্তুতি শেষের ক্লান্তি ঝেড়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে মেতে উঠলেন আলাপচারিতায়। আসছে ম্যাচের পরিকল্পনা, কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বাজিমাত, ইউরোপের সফলতম ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের না হয়ে আতলেতিকোর সমর্থক হওয়া-এমন নানা প্রসঙ্গে কথা বললেন।  বাংলাদেশের শিশুদের খেলাধুলায় নেমে পড়ার বার্তা দিতেও ভুললেন না এই স্প্যানিশ কোচ। 

দুই ম্যাচের সিরিজের প্রথম ম্যাচে আগামী শনিবার সিশেলসের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ম্যাচ ২৮ মার্চ। এ উপলক্ষে সৌদি আরবে ১০ দিনের প্রস্তুতি নিয়ে সিলেটে ফিরে ঘাম ঝরিয়ে চলেছেন জামাল-তপুরা। 

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। ফাইন টিউন কতটা হলো? 

হাভিয়ের কাবরেরা: দলের ফাইন টিউন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। ছেলেরা প্রস্তুতির পুরোটা সময় খুব খুশি এবং ইতিবাচক ছিল। তারা সবসময় তাদের সেরাটা দিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে কাজ করাটা আমার জন্য দারুণ আনন্দের। এখন ঘরের মাঠে সবাই খেলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ছেলেদের নিয়ে আমি খুবই খুশি এবং ভীষণ ইতিবাচক। 

কোন ইতিবাচক দিকটি বিশেষ করে এখন চোখে পড়েছে? যেটি আগে পড়েনি? 

কাবরেরা: বর্তমানে ছেলেদের মধ্যে বিশেষ করে সেই ইতিবাচক দিকটি দেখছি যে, তারা দেশের মানুষের সামনে ইমপ্যাক্ট দেখাতে চায়। যেটা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। আমরা চাই দেশের মানুষ আমাদের খেলা দেখে গর্ববোধ করুক। আনন্দ পাক। উপভোগ করুক। সমর্থকরা মাঠে এসে যেন আমাদের আকর্ষণীয় ফুটবল খেলাটা দেখতে পারে। আমি চাই তারা মাঠে আসুক, দলকে সর্বোচ্চ সমর্থন দিক এবং সেটা দলের জন্য এবং আসছে সাফের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

আপনি যেহেতু স্প্যানিশ কোচ, অনেকে বলেন আপনি ‘তিকি-তাকা’ কৌশলে দলকে খেলাতে আগ্রহী। 

কাবরেরা: আমার মনে হয় না, এই দলটিকে আমি স্প্যানিশ ফুটবলের তিকি-তাকা কৌশল শেখাতে চাই। আমি চাই, আমরা যেন সব দিক থেকে ভালো দল হয়ে উঠি, বৈচিত্রময় দল হয়ে উঠি। দলের বৈচিত্রময় হয়ে ওঠা প্রয়োজন। বলে পজেশন যেন আমাদের থাকে, আমরা যেন ঠিকঠাক আক্রমণ শাণাতে পারি এবং দ্রুত পাল্টা আক্রমণে যেতে পারি। যাদের মুখোমুখি হব, তাদের চেয়ে যেন আমরা ভালো খেলি এবং সবভাবেই নিশ্চিত করতে হবে আমরা ভালো দল ও যাদের বিপক্ষেই খেলি না কেন, আমরা যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল খেলি এবং প্রতিপক্ষকে খুব কম সুযোগ দেই। 

আসলে এই বৈচিত্রময়তা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, আমাদের সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ম্যাচের চাহিদা অনুযায়ী সব পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। ধরুন, প্রতিপক্ষ টেকনিক্যালি শক্তিশালী, কিন্তু তাতে সমস্যা নেই, আমাদেরকে যথাযথভাবে তাদের আক্রমণ ব্লক করতে হবে। পাল্টা আক্রমণগুলোও শানাতে হবে ঠিকঠাকভাবে। 

সবাইকেই গোল এবং রক্ষণে কাজ করতে হবে। আক্রমণ, রক্ষণ সব পরিস্থিতিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বলতে চাচ্ছি, দলীয় প্রচেষ্টা থাকতে হবে খেলায়। ম্যাচের পরিস্থিতির দাবি তাদের মেটাতে হবে, একই সাথে আক্রমণের জন্য বলের যোগান দিতে হবে। অবশ্যই গোল আমাদের দলটার জন্য বড় একটা ইস্যু, যেটা পেতে সবার সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। 

বিষয়টা তাহলে নেদারল্যান্ডসের সেই টোটাল ফুটবলের মতো শোনাচ্ছে… 

কাবরেরা: ঘুরে-ফিরে হয়তো বিষয়টা সেই টোটাল ফুটবলের মতোই শোনাচ্ছে। তবে মোদ্দা কথা আমাদের পুরোপুরি ভারাসাম্যপূর্ণ দল হতে হবে। গোলের প্রয়োজনে আগ্রাসী হতে হবে, একই সাথে বল হারালে তা পুনরুদ্ধারের জন্যও পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে হবে, প্রতিপক্ষের পাল্টা আক্রমণ আটকাতে সমর্থ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ, জমাট হতে হবে, সেটাকে আপনি টোটাল ফুটবল বা যাই বলুন না কেন, আমাদের বৈচিত্রময় হতে হবে। 

একই সঙ্গে আক্রমণ শাণানো, রক্ষণ সামলানো, এতে তো শারীরিক শক্তির পাশাপাশি অফুরন্ত প্রাণশক্তিরও প্রয়োজন। 

কাবরেরা: এখানে যে দিকটাতে আমি মুগ্ধ, সেটা হচ্ছে ম্যাচে আক্রমণ, রক্ষণের সঙ্গে বাকি কাজগুলো করার সামর্থ্য, প্রাণশক্তি এই ছেলেদের আছে। তারা ভীষণ লড়াকু, ইতিবাচক মানসিকতার। কখনও কখনও কাজটা করা কঠিন হয়, কিন্তু তারা সবসময় ভালো করতে উন্মুখ থাকে। প্রতিপক্ষকে চাপ দিতে চায়। আমি মনে করি না, এই দিকটাতে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দলগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেদিক থেকে বলা যায়, ছেলেরা প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সামনে সাফ আছে। আমার মনে হয় এনার্জি, লড়াকু মনোভাব এবং ডাইনামিজম-এসব দিকে আমরা পার্থক্য গড়ে দিতে পারব। নিশ্চিতভাবেই আমরা সেটা করতে পারব। 

সে পরীক্ষা কী সিশেলস ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে? 

কাবরেরা: সিশেলস ভিন্ন ঘরানার দল। ফিজিক্যালি তারা শক্তপোক্ত এবং এগিয়ে, কিন্তু আমরা তাদের জন্য প্রস্তুত। তারা যে কৌশলেই খেলুক, আমরা তৈরি এবং তাদেরকে নিয়ে মোটেও ভীত নই।

একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। কাতার বিশ্বকাপে স্পেন তো প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি… 

কাবরেরা: আমার ফেভারিট ছিল স্পেনই। চমৎকার শুরুও করেছিল তারা, কিন্তু মরোক্কোর কাছে থামতে হয়েছে আমাদের। মরোক্কো দুর্দান্ত ছিল এবং তাদেরকে হারানো কঠিন ছিল। আমি মনে করি, ঐকব্যদ্ধ থাকার দৃষ্টিকোণ থেকে আর্জেন্টিনা শুরু থেকেই ভিন্ন রকমের ছিল। পরিস্থিতি যাই হোক, তাদের বিশ্বাস ছিল ঐকবদ্ধ থেকে তারা ভালো কিছু করতে পারবে। এ বছর একই বিষয় আমাদের বেলায়ও হতে পারে। বিশেষ করে সাফে এবং বাছাইয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খেলে কিছু অর্জন করতে পারি আমরা। 

লাতিনের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার সঙ্গে। অনেক আর্জেন্টাইন থাকে স্পেনে, আমরা একই ভাষায় কথা বলি। এছাড়া আরও অনেক বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা আছে। যেমন, আর্জেন্টিনার অনেক খেলোয়াড় স্পেনে খেলে। এই সংযোগ দীর্ঘদিনের এবং এ কারণে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে আমি খুশি। 

তাহলে লিওনেল মেসি কি প্রিয় খেলোয়াড়, নাকি ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো? 

কাবরেরা: দুজনেই প্রিয়। দুজনেই দুর্দান্ত। 

লা লিগায় কোন দল প্রিয় দল এবং কেন? 

কাবরেরা: আমি মাদ্রিদে বেড়ে উঠেছি। যে কোনো দলের চেয়ে আমি স্পেনকে পছন্দ করি। ক্লাব ফুটবলে প্রিয় দলের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব আতলেতিকো মাদ্রিদ। দলটির যে স্পিরিট, বিশেষ করে তাদের লড়াই করার মনোভাব, সেটা আমাকে সবসময় আকর্ষণ করে। টানাপোড়েন সহ্য করার সক্ষমতা, ত্যাগের মানসিকতা, সবসময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যাওয়া-এগুলো তাদের পরিচয় এবং তাদের এই দিকগুলো সবসময় আমার মাথায় কাজ করে। 

তাহলে কি সিশেলসের বিপক্ষে বাংলাদেশ আতলেতিকোর মতো প্রতি আক্রমণ নির্ভর ফুটবল খেলবে? আপনি তো দিয়েগো সিমেওনের মতো ক্ষ্যাপাটে নন, শান্ত স্বভাবের কোচ, তাহলে? 

কাবরেরা: যাই বলো (হাসি)… আমি চাই আমার দলটা বৈচিত্রময় দল হয়ে উঠুক। যদি প্রতি আক্রমণ নির্ভর খেলতে হয়, ঠিক আছে সেভাবে খেলবে; যদি পজেশন রেখে খেলতে হয়, সেভাবে খেলবে এবং সেটা হলে চমৎকার হবে। 

দিয়েগো সিমেওনে খুবই লড়াকু মানসিকতার, মাঝেমধ্যে একটু ক্ষ্যাপাটেও। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে তার চেয়ে ঠাণ্ডা স্বভাবের (হাসি)। তিনি বিশ্বের শীর্ষ কোচদের একজন এবং আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে চমৎকার অর্জন করেছেন।

স্পেনের আর বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক ফুটবলের তুলনা করতে যদি বলি… 

কাবরেরা: আমি ঠিক তুলনাতে যাব না। আসলে স্পেনের ভালো করার কারণ ক্লাবগুলোর বয়সভিত্তিক দল আছে। একাডেমি আছে, যেখানে পাঁচ-ছয় বছর থেকে শুরু করে শিশুরা। সেখানকার প্রতিযোগিতাগুলো খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ফ্রেন্ডলি কম্পিটিশন, বছর জুড়েই শিশুরা নানা খেলাধুলার সঙ্গে থাকে, তারা খেলার সুবিধাটা জানে স্কুল পর্যায় থেকে। এটা কেবল হার-জিত সম্পর্কিত নয়, তারা বেড়ে ‍ওঠা এবং উন্নতির পথ হিসেবে এগুলো নেয়। এখানে ভালো করলে বিভিন্ন ক্লাবের একাডেমিতে সুযোগ মেলে, সেখানে হাই-পারফরম্যান্স ট্রেনিং হয়, প্রতিযোগিতার পদ্ধতি, নানা ক্যাটাগরি অনুসরণ করতে হয়-সবকিছুই বেশ গোছালো। এভাবেই স্পেনের ফুটবল উন্নতি করেছে। 

আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশও ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নতি করবে। এরই মধ্যে ফেডারেশন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, পল স্মলির অধীনে একাডেমি আছে। আমি জানি, কিছু ক্লাবও একাডেমি করার পরিকল্পনা করছে। আশা করি, বাংলাদেশের ইয়ুথ ফুটবল ধীরে ধীরে উন্নতি করবে। 

বাচ্চাদের বলব, কেবল ফুটবল নয়, যে কোনো খেলার সঙ্গে যুক্ত হও। এ জন্য আমি শিশুদের পিতা-মাতাদের উদ্বুদ্ধ করতে চাই-বাচ্চাদের আনন্দ করতে দিন, আনন্দ করা শিখতে দিন। এখানে হার-জিতের কোনো বিষয় নেই। খেলতে গেলে আনন্দ করা, বন্ধুত্ব করা, শেয়ারিং করা, দলীয়ভাবে কিছু অর্জন করা শেখা যায়-এটাই খেলাধুলা। খেলাধুলা মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠা শেখায়। তোমরা খেলাধুলা কর, আনন্দ কর, উপভোগ কর, যদি (খেলার) মেধা থাকে, ভাগ্যবান হও নিশ্চিতভাবে ক্লাবগুলো তোমার কাছে আসবে, হয়ত ভালো কোচ পাবে, পেশাদার অ্যাথলেট হতে পারবে। খেলাধুলা খুবই সাস্থ্যকর অভ্যাস, যেটা তোমাদের বাকি জীবনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। 

জাতীয় দলের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বাংলাদেশ কোচ হিসেবে দায়িত্বের এক বছর পার করার পর নিজের কাজের মূল্যায়নে কি বলবেন? কতটা উন্নতি হলো বাংলাদেশের? 

কাবরেরা: আমি মনে করি, এটা একটা প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আসে। আমাদের আরও আত্মত্যাগ এবং কঠোর পরিশ্রম করা প্রয়োজন। এটাই উন্নতির একমাত্র পথ। কোনো কিছু বদলাতে হলে একমাত্র এই বিষয়গুলোই করা প্রয়োজন। আমরা বছর জুড়ে পরিশ্রম করছি, অবশ্যই এটা আমাদেরকে বদলাচ্ছে এবং আমি উপলব্ধি করতে পারছি, সেটা ভেতরে-বাইরে আমাদেরকে বদলে দিচ্ছেও। 

আমি সমালোচনা পছন্দ করি এবং জাতীয় দলকে নিয়ে মানুষের মতামত মেনে নিতে হবে। তবে আমরা সঠিক পথেই এগুচ্ছি এবং আমি কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। ছেলেদেরকে, তাদের কাজ আমি কাছ থেকে দেখছি। আশা করি, গত বছরের চেয়ে এ বছর আমরা ভালো কিছু অর্জন করতে পারব। আশা করি, যে পরিচয়ে আমরা পরিচিত হতে চাই, সেটা বছর দুয়েকের মধ্যে পেয়েও যাব, ভালো ফল পাব এবং বিশেষ করে এটা সম্ভব করতে পারব যে, দেশের সব ফুটবল সমর্থকরা দলকে অনুসরণ করবে-যেটা আমাদের মূল লক্ষ্য।

SCROLL FOR NEXT