অভিমত

রোহিঙ্গাদের কি বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া উচিত?

Byরাহমান নাসির উদ্দিন

বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেড় যুগের বেশি সময়ের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, প্রশ্নবোধক শিরোনামের উত্তর কেবল 'হ্যাঁ' বা 'না' বলে দেওয়া সম্ভব নয়। যদি 'হ্যাঁ' বা 'না' দিয়েই দেওয়া যেত তাহলে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ আলোচনা, সমালোচনা, অনুরোধ ও নহিসত চলছে তা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত।

বিস্তারিত আলোচনা শুরু আগে সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে পেশ করছি–

৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তিনটি সীমান্ত চৌকিতে অস্ত্রধারীরা হামলা করে ৯ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী 'শুদ্ধি অভিযান' শুরু করে। কেননা 'এ হামলা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা করেছে'– এ রকম একটি আন্দাজনির্ভর তথা অনুমিত সিদ্ধান্ত থেকে এ অভিযানের শুরু। আর এ শুদ্ধি অভিযানের নামে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ৩০ হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়েছে। প্রায় ১০০ রোহিঙ্গাকে (কারও কারও মতে ৬৯) খুন করা হয়েছে। আর নারী-শিশু-বৃদ্ধের উপর নির্বিচারে অমানবিক নির্যাতন এবং বর্বর অত্যাচার তো চলছেই।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর নিয়মিতভাবে প্রচার করার কারণে বিশ্বব্যাপী একটি মানবিক সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে এবং সেটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর তীব্রতা ধারণ করেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা নিকটবর্তী টেকনাফ/উখিয়া সীমান্ত পেরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রও শক্ত অবস্থান নিয়েছে; 'আলগা লোক যাতে ঘরে প্রবেশ করতে না পারে' সেজন্য সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে কড়া পাহারা বসিয়েছে।

কিন্তু এত কড়া পাহারার মধ্যেও রাষ্ট্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে নানাভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকা টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রবেশ করেছে; এখনও করছে। জীবনের মায়া বলে কথা। জীবন বাঁচানোর তাগিদ যেখানে কাজ করে সেখানে রাষ্ট্রের চোখ ফাঁকি দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পশ্চিমা হেডকোয়ার্টারে বসে মানবতাবাদের 'দরদিয়ানা' দেখাচ্ছে আর বাংলাদেশকে বর্ডার খুলে দেওয়ার অনুরোধ করছে। বাংলাদেশের ভেতরেও সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে কি রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া উচিত?

এ প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও নানা প্রশ্ন। রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে জনপরিসরে এবং ভার্চুয়াল জগতে যেসব বিষয় আলোচিত হচ্ছে, সংক্ষেপে তার কয়েকটি বিষয় এখানে বিশ্লেষণ আকারে পেশ করছি–

বাংলাদেশের ভেতরেও সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে

সু চি, মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে অং সাং সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করলে 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করছে' বলে অনেকে মন্তব্য করেছিল। 'মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন' হচ্ছে বলে এক ধরনের তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দেখা গেছে অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিতকে। তাদের ভরসার জায়গা হচ্ছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অং সাং সু চি, যিনি 'গণতন্ত্রের মানসকন্যা' হিসেবে পরিচিতি। কিন্তু চেয়ারে না বসলে চেয়ারম্যানের/চেয়ারউওম্যানের (চেয়ারপারসন) আসল চেহারা চেনা যায় না।

ক্রাইসিস বা সংকট হচ্ছে মানুষ পরিমাপের 'ব্যারোমিটার'। তাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির ভূমিকা দেখে অনেকের ঘোর কেটেছে; অনেকের নতুন করে হুঁশ হয়েছে। সু চির রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন হিসেবে বিবেচনা করে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি নিয়ে যারা প্রেডিকশন করেছিলেন, তাদের এখন লজ্জ্বায় মাথা কাঁটা যাওয়ার মতো অবস্থা। বিশেষ করে জাতিগত সহিংসতার বলি হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের যেভাবে অমানবিক নির্যাতন ও নির্বিচারে খুন করা হচ্ছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট করে যেভাবে বর্বরতা চালানো হচ্ছে, তা একুশ শতকের বিশ্বমানবতা ও মানবসভ্যতার জন্য অত্যন্ত লজ্জার।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সু চির আসল 'কদাকার' চেহারা এসব জাতিগত-নির্যাতনকে আসকারা দেওয়ার ভেতর দিয়ে নতুন করে প্রতিভাত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর নির্যাতনের জন্য এবং এ নারকীয় অত্যাচারে সমর্থন দেওয়ার জন্য সু চির নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেওয়ার দাবি উঠেছে। এ দাবিতে তৈরি করা অনলাইন আবেদনে সারা পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ সই করেছে এবং করছে।

আবার অনেকে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য 'অশান্তিতে নোবেল' প্রবর্তনের দাবি তুলেছে। তাদের মতে, প্রথম পুরস্কারটা সু চিকে দেওয়া উচিত। এ থেকেই প্রমাণিত হয় সু চির নিষ্ঠুর নিরবতা রোহিঙ্গাদের উপর বর্বরোচিত হামলা ও অত্যাচারে তাঁর সমর্থনের ইঙ্গিত করে।

সু চির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে। জাতিসংঘ, পশ্চিমা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিংবা ইউএনএইচসিআর… এরা এখন কোথায়? আন্তর্জাতিক কমিউনিটি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যারা সকাল-বিকাল গণতন্ত্রের সবক দেয়, সুশাসনের বয়ান দেয়, গণতন্ত্রের অবতার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে হাজির হয়, মানবাধিকার রক্ষার নামে নিত্য আহাজারি করে, তারা এখন কোথায়?

যারা বাংলাদেশকে বর্ডার খুলে দেওয়ার অনুরোধ করে, তারা মিয়ানমারকে অত্যাচার বন্ধ করার ব্যাপারে চাপ দেয় না কেন?

আসলে পৃথিবীর দেশে দেশে সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগতভাবে ভিন্ন, বিশ্বাসে ভিন্ন কিংবা নিম্নবর্গের মানুষের উপর রাষ্ট্রযন্ত্র এবং শাসকশ্রেণির অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই শাসনযন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসকশ্রেণির ক্রমবর্ধমান নিপীড়িনের বিরুদ্ধে বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগণের সম্মিলিত এবং সমন্বিত লড়াই ছাড়া কোনো মুক্তি নেই। তাই সর্বদা সর্বত্র লড়াই জারি রাখতে হবে এবং মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।

রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর নির্যাতনের জন্য এবং এ নারকীয় অত্যাচারে সমর্থন দেওয়ার জন্য সু চির নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেওয়ার দাবি উঠেছে

ধর্মীয় রাইয়ত বনাম জাতিগত সংঘাত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর যে বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চলছে, সেটাকে 'বৌদ্ধ' বনাম 'মুসলিম'এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবে উপস্থাপনের একটা চতুর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়। কেননা, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি ব্যবহার করে কেউ যেন সাম্প্রদায়িক উস্কানি না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনকে ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর আঘাত হিসেবে উপস্থাপন করে একটা বিশেষ গোষ্ঠী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন মূলত এক ধরনের জাতিগত সংঘাতের ফল।

রোহিঙ্গা একটা স্বতন্ত্র জাতি আর বার্মিজ একটা জাতি। মিয়ানামারে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চলছে জাতিগত সংঘাতের জেরে, এতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে। একে জাতিগত সংঘাত না বলে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' বলাই সংগত।

১৯৮২ সালের 'মিয়ানমার সিটিজেনশিপ ল' সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, সেটি পাস হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গারা মূলত রাষ্ট্রবিহীন মানুষ। পৃথিবীতের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ রাষ্ট্রবিহীন যাদের মধ্যে সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। মিয়ানমারকে রোহিঙ্গামুক্ত করার 'রাষ্ট্রীয় পলিসি'র অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের উপর বারবার অত্যাচার এবং নির্যাতন চলছে কারণে-অকারণে।

১৯৭৮ সালে, ১৯৯১-৯২ সালে এবং ২০১২ সালে মিয়ানমার সামরিক জান্তা কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা সাম্প্রতিক বিশ্বইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। সে বিবেচনায় এটা কোনোভাবেই মুসলিম এবং ইসলামের উপর আক্রমণ নয়। কিংবা এটা কোনোভাবেই ধর্মীয় সংঘাত বা রাইয়ত হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যে কোনো রোহিঙ্গা জাতি নয়, কিংবা কোনো মুসলিম ধর্মাবলম্বী নয়; বরং মানুষ ও মানবতা নির্যাতিত-লাঞ্ছিত হচ্ছে– বিষয়টি এভাবে দেখতে হবে।

সে কারণেই আমাদের সবাইকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা মানবতা যেখানে ভূলুণ্ঠিত হবে, মানুষ হিসেবে সেখানে দাঁড়ানোটাই সবচেয়ে বড় মানবতা। তাই এটা আমাদের মানবতাবোধেরও এক ধরনের পরীক্ষার সময়।

'অতীতের অভিজ্ঞতা তিক্ত, তাই আর কোনো রোহিঙ্গা নয়'

বাংলাদেশে কি রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া উচিত? এ প্রশ্ন কেন্দ্র করে জনপরিসরে বেড়ে ওঠা আলাপ-আলোচনায় কিছু বিশেষ অভিযোগ/অনুযোগ সামনে আনা হয়। সংবাদপত্রের লেখালেখি এবং টেলিভিশনের টক শোগুলোতেও বারবার এ বিষয়গুলো উঠে আসছে। ফলে আমাদের এন্তার চিন্তাভাবনা এসব অভিযোগ-অনুযোগ সামনে রেখে আবর্তিত হচ্ছে। যেমন:

রোহিঙ্গারা অনেক সমস্যা তৈরি করছে;

বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের দুর্নাম করছে;

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুরি-ডাকাতি-সামাজিক অপরাধ বেড়ে গেছে রোহিঙ্গাদের কারণে;

এলাকার পরিবেশ-বন-জঙ্গল ধবংস করে ফেলছে রোহিঙ্গারা;

পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পালছে, আর কত?

সর্বোপরি রোহিঙ্গারা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

এসব অভিযোগের পুরোটা সত্য না হলেও কিছুটা সত্যতা অবশ্য আছে। কিন্তু এসবের বাইরেও কিছু ভিন্ন ন্যারেটিভও আছে যা আমি 'To Host or To Hurt: Counter-narratives on the Rohingya Refugee Issues in Bangladesh' বইয়ে সবিস্তার লিখেছি। এ পরিসরে অতটা আলোচনায় যাওয়া সম্ভব নয়।

শুধু এটুকু বলব, অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা তিক্ত বলে পাইকারি হারে রোহিঙ্গাদের একটা 'সমস্যা' হিসেবে চিহ্নিত করে 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই' কিংবা 'সম্ভাব্য সামাজিক ক্ষতির ক্যালকুলেশন' অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে মানুষ ও মানবতার আঁকুতি আমরা যদি পায়ে ঠেলে দিই, তবে সেখানে মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থানটাও খাট হয়ে যায়।

যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বমানবতার কীর্তন গেয়ে 'মানবতার দোকানদারি' করে তাদের কথা আলাদা। কেননা সেখানে যতটা মানবতা থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে রাজনীতি। এসবের বাইরেও বলা যায়, পাশের বাসায় আগুন জ্বলছে, সে আগুন আমি নেভাতে না পারি কিন্তু আগুনে ঘরপোড়া মানুষগুলোকে সাহারা দেওয়ার চিন্তা তো মানুষ হিসেবে করতেই পারি। কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কিংবা সম্ভাব্য সামাজিক সমস্যার দোহাই দিয়ে ঘরপোড়া মানুষগুলোকে আবার আগুনের মধ্যে ঠেলে দেওয়া নিশ্চয়ই মানুষের কাজ নয়!

যারা কোনোরকমে প্রাণটুকু নিয়ে পালিয়ে এসেছে আমাদের বাহাদুর সীমান্তরক্ষীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে

দয়া বনাম অধিকার

রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে একটু 'দয়া' দেখানোর জন্য দেশে-বিদেশে সর্বত্র একটা কাতর আহাজারি চলছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ কাতরতা ক্রমান্বয়ে তীব্র হচ্ছে। কারণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্মম নির্যাতন ও বর্বর অত্যাচার চলছে, তা অকল্পনীয়। তাই সবাই আকুতি করছে যাতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের খানিকটা 'দয়া' করে। কিন্তু যারা কোনোরকমে প্রাণটুকু নিয়ে পালিয়ে এসেছে আমাদের বাহাদুর সীমান্তরক্ষীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের ফেরত পাঠাতে (পুশ ব্যাক) সক্ষম হয়েছে। মিডিয়াও আবার অতি-বাহাদুরিপনা দিয়ে সে সংবাদ প্রচার করছে।

কিন্তু এটা মনে রাখা জরুরি যে, মৃত্যুকূপ থেকে কোনোরকমে জান নিয়ে পালিয়ে আসা মানুষকে আবার মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার মধ্যে বাহাদুরি নেই। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মধ্যে বাংলাদেশের 'দয়া' দেখানোরও কিছু নেই; এটা রোহিঙ্গাদের অধিকার। জাতিসংঘ সনদে শরণার্থীদের আশ্রয়প্রাপ্তি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত আর জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ।

অনেকে বলে থাকে, বাংলাদেশ ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত 'ইন্টারন্যাশনাল রিফিউজি কনভেনশন'এ সই করেনি; তাই শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ আইনগতভাবে বাধ্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ প্রণীত 'আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ'এ স্বাক্ষরকারী দেশ (স্বাধীনতার পরে অনুসমর্থনকারী দেশ)। ওই সনদের ১৪(১)এ পরিষ্কার লেখা আছে–

"Everyone has the right to seek and to enjoy in other countries asylum from persecution."

অর্থাৎ অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যেক মানুষের অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় চাওয়া এবং শরণার্থী হওয়ার অধিকার আছে।

সুতরাং রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশে আশ্রয় চাইছে সেটা মোটেও বাংলাদেশের 'দয়া' করার বিষয় নয়, এটা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের অধিকার। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশও বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের 'কনসার্ন' জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পার্লামেন্টারি কমিটিও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সমবেদনা জানিয়েছে। অনেকে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব/পরামর্শ দিচ্ছে।

এ রকম অবস্থায় বাংলাদেশে কি রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া উচিত, এ প্রশ্নের উত্তর কী? আমার একজন শিক্ষার্থী উত্তর দিয়েছে, "আগে মানবতা, পরে সমঝোতা।"

SCROLL FOR NEXT