অভিমত

শেখ কামাল– মিথ্যাচারে আঁকা ইতিহাসের এক “খলনায়ক”!

Byundefined

বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা এদেশের অনেক বাঙ্গালীর প্রিয় বিনোদন। এই বিকৃত বিনোদনের সবচেয়ে নির্মম শিকার বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল।

৭১-এ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও যার কপালে মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার অপবাদ জুটেছে। যদিও ভারতের বেলুনিয়া থেকে সেনাবাহিনীর প্রথম যে ব্যাচটি কমিশন লাভ করে, সেই ব্যাচের একজন শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসারদের একজন এবং সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট থাকা অবস্থায় প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ডালিমের বউ অপহরণের মিথ্যা অপবাদও জুটেছে শেখ কামালের কপালে। ডালিম নিজে সেই অপহরণ সম্পর্কে তার "যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি" বইতে পরিস্কার লিখে গেলেও শেখ কামালের সেই অপবাদ ঘোঁচেনি। অত সহজে ঘোঁচার কথাও নয় অবশ্য। অন্যের বউ অপহরণ গল্পে যত রস আছে, সত্যি ঘটনাটায় ততটা নেই। ধর্ষকামী ও মর্ষকামী মানসিকতার মানুষদের সত্য জানার আগ্রহ ও স্বীকার করার সৎসাহস কম থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।

অপহরণ ঘটনার দিন ঢাকা লেডিস ক্লাবে ডালিমের খালাতো বোন তাহমিনার বিয়ে চলছিলো। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও রেডক্রসের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার পরিবারসহ অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক অতিথিবৃন্দ। ডালিমের কানাডা ফেরত শ্যালক বাপ্পির চুল টানা নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেদের সাথে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। বিষয়টা সেখানেই নিস্পত্তি হয় না। গাজী গোলাম মোস্তফা  সশস্ত্র লোকজন নিয়ে ক্লাবে এসে ডালিম, ডালিমের বউ নিম্মী ও তাদের পরিবারের আরো কয়েকজনকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিলো।

শেখ কামালের বিরুদ্ধে আরেকটা জব্বর মিথ্যাচার হলো ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ। ১৯৭৩ সালের বিজয় দিবসের আগের রাতে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সিরাজ শিকদার তার দলবল নিয়ে এসে শহরের বিভিন্নস্থানে হামলা চালাতে পারে। এ অবস্থায় সাদা পোশাকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে শহরজুড়ে টহল দিতে থাকে। সর্বহারা পার্টির লোকজনের খোঁজে শেখ কামালও তার বন্ধুদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ধানমন্ডি এলাকায় বের হন। সিরাজ শিকদারের খোঁজে টহলরত পুলিশ মাইক্রোবাসটি দেখতে পায় এবং আতংকিত হয়ে কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই গুলি চালায়। শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ হন। গুলি শেখ কামালের কাঁধে লাগে। তাকে তখনকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

প্যারেড শেষে মইনুল হোসেন চৌধুরী পিজিতে যান শেখ কামালকে দেখতে। হাসপাতালে বেগম মুজিব শেখ কামালের পাশে বসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ছেলের ওই রাতের অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং শেখ কামালকে হাসপাতালে দেখতে যেতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে যান। (তথ্যসূত্র: মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর "এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক; পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬)

জেনারেল মইন বইটিতে আরো লিখেছেন, "এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা এই ঘটনাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। 'ব্যাংক ডাকাতি' করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশ-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এসব প্রচারণায় সত্যের লেশমাত্র ছিল না।"

যে জিপটিতে কামালরা দুষ্কৃতকারীদের ধরতে গিয়েছিলেন সেটি কার ছিলো জানেন? বর্তমান বিএনপির নেতা ইকবাল হাছান টুকুর এবং সেদিন জিপটি টুকুই ড্রাইভ করেছিলেন। এবং এই ঘটনাটি পরদিন 'দৈনিক মর্নিং নিউজ' এ প্রকাশিতও হয়। দৈনিক মর্নিং নিউজের তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক এ.বি.এম.মুসা।

আরো আছে, শেখ কামাল নাকি তৎকালীন স্বনামধন্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকিকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। শেখ কামাল সুলতানার প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেটা তাকে জানিয়েওছিলেন সত্যি। কিন্তু উঠিয়ে নিয়ে যাননি। রীতিমতো দুই পরিবারে মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিয়ে হয়। সুলতানা কামালের বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী দবির উদ্দিন আহমেদ।

শুধু তাই নয়, শেখ কামালের বিয়েতে পাওয়া সকল মূল্যবান উপহার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসার তত্ত্বাবধানে সরকারী তোষাখানায় জমা দেয়া হয়। শুধুমাত্র একটি সোনার নৌকা এবং একটি মুকুট স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সরাসরি এই জমার কাজটা তদারকি করেন। বাসসের কাছে দেয়া তাঁর স্মৃতিচারণে তিনি একথা বলেওছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে হওয়ায় শেখ কামালকেই সবচেয়ে বড় থ্রেট মনে করেছিলো নপুংসকের দল। তখন যদি তারা জানতো সপরিবারে হত্যার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসবেন। তবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও অপপ্রচারের বন্যা বয়ে যেতো নিশ্চিত।

শুধু জাতির পিতার সন্তান হওয়ার অপরাধে যাকে এতোগুলো অপপ্রচারের শিকার হতে হয়েছে এবং শেষপর্যন্ত হাতের মেহেদীর দাগ উঠে যাওয়ার আগেই স্ত্রী সুলতানা কামালসহ অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, সেই ভুল সময়ে চলে যাওয়া মানুষটির আজ জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন জানানোর ভাষা নেই, শুধু নিরন্তর ক্ষমা প্রার্থনা করি। এটুকুই।

SCROLL FOR NEXT