অর্থনীতি

দিন বদলের ৩ প্রকল্পের দুয়ার খুলবে ২০২২

Byজাফর আহমেদ
ফাইল ছবি

অনেক আলোচনা, পরিকল্পনা আর নির্মাণের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে প্রায় পুরো দৃশ্যমান হতে থাকা এ তিন মেগা প্রকল্প চালু হলে সমৃদ্ধ হবে দেশ, বাঁক বদল হবে অর্থনীতির; সরকারের নীতি নির্ধারক ও অর্থনীতিবিদদের সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন শুরুর বছর হতে যাচ্ছে ২০২২।

দেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা সেতু এবং প্রথমবারের মতো হতে যাওয়া মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেল চালুর মাধ্যমে দেশে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা হবে বলে তারা আশা করছেন।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এক পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমেই দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে; যেটি চলাচলের জন্য আগামী জুনে খুলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে সরকার।

আলোচিত আরেক প্রকল্প চট্টগ্রামের কর্নফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কক্সবাজার ও বন্দরনগরীর মধ্যে গড়ে দেবে উন্নত যোগাযোগ সেতুবন্ধ, যা বিনিয়োগে দেবে নতুন হাওয়া। চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাইয়ের ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ এর আদলে গড়ে তুলতে হাতে নেওয়া এ প্রকল্পও শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

আর ঢাকাবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল এখন পর্যন্ত ঘোষণা অনুযায়ী ডিসেম্বরে যাত্রীসেবায় নেমে গেলে বলা হচ্ছে পাল্টে যাবে রাজধানীর গণপরিবহনের চিত্র; বাড়বে চলাচলের গতি।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ তিন প্রকল্প শেষ করার কথা কিছু দিন আগেও জানিয়েছেন আবার।

অর্থনীতিবিদ, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ তিন মেগা প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পালে লাগবে নতুন দিনের হাওয়া। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশ হওয়ার নতুন সিঁড়ি যুক্ত হবে পথ চলায়। শুধু এ তিন প্রকল্পই মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে অন্তত দেড় শতাংশ অবদান রাখবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ তিন মৌলিক অবকাঠামো সরাসরি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

“মহাপ্রকল্প পদ্মা সেতু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে। পণ্যের চলাচল বেড়ে জিনিসপত্রের দর স্থিতিশীল রাখবে। খুব দ্রুত ওই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন শুরু হবে। ওই অঞ্চলের সমৃদ্ধির পথে হাঁটা শুরু হবে।”

তিনি বলেন, কর্ণফুলীর টানেল শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রে নয়, দক্ষিণ চট্টগ্রামকেন্দ্রীক চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের গড়ে তোলা শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগে গতি আনবে, টানবে নতুন বিনিয়োগ।

এ তিন প্রকল্প চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অন্তত দেড় শতাংশ বাড়েব। শুধু তাই নয় ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে প্রকল্প তিনটি ‘বিরাট’ অবদান রাখবে বলে প্রতিমন্ত্রীর প্রত্যাশা।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এম শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পদ্মা সেতুর কারণে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ শুরু হলে সময়ের যে উপযোগিতা সেটা আমরা অর্থনীতিতে পাব।

তিনি বলেন, এতদিন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল শুধু নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে পিছিয়ে ছিল। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে অঞ্চলটি বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে।

“খুলনা অতীতেও একটা শিল্পাঞ্চল ছিল। কিন্তু রাজধানীর সঙ্গে অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মার খেলেও পদ্মা সেতুর মাধ্যমে অঞ্চলটি ঢাকার কাছে চলে আসবে।“

পুরনো শিল্পাঞ্চল জেগে উঠার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে পুরো অঞ্চল সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন এ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।

তার মতে, কর্ণফুলী টানেল দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলার মতো আরেকটি প্রকল্প। এ টানেল দেশের ভারী অর্থনীতির অবকাঠামো হিসেবে আর্বিভূত হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল ওই দুই অঞ্চলে বিপুলভাবে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

“ওই বিনিয়োগ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং আঞ্চলিক তথা দেশের বাজার বড় হবে।”

মেট্রো রেল ঢাকার গণপরিবহনে নতুন অভিজ্ঞতা দেবে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর একপ্রান্ত উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভ্রমণ নিশ্চিত হলে এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার মানুষের চলাচলে যে গতি আসবে, তা জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

ঋণ দেওয়া নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের পর পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে মন্তব্য করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ সেতু ওই অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য ও কৃষি পণ্যের বৃহত্তর বাজার ধরার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

“এখন থেকে প্রতি বছর কয়েকটি করে মেগা প্রকল্প চালু হবে। এসব প্রকল্পের ওপর ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতি উড়া শুরু করবে।“

তবে এসময়ে সঠিক নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা ওয়ান স্টপ সেবা চায়। কিন্তু সরকার এখনও তা নিশ্চিত করতে পারেনি।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

কতটুকু এগোল তিন প্রকল্প

সরকারের পরিকল্পনা মতো আগামী জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু গাড়ী চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দিতে কাজ চলছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রকল্পের সর্বশেষ সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ শতাংশ। মূল সেতুর সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৯৬ শতাংশ। নদী শাসনের কাজ এগিয়েছে ৮৬ শতাংশ।

সেতুর স্টিলের কাঠামোর ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানো শেষে এখন দুই মাস ধরে কার্পেটিং করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি শেষ হতে আরও প্রায় চার মাসের মতো লাগতে পারে। এরপর লাইটিংয়ের কাজ শুরু হবে।

পদ্মা সেতুর মতো অগ্রাধিকার দিয়ে ঢাকাতেও চলছে মেট্রো রেলের কাজ। বৃহস্পতিবার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার পথে ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রথম এ মেট্রো রেলের পুরো অংশের নিরবচ্ছিন্ন কাঠামো দৃশ্যমান হল।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ঢাকার বিপর্যস্ত গণপরিবহনকে পাল্টে দিতে হাতে নেওয়া এ মেগা উদ্যোগ বাস্তবায়নকারী ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বৃহস্পতিবার জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার মেট্রো রেল চালু হবে। পরের বছর ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৩৭ কিলোমিটারে চলবে ট্রেন।

সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৯০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৩ দশমিক ০৮ শতাংশ

অপরদিকে কর্নফুলী নদী তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ শতাংশ।

প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে জোর প্রচেষ্টা চলছে। তবে কোভিড পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

SCROLL FOR NEXT