তারবার্তায় মুজিব

তারবার্তায় মুজিব: মার্চেও কনফেডারেশনের পরামর্শ দিয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস

Byবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

২৫শে মার্চ কালরাতের পর ঢাকায় গণহত্যা নিয়ে তার পাঠানো বার্তা এবং সুবাদে অসহযোগের ঘোষণা গোটা মার্কিন প্রশাসনে আলোড়ন তুলেছিল এবং স্বীকৃতি পেয়েছিল ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে। তবে এ বার্তাটি আরও দুই সপ্তাহ আগের, নির্দিষ্ট করে বললে ১১ মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড তখন ব্যাংককে। জরুরি ভিত্তিতে তার কাছেও পৌঁছে দেওয়ার উল্লেখ ছিল বার্তার শিরোনামে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। তারবার্তাটি মূলত চলমান অচলাবস্থা কাটিয়ে তোলার জন্য ব্লাডের তরফে সুপারিশ যেখানে দুই অংশকে একটা কনফেডারেশন হিসেবে টিকিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে। আর পূর্ব পাকিস্তানকে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলা দেশ হিসেবে, স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলা এবং দেশ আলাদাই উচ্চারিত হতো এবং লেখা হতো। চলুন এর ভাবানুবাদে।]

বিষয়: একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা যাচাই

১. চলমান যে সংকটটি গোটা পাকিস্তানকে গিলে খাচ্ছে তার একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে আমাদের উদ্দেশ্যের গলদগুলো স্বীকার করে নেওয়া উচিত। এই একাত্তরের মার্চের ঢাকায় আমাদের বস্তুনিষ্ঠ থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে, বোকার মতো রাখঢাক না রেখেই আমাদের গাড়িতে এবং আবাসিকরা (ঢাকার মার্কিন নাগরিকরা) কালো পতাকা উড়াচ্ছেন, রাস্তায় হাসিমুখে আমরা ‘জয় বাংলা’ সম্ভাষণ বিনিময় করছি। প্রতিদিন আমরা কান পেতে শুনছি বাঙালির স্বপ্নের কথা- যা সাহস, মঙ্গলাকাঙক্ষা, আদর্শ, প্রাণীজ চতুরতা, ক্রোধ এবং দেশপ্রেমের এক হৃদয়গ্রাহী মিশেল। ঢাকা বেতারে শুনছি এবং ঢাকার টিভিতে দেখছি বাঙালি জাতীয়তাবাদের চমকপ্রদ মেলে ধরা। আমরা দেখছি ছাত্র এবং শ্রমিকদের সৈনিক হয়ে ওঠার হাস্যকর প্রচেষ্টা।

২. অন্যদিকে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ শূন্যের কোঠায়। অ্যাডমিরাল আহসান (৭ই মার্চের আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর) এবং জেনারেল ইয়াকুবের (অগাস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর) মতো পুরানো সূত্রগুলো হয় চলে গেছেন, নয়তো যাচ্ছেন। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য আমরা স্রেফ অনুমান করতে পারছি, আশা করছি তারা আবেগের বদলে যুক্তি দিয়ে চলবেন এবং এই বাজে পরিস্থিতি থেকে যতোটা সম্ভব বের হয়ে আসার পথ বের করতে চেষ্টা চালাবেন।

৩. আমাদের চোখে এই রাজনৈতিক সংকট এলএফও (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা আইনি অবকাঠামো) এবং ছয়দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের জাতীয় সংসদের আলোচনা ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে গেছে। নির্বাচনের ফলাফলই এই সম্ভাবনাকে পরাহত করেছে, যা প্রথমত আওয়ামী লীগকে অপ্রত্যাশিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেওয়ার মাধ্যমে পছন্দের সংবিধান তৈরির সুযোগ দিয়েছে, এবং দ্বিতীয়ত ভুট্টোকে বেশি হলে পাঞ্জাবের গভর্নর কিংবা সংসদে বিরোধী দলের নেতার চেয়ে বড় কোনো ভূমিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে। এখন এমন একটা সমাধান দরকার যাতে ভুট্টো কিছু পাবেন, মুজিব কিছু পাবেন, ইয়াহিয়া এবং সেনাবাহিনী কিছু পাবে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা কোনমতে টিকিয়ে রাখা যাবে এবং পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার মতো সময় মিলবে।

৪. এমন একটা সমাধান হতে পারে কনফেডারেশন। ভুট্টো তার পছন্দমতো সংবিধান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। মুজিব তার নিজস্ব সংবিধান নিয়ে বাংলা দেশের (ভূগোলবিদরা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান কথাটা আর কেউ ব্যবহার করছে না) প্রধানমন্ত্রী হলেন। আর ইয়াহিয়া কনফেডারেশন অব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকলেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দুই অংশ থেকেই নিয়োগ নিবে এবং দুই অংশেই কার্যকর থাকবে।

৫. অবশ্য এই সমাধানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে পররাষ্ট্রনীতি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভুট্টো ও মুজিবের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী মনোভাবের কারণে একটা একক পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের প্রয়াসকে কঠিন মনে হচ্ছে। এই বৈপরীত্য কাটিয়ে উঠতে হয় সমঝোতামূলক নিরপেক্ষ একটা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে হবে অথবা মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রস্তাবিত পররাষ্ট্র নীতি মেনে চলতে হবে বিনিময়ে তিনি স্বাধীনভাবে বাংলা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। 

৬. কনফেডারেশন প্রস্তাবনার আরেকটি অসুবিধা, বিশেষ করে ইয়াহিয়ার চোখে, কনফেডারেশন হলে সেটা বাংলা দেশকে পূর্ণ স্বাধীনতার দিকে অর্ধেক এগিয়ে দেবে।

৭. আরেকটা সমাধান আমাদের কাছে সমঝোতার প্রস্তাবাকারে এসেছে আর তা হচ্ছে দুই অংশে দ্রুত প্রাদেশিক সরকার গঠন করা, কিছুদিনের জন্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত রাখা, পয়লা মার্চের আগ পর্যন্ত যেভাবে চলছিল সেভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। মুজিবের কাছে এই সমাধান বঞ্চনা মনে হতে পারে কিন্তু ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো এটাকেই বেশি গ্রহনযোগ্য মনে করতে পারেন। সত্যি বলতে এটা কোনো সমাধান না, বরং একরকম স্থগিত রাখা, যাতে একটু সময় পাওয়া যায়। বাংলা দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাকি অংশের সম্পর্কের ধারা নির্ণয়নের মূল যে প্রশ্ন, পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করে তার উত্তরটা খুঁজতে হবে, পাশাপাশি রাজনৈতিক উন্মাদনা খানিকটা প্রশমনের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারকেই সঁপে দিতে হবে।

৮. বিকল্প উপায় আর কী? ছয় দফার সঙ্গে আপস করে মুজিবের সংসদ অধিবেশনে সংবিধান প্রণয়নে বসার প্রশ্নই আসে না। এটা হবে মুজিবের জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যা। তার লোকেরা (বাংলাদেশের জনগণ) এটা মেনে নেবে না। আমরা ওই পর্যায়টা পেরিয়ে এসেছি। সেনা অভিযানের বাস্তবতা এখন আর সম্ভাবনার পর্যায়ে নেই। কিন্তু তার সুবাদে খানিকটা দেরিতে হলেও নিশ্চিত হবে বাংলা দেশের স্বাধীনতা।

৯. সবদিক বিচার করলে প্রায়োগিক অসুবিধাগুলো আমলে নিয়েও কোনোরকমের কনফেডারেশনই হচ্ছে আমাদের চোখে এই দোদুল্যমান পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সম্ভাব্য সেরা সমাধান।

ব্লাড

SCROLL FOR NEXT