অভিমত

রোহিঙ্গারা যেন রুয়ান্ডার তুতসি

Byশাকিল রিয়াজ

১৯৯৪ সালের কথা। মধ্য আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় যখন গণহত্যা চলছিল বিশ্ব তখন চোখ মুদে ছিল। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু সম্প্রদায় সরকারি বাহিনীর ইন্ধন ও সহযোগিতায় সংখ্যালঘু তুতসিদের উপর যে নারকীয়, পাশবিক ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা জানতে বিশ্ববাসীর সময় লেগেছিল। বিশ্বমোড়লগণ, জাতিসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এমনভাবে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল যেন কিছুই ঘটছে না। বিশ্বমিডিয়া ছিল আশ্চর্যজনকভাবে নীরব।

লোকচক্ষুর অগোচরে ঘটে যাওয়া সেই নারকীয় গণহত্যার দায় শুধু হুতুদেরই নয়, পৃথিবীর সবার। নব্বই দশকের সেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত রাজনীতি আর মিডিয়ার উপেক্ষার বলি হয়েছিল দশ লক্ষ জীবন, মাত্র একশ দিনে। দেশছাড়া হয়েছিল বিশ লক্ষ মানুষ। "হান্ড্রেড ডেইজ অফ স্লটার" নামে পরবর্তীতে আকিকাপ্রাপ্ত ওই ঘটনার সময়কাল ছিল ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৫ জুলাই। পুড়িয়ে, কুপিয়ে, জবাই করে দশ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশুর লোমহর্ষক সেই হত্যাযজ্ঞে একটি পুরো গ্রহ দায়ী, এমনটি ইতিহাসে আর ঘটেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা না বলতে জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বারণ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের ভেটোর কারণে জাতিসংঘ অ্যাকশনে যায়নি। এমনকি এই গণহত্যার খবর যাতে বহির্বিশ্ব না জানে সে ব্যাপারেও সমঝোতায় পৌঁছে পরাশক্তিরা। হুতু সরকার যখন রেডিও এবং অন্যান্য মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে জানাচ্ছে জাতিগত নির্মূল অভিযান– যখন ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে একজন তুতসিকেও জীবিত রাখা হবে না– যখন ঘরে-বাইরে, স্কুলে, হাসপাতালে, চার্চে হানা দিয়ে, পালানোর রাস্তা ব্লক করে হাজার হাজার মানুষ মারা হচ্ছে প্রতিদিন– তখনও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ 'গণহত্যা' শব্দটি উচ্চারণের অনুমতি দেয়নি। সে সময়ে তাদের কোনো রেজ্যুলুশনে এই শব্দ নেই।

এমনকি হত্যাকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে দিতে রুয়ান্ডায় নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছিল। জাতিসংঘের দুহাজার সৈন্য ছিল গণহত্যার প্রাক্কালে। রুয়ান্ডায় নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রধান সতর্ক করে দিয়ে হেড্কোয়াটার বরাবর চাহিদাপত্র পাঠিয়েছিলেন। আসন্ন গণহত্যা ঠেকাতে তিনি সৈন্যসংখ্যা পাঁচ হাজারে উপনীত করার তাগিদ দিয়েছিলেন। তাঁর এই মেসেজ পেয়ে উল্টো কাজ করল নিরাপত্তা পরিষদ। মাত্র ২৭০ সৈন্য রেখে বাকিদের ফেরত নিয়ে আসা হয়েছিল।

পাশাপাশি ফ্রান্স এবং ইসরাইল হুতুদের অস্ত্র সাপ্লাই দিয়েছে এথনিক ক্লিনজিং বেগবান করতে। জাতিসংঘের তখনকার মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস-ঘালি হুতুদের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এই কাজটি তিনি করিয়েছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের মাধ্যমে। হুতু খুনিদের প্রশিক্ষণ দিত ফ্রান্স। সংখ্যালঘুদের উদ্ধারে 'অপারেশন টারকোয়েজ' নামে যে ফরাসি অভিযান গণহত্যার শেষদিকে রুয়ান্ডায় পরিচালিত হল, পরে প্রমাণিত হল সেটা ছিল মূলত হুতুদের মিশন কণ্টকমুক্ত করতেই।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা না বলতে জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বারণ করেছিলেন

তুতসি নেতা পল কাগামে এবং তাঁর দল রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টের (আরপিএফ) বিজয় ঠেকাতেই ফ্রান্সের এই অভিযান ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। আরপিএফ যখন সরকার উচ্ছেদ করে ক্ষমতায় বসল ফ্রান্স তখন তাদের গড়া টারকোয়েজ জোন দিয়ে পলায়নপর হুতুদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে গেল। এমনকি জেনোসাইডের নীলনকশাকারী রুয়ান্ডার সাবেক ফার্স্ট লেডিকে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়েছিল ফ্রান্স।

এভাবেই নীরবে নিভৃতে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল একটি জাতির দশ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক ঘটনা অনুচ্চারিত থাকলেই সবার স্বস্তি। কেননা এর দায় সবার। দায় যেমন পরাশক্তিদের, জাতিসংঘের, এর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের, অ্যামনেস্টির– তেমনি মিডিয়ার, বিশ্ববিবেক বলে পরিচিত মানুষদের, সুশীল সমাজের। একশ দিনের মাথায় যখন পটপরিবর্তন ঘটল, ইনফরমেশন বাইরে আসতে শুরু করল, ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে।

গণহত্যার ধরন বরাবর এমনই। সুপরিকল্পিত, অনেকদিন ধরে টার্গেটেড জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা; সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি যুবসমাজের মধ্যে ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে টার্গেটের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া এবং এর ফলে বহির্বিশ্বের কাছে জনরোষ বলে চালিয়ে দেওয়া; টার্গেটেট গ্রুপকে মিলিশিয়া, সন্ত্রাসী বা জঙ্গি আখ্যায়িত করা বা তাদের দুর্বল প্রতিবাদ ও আত্মরক্ষার চেষ্টাটি প্রোপাগাণ্ডার মেশিনে ঢুকিয়ে বিশাল করে প্রচার করা। রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল।

রুয়ান্ডা বিভীষিকার ঠিক তেইশ বছর পর লোকচক্ষুর আড়ালে আরেকটি গণহত্যার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে এই এশিয়ায়, মিয়ানমারে। টার্গেট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের বিবেচনা করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী, অনুচ্চকণ্ঠী, ভূখণ্ডহীন, অধিকারহীন, প্রতিবাদঅক্ষম, বিশ্বচোখের আড়ালে পরে থাকা বিস্মৃত এক জাতি হিসেবে। গত শতাব্দীর শুরু থেকেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে নিপীড়ন-নির্যাতনসহ নানান পন্থা-পরিকল্পনা করতে থাকে মিয়ানমারের উগ্র বর্ণবাদী মৌলবাদী সরকার। হাজার বছর ধরে বসবাস করা, প্রধানত কৃষক এই নিরীহ নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে, হত্যা করে উচ্ছেদ করতে বিশেষত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নীলনকশার শেষ দৃশ্য এখন মঞ্চস্থ হচ্ছে দেশটির রাখাইন রাজ্যে, নাফ নদী অববাহিকায়, বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে।

গত এক মাসে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ-শিশু। আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এ পর্যন্ত চার লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রাণের ভয়ে উদভ্রান্তের মত পালাচ্ছে বাকিরা। যে যেদিকে পারছে। পথেই মারা যাচ্ছে অনেক, স্বজন হারিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য, ধরা পড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে কেউ কেউ। এক শিশু আরেক শিশুকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াচ্ছে মাইলের পর মাইল, ঝড়-বৃষ্টি-কাদা মাড়িয়ে। সন্তান ছুটছে বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঘাড়ে নিয়ে।

এই দলে আছে শত শত গর্ভবতী নারী, আছে প্রতিবন্ধী, নবজাত শিশু। আছে চলৎশক্তিহীন অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ, আহত জন। বাংলাদেশে যারা এসেছে তাদের ফেরার পথ বন্ধ করতে সীমান্তে পোঁতা হচ্ছে স্থলমাইন।

রোহিঙ্গাদের এই মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সকল অর্থেই রুয়ান্ডার তুতসিদের সঙ্গে তুলনীয়। আর সবচেয়ে বড় সাদৃশ্যটা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নিস্পৃহতা, নির্লিপ্ততা, প্রতিক্রিয়াহীনতা। বসনিয়ার স্রেব্রেনিসায় জেনোসাইড চলাকালে চোখ বন্ধ রাখার ফসল রুয়ান্ডা।

রুয়ান্ডায় নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতার পর এমন ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বমোড়লরা নতুন এক রেজ্যুলুশনে একমত হয়েছিল– রেসপনসিবিলিটি টু রিঅ্যাক্ট । যাবতীয় অমানবিকতা-বর্বরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং প্রতিক্রিয়া জানানো জাতিসংঘ ও এর সদস্য রাষ্ট্রদের দায়িত্ব। অবস্থা বুঝে হস্তক্ষেপেরও তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

ভবিষ্যৎ কোনো গণহত্যা রুখতে ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল মহাসচিব কফি আনান জেনেভাস্থ হিউম্যান রাইটস কমিশন বরাবর পাঁচটি অ্যাকশন প্ল্যান উপস্থাপন করেছিলেন। গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান ঠেকাতে এই পাঁচ দফায় সবার মতৈক্য হয়।

ভবিষ্যৎ কোনো গণহত্যা রুখতে ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল মহাসচিব কফি আনান হিউম্যান রাইটস কমিশন বরাবর পাঁচটি অ্যাকশন প্ল্যান উপস্থাপন করেন

প্রথম দফায় আছে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মহলের মীমাংসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় দফায় আছে, নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তৃতীয় দফায় তিনি বলেছেন, যারা বা যে গোষ্ঠী গণহত্যা বা নির্মূলাভিযান চালাচ্ছে তাদের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আদালতে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা। চতুর্থ দফাতে আছে, লুকোচুরি নয়, পরিস্কারভাবে এবং শুরু হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী এবং বিশ্বকে সম্ভাব্য গণহত্যার বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক করতে হবে। গণহত্যাকে অন্য শব্দের আড়ালে ঢেকে রাখলে যে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা নব্বই দশকে দুই দুইবার বিশ্ব টের পেয়েছে। সম্ভাব্য গণহত্যা ও গোষ্ঠী নির্মূলতার চিহ্ন ও সংকেত আগে থেকেই বুঝা যায়। কফি আনান এসব আলামত বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিক অ্যাকশন নেওয়ার জন্য জাতিসংঘে বিশেষ উপদেষ্টার একটি পদও তৈরি করেছেন। এই উপদেষ্টার দায়িত্ব গণহত্যার সতর্কবাণী মহাসচিবের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কমিশনে জানানো। পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, গণহত্যা কিংবা সম্ভাব্য গণহত্যা নিরসনে দ্রুত এবং সরাসরি হস্তক্ষেপ।

সমষ্টিগত ব্যর্থতায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পর, লাখ লাখ নারী ধর্ষিত-নিগৃহীত হওয়ার পর, লাখ লাখ মানুষকে শরণার্থী জীবনে ঠেলে দেবার পর ঘুমভাঙা জাতিসংঘ এই পাঁচটি অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করেছিল। তের বছরের মাথায় এই পয়েন্টগুলো বালিশ বানিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল জাতিসংঘ! আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল বিশ্বমোড়ল, মিডিয়া এবং সুশীলবৃন্দ। রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে কফি আনানের কোন পয়েন্ট কার্যকরী হতে দেখেছি? প্রতীয়মান হচ্ছে, এই গ্রহ ইতিহাসের আরেক নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও একটি জাতির বিনাশ নীরবে ঘটে যেতে দিবে। তারপর আবার শুরু হবে আত্মসমালোচনা, বিবৃত হবে কালেকটিভ ফেইলোরের গ্লানি। নতুন করে আবার রেজ্যুলুশন, আবার আরলি ওয়ার্নিং মেকানিজমের থিওরি।

'হোটেল রুয়ান্ডা' র মতো আবার হলিউডে ছবি হবে 'হোটেল আরাকান' । বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের নিয়ে আরেকটি 'দ্য ল্যান্ড বিটুইন' তৈরি হবে। তারপর আবার অপেক্ষা।

পৃথিবীর কোথাও না কোথাও– আজ বা কাল– ধর্মের নামে বা বর্ণের নামে– জেনোসাইড ঘাপটি মেরেই আছে। আমাদের নীরবতায় আমাদের ব্যর্থতায় আমাদের নিষ্ক্রিয়তায় সেই হায়েনা আমাদেরই প্রিয় কোনো জাতি-গোষ্ঠীর উপর হামলে পড়বে।

SCROLL FOR NEXT