অভিমত

সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মানুরাগ এবং মানবিকবোধ

Byবিভুরঞ্জন সরকার

আমরা বড় হয়ে উঠেছিলাম কতগুলো নীতিবাক্য এবং এমন কিছু কবিতা পাঠ করে যা আমাদের মধ্যে এক ধরনের মানবিক বোধ জাগিয়ে তুলত। আমরা কে কোন ধর্মের অনুসারী সেটা কখনও বড় বিষয় হয়ে দেখা দেয়নি। হিন্দু, না মুসলিম এই জিজ্ঞাসা আমাদের মধ্যে প্রবল ছিল না। আমরা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছি: 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'

ভূপেন হাজারিকার সেই কালজয়ী সঙ্গীত আমাদের মর্মমূলে গাঁথা ছিল: 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।'

আমরা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার লাইন কণ্ঠে ধারণ করেছি গভীর মুগ্ধতায়: 'মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই'।

কামিনী রায়ের কবিতা আমাদের কতই-না প্রাণিত করত: 'আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'।

আল হাসিদের বাণী মনে রেখেছি মানবধর্মের প্রাধান্য দিয়েই: 'যে ব্যক্তি মানুষের দয়া করে না, আল্লাহতায়ালা তাহার উপর রহমত বর্ষণ করেন না'।

শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ লিখেছেন: "মানুষের জন্য যাহা কল্যাণকর, তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম যাপন করিতে গিয়া মানুষের অকল্যাণ করিতে হয়, তাহা ধর্মের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়।"

কিন্তু আজ আমরা চারপাশে কী-সব ঘটতে দেখছি? ধর্মের জন্য, ধর্মের নামে কতিপয় মানুষের এ কী সংহার রূপ! মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর পংক্তি: "অলৌকিক আনন্দের ভার, বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার।"

দুই.

এই ভূমিকাটুকু করলাম সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর আলোকেই। ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামে কয়েক হাজার মানুষ সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজনের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, লুটপাট করেছে। উন্মত্ত হামলাকারীদের ভয়ে আগেভাগে পালিয়ে না গেলে হয়তো অনেকের জীবনও যেত। কী অপরাধ করেছিল ওই হিন্দুরা?

ঠাকুরপাড়া গ্রামের মৃত খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায় নাকি ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়ে ইসলাম ধর্মানুসারীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছে

ঠাকুরপাড়া গ্রামের মৃত খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায় নাকি ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়ে ইসলাম ধর্মানুসারীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছে! যদি টিটু রায় এমন কাজ করেই থাকে তাহলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার জেল-জরিমানা যা হবার তা হলে কারও কিছু বলার থাকত না। কিন্তু টিটু রায় নামের 'হিন্দু' ছেলেটি কথিত অভিযোগের জন্য দায়ী কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই শান্তি দেওয়া হল তার পাড়াপড়শিদের। টিটু রায়কে ধরে ক্ষিপ্ত ধর্মানুরাগীরা মারধর করলেও এই ভেবে সান্ত্বনা পাওয়া যেত যে, ব্যাটা 'মালাউন' ইসলামের পবিত্রতা নষ্ট করায় উচিত শিক্ষা পেয়েছে!

না, টিটুকে পাওয়া যায়নি। কারণ সে দশ বছর ধরে ওই গ্রামেই থাকে না। যে গ্রামছাড়া হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করছে। তার কথিত অপরাধের শাশ্তি ভোগ করতে হল নিরীহ গ্রামবাসীদের। এখন জানা যাচ্ছে, টিটু রায় লেখাপড়াই জানে না। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকার কথা নয়। যে স্ট্যাটাস দিয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে সে পোস্টটি আসলে একজন ঈমানদার মুসলমানই দিয়েছেন!

হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেই যে এই অপকর্ম করা হয়েছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। হিন্দুদের ওপর চড়াও হওয়ার একটি অজুহাত বের করার এই যে জঘন্য পদ্ধতি এটি আর কতদিন অনুসরণ করা হবে? মিথ্যা অভিযোগ তুলে কিছু ধান্ধাবাজ মতলববাজ আর কতদিন হিন্দু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত অন্যদের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম নিয়ে এ রকম ছিনিমিনি খেলবে?

এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে গত বছর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরেও একই কায়দায় হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, রসরাজ দাস নামের এক স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র জেলে ফেসবুকে কী এক স্ট্যাটাস দিয়ে মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। ব্যস, শুরু কর হিন্দুদের ওপর আক্রমণ। তার আগে, ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বর্বর আক্রমণ পরিতালিত হয়েছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর। তখন অভিযোগ করা হয়েছিল যে, উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবক ইসলামের পবিত্রতাহানি করেছে।

অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই না করে, একজনের কল্পিত অপরাধের দায়ে একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এমন হামলে পড়া কি স্বাভাবিক কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? কেউ কেউ হয়তো সেটা বলে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করতে চান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এই ঘটনাগুলো যদি বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ বলা হয়, তাহলে কেউ কেউ নিশ্চয়ই তার প্রতিবাদ করবেন। বলবেন, না, বাংলাদেশ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ফসল। এই দেশের জন্য মুসলমান , হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মবিশ্বাসীর আত্মদান ও ত্যাগ রয়েছে।

এই কথাগুলো বলতে ভালো লাগে। এক সময় শুনতেও খারাপ লাগত না। এখন এসব কথা সংখ্যালঘুদের মনে বিশেষ কোনো আবেগ তৈরি করে বলে মনে হয় না। শখ করে কেউ দেশত্যাগী হয় না। দেশত্যাগের, ভিটেমাটি ছাড়ার বেদনা অবশ্য ভুক্তভোগী ছাড়া কারও বোঝার কথা নয়। দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যেখানে ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কেন কমছে সে প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা হতে চাই না। সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ যে নীরব সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ঘটেছে, সেটা আমরা মানতে চাই না। অথচ সত্য এটাই যে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।

সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ যে নীরব সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ঘটেছে, সেটা আমরা মানতে চাই না

এ কথা ঠিক যে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কিন্তু নানা ঘাত-প্রতিঘাত, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ক্ষমতার রাজনীতির জটিল সমীকরণ আমাদের নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ আর কোনোভাবেই সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ বাসভূমি নয়। এক সময় হিন্দু প্রতিবেশির প্রতি মুসলিম প্রতিবেশির যে সহানুভূতি ছিল, এখন তাতে চির ধরেছে। আক্রান্ত হিন্দু প্রতিবেশিকে রক্ষার জন্য মুসলিম প্রতিবেশি কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। অনেকেই এখন আর নিজেকে 'হিন্দুদরদী' হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এক সময় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঐতিহ্য বহন করা আওয়ামী লীগ নামের দলটিও আর সে পরিচয় গায়ে সেঁটে রাখতে চায় না।

ধারণাটি যদি ভিত্তিহীন হত তাহলে গুজব ছড়িয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে হাজারে হাজার জমায়েত হয়ে সংখ্যালঘুদের গ্রাম-পাড়া আক্রমণ করা সম্ভব হত না। অসাম্প্রদায়িক চেতনার শুভবোধসম্পন্ন মানুষই প্রতিরোধে শামিল হত।

রংপুরের ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকাও খুব দুঃখজনক। প্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাসময়ে তৎপর হলে ঘটনাটি অন্তত প্রতিহত করা যেত। কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েই হামলা হয়েছে। হঠাৎ কিছু হয়নি। যখন হাওয়া গরম করা হচ্ছিল তখন নাকে তেল দিয়ে সুখনিদ্রায় থেকে হামলার পর তৎপর হওয়ায় ক্ষতি হয় দুদিক থেকে।

এক. হামলার শিকার হিন্দুরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। দেশত্যাগের পরিকল্পনা করে। দুই. আক্রমণকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি ছুঁড়লে আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন আক্রমণকারীদের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি হয়। কোনো কোনো জ্ঞানপাপী বলার সুযোগ পায় যে, হিন্দুদের বাড়িঘরের ক্ষতি হল, সেগুলো তো আবার বানানো যাবে, কিন্তু মুসলমানের যে জীবন গেল, তা তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের সাফাই বক্তব্য দিয়ে বলা হয়, যারা সরকারকে বিব্রত করতে চায় তারাই উস্কানি দিয়ে এসব অপকর্ম করে থাকে। হতে পারে এই বক্তব্যই ঠিক। প্রশ্ন হল, সরকার বা প্রশাসন এই উস্কানিদাতাদের কেন প্রশ্রয় দেয়? কেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? যদি আগের ঘটনাগুলোর যথাযথ বিচার হত, অপরাধীরা শাস্তি পেত তাহলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি নাও ঘটতে পারত। চোরকে চুরি করার সুযোগ দিয়ে গৃহস্থকে প্রবোধ দেওয়া অর্থহীন, তামাশা ছাড়া কিছু নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো বন্ধ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ অচিরেই 'সংখ্যালঘু সমস্যামুক্ত দেশ' হিসেবে পরিচিতি পাবে এই কারণে যে, তখন এক ধর্মের মানুষের বাসভূমি হবে এই দেশ।

আইনস্টাইনের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ কতে পারছি না। তিনি বলেছেন: "এই পৃথিবী কখনও খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না। যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করে না, তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে।"

পাদটীকা:

এই যে আমরা বলছি দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে, সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি আসলে কী? সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির ব্যাখ্যা উইকিপিডিয়ায় দেওয়া হয়েছে এভাবে:

"সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোনো ব্যক্তির মনোভাব তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হল সম্পদায়। ধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার-বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ আছে সম্প্রদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি।"

সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি। সত্যিকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার আসল পুরস্কারের আশা। সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে। ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশে এই প্রবণতাই কি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে না?

SCROLL FOR NEXT