নিবন্ধ

এসডিজি অর্জনের পথে বাংলাদেশ

Byমাসিউল হক চৌধুরী

বর্তমান বিশ্বে বিবিধ সামগ্রিক মন্দার মধ্য থেকেও যে কটি দেশ বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ মাত্রার উপর অর্জন করছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রবৃদ্ধির এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে দেশের জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছর হওয়ার বিষয়টি। অর্থাৎ জনসংখ্যার বৃহদাংশ কর্মক্ষম তথা অর্থনীতির উৎপাদনশীলতায় সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছে।

এ কারণে আমাদের অভ্যন্তরীন অর্থনীতি এমন এক ভিতের উপর রয়েছে যাতে চাহিদা-যোগানের সক্ষমতা দেশকে বিশ্বমন্দার হাত থেকে আপাতত স্বস্তি দিতে পেরেছে। একদা যে জনসংখ্যা অভিশাপ বলেই মনে করা হত, সে বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে বলা যেতে পারে যে, সেটি অভিশাপ না হয়ে বরং আমাদের অভ্যন্তরীন অর্থনীতির রক্ষাকবজে পরিণত হয়েছে।

জ্বালানি তেলসহ বিবিধ প্রয়োজনীয় ধাতুর দাম বিশ্ববাজারে ইতিহাসের সর্বনিম্ন মূল্যে থাকার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষিতে সামগ্রিক উন্নয়নের ফলে যেমন মঙ্গা এলাকায় কৃষিপণ্যের উৎপাদন এগিয়ে গিয়েছে, তেমনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর তা রফতানিতেও ভূমিকা রাখছে। আমাদের জনশক্তি রফতানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই কেবল সম্ভব হচ্ছে তা নয়, খুলে যাচ্ছে উদ্যোগমুখীতার নতুন দ্বার।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যে ইমেজ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তা আমাদের সুযোগ্য উদ্যোক্তারা সুন্দরভাবে মোকাবেলা করেছেন। তাতে দেশকে নির্ভরযোগ্য যোগানদারী রাষ্ট্র হিসেবে আরও পোক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যে ইমেজ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তা আমাদের সুযোগ্য উদ্যোক্তারা সুন্দরভাবে মোকাবেলা করেছেন

ডিজিটাল শব্দটির সঙ্গে শুধু শব্দগত পরিচয়ই নয়, এর বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মুঠোফোনের সহজলভ্যতার কারণে কৃষি, ব্যাংকিং-সেবা, স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য সেবা সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। বিশ্ব শান্তি রক্ষায় আমাদের সেনা সদস্যদের বিশ্বের বিভিন্ন উপদ্রুত দেশে আন্তরিক ও মানবিক ভূমিকা একদিকে সে সমস্ত দেশে যেমন জনপ্রিয়তা দিয়েছে, তেমনি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুখোজ্ব্বল করেছে। অভ্যন্তরীন অবকাঠামো বিনির্মাণে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম।

স্বাধীন একটি দেশকে 'বটমলেস বাস্কেট' বলার পরও এ দেশের জনগণের উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা জাতি হিসেবে আমাদের এহেন অবস্থান সুসংহত করেছে। এখন সময় হয়েছে আত্মবিশ্লেষণের, যাতে প্রকৃতভাবে অনেক কটি বিষয় দৃষ্টির সামনে চলে আসে, যেগুলোর সমাধানকল্পে কাজ করলে দুর্বলতা দূর করার যেমন সুযোগ আসে, ঠিক তেমনি সুযোগ আসে অনেক নতুন দ্বার উন্মোচনের।

তবু আমাদের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে স্বাধীনতা পাওয়া ভিয়েতনামের তুলনা করা হলে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি প্রকৃতই পেরেছি আমাদের সক্ষমতার পুরোটা অর্জন করতে?

স্বাধীন দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে পরিবারের বিরাট অংশসহ যেভাবে স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রিমহল হত্যা করেছে, তাতে যে কেবল বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসেছে পশ্চাৎগামিতা। একের পর এক সেনাঅভ্যূত্থান এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্র বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানের মূল্যবোধের স্থানগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। তাতে দেশে সুযোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে আমরা আমাদের উন্নয়নের অবারিত পথও বাধাগ্রস্ত করে তুলেছি।

অর্থ-বৈভবের জোরে নয়, দেশের নবীন অংশের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ দীর্ঘ সময়ে তৈরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব-শূন্যতার সমাধানে জাতি অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসবেই।

একটি জাতির উন্নয়নের পিছনে তার একটি জাতীয় চরিত্র গঠন প্রয়োজন। এত কষ্ট করে পাওয়া স্বাধীনতার মূল ঘটনা অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভুল বর্ণনা বিদ্যালয়ের পাঠ্যসুচিতে এনে জাতিকে বিভাজিত করার অপচেষ্টার মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্ব আমাদেরকে অনেক দূর পিছিয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরপ বলা যায় যে, 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী' শব্দবন্ধ ব্যবহার পরিহার করে শুধু 'হানাদার বাহিনী' শব্দবন্ধ নিয়ে আসার মাধ্যমে পাকিস্তানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপকর্মের জন্য ক্ষমা না চেয়ে অপরাধ অস্বীকারের ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

যে কোনো জাতির উন্নয়নের পিছনে তার শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাট ভূমিকা রাখে। ডক্টর কুদরত-ই-খুদা কমিশনের প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষানীতি সযত্নে আলমারিতে রেখে কত প্রকারের যে শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিকুলাম প্রচলিত রয়েছে বর্তমানে! এতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হবার পাশাপাশি, চিন্তা ও মানসিকতায় জাতি বহুধা-বিভক্ত হচ্ছে। আশু করণীয় হচ্ছে সে কমিশনের সঠিক ও যুযোপযোগী বাস্তবায়ন। সম্পূর্ণভাবে আমদানি-নির্ভর একটি দেশ কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হয়েছে, তার উদাহরণ সিঙ্গাপুর। আমাদের দেশেও শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলে ও এর প্রয়োগযোগ্যতা বাড়লে তা জনগোষ্ঠীর দক্ষতা ও উৎকর্ষতা বাড়াবে।

কুদরত-ই-খুদা কমিশনের প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষানীতি সযত্নে আলমারিতে রেখে কত প্রকারের যে শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিকুলাম প্রচলিত রয়েছে

ধূসর অর্থনীতি (Grey Economy) আকারে-অবয়বে মূল অর্থনীতির মতন। এটি কেন হল এ প্রশ্ন বা বিতর্কে না গিয়ে সার্বিক কর হার হ্রাস করে করের আওতা বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতিতে আরও গতি নিয়ে আসবে। সামাজিক সেফটি নেট বৃদ্ধিকল্পে সরকারের গৃহীত বিবিধ প্রকল্প তাই বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি স্বপ্নে স্বার্থকতার রূপ দিতে পারা অবশ্যই নিজস্ব সক্ষমতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্খান অর্থনৈতিক সোপান ও ভিত্তি তৈরিতে বিশাল অবদান রাখতে পারে। আধুনিক সিঙ্গাপুরের জন্মদাতা লী কুয়ান ইউ বলেছিলেন, তাঁর দেশটির উড্ডয়নের দুটি পাখা ছিল, চীন ও ভারত, সংক্ষেপে 'চিনডিয়া'। করিডোরের সুযোগ গ্রহণ করে বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক উন্নয়ন পরিমণ্ডলের নেতৃত্ব তাই বাংলাদেশকে বিশ্বাঙ্গনে একটি বিশেষ ভূমিকা পালনের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে আমাদের পুরো সক্ষমতার ব্যবহার বিশেষ বিশ্লেষণের গুরুত্ব রাখে।

আইনের শাসন, জবাবদিহিতা তথা সার্বিক স্বচ্ছতা কেবল দেশের জনগণের মাঝে স্বস্তি দেয় না, বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ পান। এ কথা বিশেষভাবে সামনে নিয়ে আসা দরকার যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনো একটি দেশ এককভাবে থাকতে পারে না, তাকে বিশেষ কোনো ভূমিকা পালন করতে হয়। করপোরেট গভর্নেন্স বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ তাই অত্যাবশ্যক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপসমূহ এ জন্য বিশেষ করে প্রশংসার দাবি রাখে। ব্যাংকিং খাতের আপাত মন্দাবস্থা অচিরে কেটে যাবে বলেই আশা করা তাই যৌক্তিক।

বিষয়গুলো প্রণিধানে রেখে এগুলে এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ যে অন্যান্য দেশের রোল মডেলে পরিণত হবে তাতে সন্দেহ নেই।

SCROLL FOR NEXT