অভিমত

খালেদা হাসিনাকে ক্ষমা করেছেন, খালেদাকে কে ক্ষমা করবেন?

Byস্বদেশ রায়

খালেদা জিয়া কোর্টে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেছেন, তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা কী অন্যায় করেছেন তাঁর কাছে যে, তিনি তাঁকে ক্ষমা করলেন? তিনি বলেছেন, তিনি ২০০৮এর নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারতেন। কারণ জেনারেল মঈনরা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন, নির্বাচন দিয়ে তারা চলে যাবে– তিনি যেন তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেন।

মঈনরা তো খালেদা জিয়ারই লোক ছিলেন। তারা তাঁর কাছে যাবেনই। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দুদিন আগেও মঈন তাঁর সঙ্গে মিটিং করেছিলেন। যতদূর জানা যায়, তাঁর কথামতোই নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক হয়। জনগণের জোয়ারে তিনি ভেসে যান– মঈনরাও।

শেখ হাসিনার তখন সরাসরি কথা ছিল, 'কোনো সমঝোতা করতে হলে, কথা বলতে হলে আপনাদের ভাবির সঙ্গে বলেন। নির্বাচনটা দিন।'

আর পার্লামেন্টের মাধ্যমে ফখরুদ্দিন সরকারের কাজগুলোর বৈধতা দেওয়া! এ তো সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে। এ কাজ হয়েছে এ দেশে বার বার। এর নৈতিক বৈধতা নেই। তাছাড়া বিচারপতি খায়রুল হকের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর এ বৈধতা দেওয়া যায় কিনা তা নিয়েও আইনগত প্রশ্ন রয়েছে। বিচার বিভাগের কাছে গেলে এ নিয়ে ভিন্ন মত আসতে পারে।

খালেদা বলেছেন, তিনি ওই সমঝোতায় যাননি। যদি না যেয়ে থাকেন তাহলে শেখ হাসিনা যে পার্লামেন্টে ফখরুদ্দিন সরকারের কাজের বৈধতা দিয়েছেন তা নিয়ে এই নয় বছরে কেন কোর্টে চ্যালেঞ্জ করলেন না? কোর্ট যদি অবৈধ ঘোষণা করত, তাহলে কি এতদিন ফখরুদ্দিন-ইয়াজুদ্দিন-মঈন উ আহমেদদের বিচার শুরু হত? সে কাজ খালেদা করলেন না কেন?

এখন তিনি বলছেন, আসুন অতীত ভুলে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করি। বাংলাদেশের কোনো মানুষই প্রতিহিংসার রাজনীতি চায় না। শেখ হাসিনা কি গত নয় বছর ধরে প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন? খালেদা ও তাঁর দলের লোকদের প্রতি যে আচরণ শেখ হাসিনার সরকার করছে সেটা কি প্রতিহিংসা না উদারতা?

খালেদা ও তাঁর দলের লোকদের প্রতি যে আচরণ শেখ হাসিনার সরকার করছে সেটা কি প্রতিহিংসা না উদারতা?

কেউ যদি শেখ হাসিনার কাজটি আপোষকামিতা দাবি করেন তা-ও খুব দোষের হবে না। তিনি কেন আপোষ করছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে যে এক হাজারের বেশি মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে– কয়েক হাজারকে পুড়িয়ে পঙ্গু করা হয়েছে– আগুনে সব হারিয়ে অনেক তরুণী এখন নীরবে ঘরের ভিতর চোখের পানি ফেলেন– তাদের জীবনে আর স্বপ্ন নেই। এই সকল হত্যাকাণ্ড ও হত্যাচেষ্টা, তরুণীর যৌবন কেড়ে নেবার হুকুমের আসামি খালেদা জিয়া। এই ব্যক্তি যদি খালেদা জিয়া না হয়ে কোনো কেরামত আলী বা মেরামত আলী হতেন তিনি কি এতদিন জেলের বাইরে থাকতে পারতেন?

শুধু তাই নয়, এদেশের মানুষের একটি অংশ যদি রাজাকার তোষণকারী না হত, যদি তাদের বিবেক থাকত, তাহলে খালেদা জিয়াকে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ-হত্যার জন্য গ্রেফতার করতে রাজপথ কি উত্তাল হবার কথা নয়? এক হাজারের মতো মানুষ পুড়িয়ে হত্যার কথা বাদ দিন, শুধু টঙ্গিতে কিশোর মনিরকে যেভাবে পুড়িয়েছে খালেদা জিয়ার দলের কর্মীরা– দলীয় স্লোগান দিতে দিতে– যেভাবে পুড়ে যায় মনিরের শরীর– তারপরও কি খালেদা জেলের বাইরে থাকতে পারেন?

ইতিহাসের মানুষ হিসেবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান, মুনতাসীর মামুন প্রমূখ বার বার সত্য বলেছেন– এদেশের মানুষের সমস্যা নিয়ে। এখানে কোথাও একটা 'রাজাকারসুলভ বিষয়' থাকলে এক শ্রেণির লোকের ভালো লাগে। খালেদা জিয়ার ক্ষে্ত্রে তা আছে বলেই এত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার হুকুম দিয়ে, আবার পরে ভদ্রবেশে বের হয়ে বলেন, আমি হাসিনাকে ক্ষমা করে দিলাম!

দেশের মানুষকে নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে এগুলো এক ধরনের মসকরা মাত্র। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ হলে নিজের অফিসে বসে এতসব হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে আবার এভাবে কেউ কি ফিরতে পারত? সে সুযোগও কি মিলত? আবারও মুনতাসীর মামুনের আশির দশকের সেই 'একতা' র কলামের শিরোনাম ব্যবহার করতে হয়, 'সব সম্ভবের দেশ এটা'।

ধর্ষক-হত্যাকারী একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার সাঈদীর রায়ের পর, মানিকগঞ্জে, বগুড়ায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে, রংপুরে যেভাবে নরহত্যা সঙগঠিত হয়, হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, পোড়ানো হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হত্যা করা হয় পুলিশ সদস্যদের– এসব কি বেগম জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে বাইশ দলের মিটিং ডেকে তারপরে করেননি? ধরে নিলাম, তিনি যেহেতু শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, শেখ হাসিনাও তাকে ক্ষমা করলেন– যে জনগণের টাকায় এই সরকারি সম্পত্তি তৈরি হয়েছিল সেই জনগণ কি খালেদা জিয়াকে ক্ষমা করতে পারবেন? যে পুলিশ সদস্যরা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার কি শেখ হাসিনাকে কোনো ক্ষমতা দিয়েছে যে, তিনি খালেদাকে ক্ষমা করে দেবেন?

মগবাজারের ওয়ারলেস রেলগেটে জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার আবুল কালামের মুখের ওপর পেট্রোল বোমা মারে। হাসপাতালের বেডে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কদিন পরেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২৫ বছরের তরুণ আবুল কালাম। তার মৃত্যুর কথা শুনে তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তার বড় ভাই তার সঙ্গে হাসপাতালে ছিলেন। এখনও ভুলতে পারেন না আবুল কালামের সেই যন্ত্রণাময় মুখচ্ছবি। তার একটাই দাবি– তাদের সংসারের সব শেষ হয়ে গেছে, এখন হত্যাকারীর বিচার হোক।

আবুল কালামের মূল হত্যাকারী কে? কার নির্দেশে ওই পেট্রোল বোমার আন্দোলন চলছিল?

জিয়াউর রহমান সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সেনাসদস্য হত্যা করেছেন আর বেগম জিয়া সবচেয়ে বেশি সিভিলিয়ান

বেগম জিয়া এখন খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলছেন, ভবিষ্যত প্রজম্মকে ভদ্রতা শেখাতে চাচ্ছেন, হানাহানি থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছেন– নিজ মুখে আজ কি তিনি দাবি করতে পারেন যে, আবুল কালাম হত্যার হুকুমের আসামী তিনি নন?

এভাবে একটার পর একটা ঘটনা উল্লেখ করলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বই লেখা যাবে। ১৯৭১এর পর তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সেনাসদস্য হত্যা করেছেন। আর বেগম জিয়া বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সিভিলিয়ান হত্যা করেছেন। তিনি কি দায় এড়াতে পারেন একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার? যে হামলায় আইভি রহমানসহ প্রায় ৫০ জন নিহত হন? আওয়ামী লীগ অবশ্য বলে, হামলায় নিহতের সংখ্যা ২৫। সাংবাদিক হিসেবে রমনা বিল্ডিংএর ছাদে উঠে দেখেছি, ট্রাক ভরে অন্তত ২০টির ওপর লাশ নিয়ে যেতে। সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি আরও একটি ট্রাকে মৃতদেহ নিয়ে গেছে। এত মৃতদেহ কোথায় গেল?

এরশাদ আমলে নূর হোসেনের হত্যার দিনও একই ধরনের ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। তাই আওয়ামী লীগ যাই বলুক, সব সময় বলে এসেছি, ২১ আগস্ট আইভি রহমানসহ পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। হামলাকারীদের নেতা তাইজুদ্দিনকে কি বেগম জিয়ার নির্দেশে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া হয়নি? তাইজুদ্দিনকে যিনি পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দেন, তিনি কীভাবে হত্যাকাণ্ডের দায় না নিয়ে পারেন?

শেখ হাসিনা ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য বেগম জিয়ার বিচার করছেন না। আদালত যেভাবে বিচার করছে তাই মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু নিহতদের এই পরিবারগুলো কি বেগম জিয়াকে ক্ষমা করতে পারবে?

অন্যদিকে, সব সময় পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যালঘুরা দুর্বল থাকে। তাদের ওপর আঘাত আসে নানাভাবে। তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে। তাই এখানে হামলা-নির্যাতন কোনো ক্ষমতাশালীর স্বার্থে ছাড়া অন্যভাবে হয় না। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ সবচেয়ে বড় আকারে হয় ২০০১ সালে। বেগম জিয়ার সরকার তখন ক্ষমতায়। ওই এথনিক ক্লিনজিংএর বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সেখানে বেগম জিয়া থেকে শুরু করে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী 'আল্লার মাল' নামে খ্যাত আলতাফ নিজেও ছিলেন জড়িত।

সংখ্যালঘুরা দুর্বল, তারা না-হয় বেগম জিয়াকে ভয় পেয়ে ক্ষমা করে দিলেন– যিনি প্রত্যেক ভিকটিমের বাড়িতে গেছেন, সেই বিচারপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কি বেগম জিয়াকে ক্ষমা করতে পারবেন? তিনি তো সেই বেদনার্ত মুখগুলো দেখেছেন।

বিড়াল খুব সহজে কাঁটাওয়ালা গাছে ওঠে না– বলে না, 'মাছ খাব না আর'। বেগম জিয়া এখন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলার শেষপ্রান্তে এসে বুঝতে পারছেন, আইন শেষাবধি কাউকে ছাড়ে না। তাই হঠ্যাৎ তিনি 'লেডি গান্ধী 'হয়ে গেছেন, ক্ষমা করছেন, 'অহিংস পরম ধর্ম' বলে গ্রহণ করছেন! অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল অবধি বেগম জিয়ার নির্দেশে যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারগুলো তাকিয়ে রয়েছেন শেখ হাসিনার দিকে।

তাদের একটাই দাবি– অপরাধীদের বিচার যেন হয়।

SCROLL FOR NEXT