নাগরিক সংবাদ

অতি বন্দনায় উচ্ছ্বসিত সমুদ্র ঢেউ

Byজাগো বাহে জাগো

ঢাকা এখন উৎসবের নগরী। ঢাকার অলি গলি রাজপথ এখন ব্যানার ফেস্টুন আর বড় বড় তোরণে ভরপুর। বড় নেতাদের বড় বড় তোরণ-ব্যানার ! ছোট নেতারাও কম যান না। এ উপলক্ষে অন্তত পক্ষে একটা পোষ্টার না ছাপালে যেন নিজেকে নেতাই মনে হয় না ! এক শাপলা চত্বর এর শাপলা ফেন্সিং ঘিরেই অর্ধশতাধিক ডিজিটাল প্রিন্টেড ব্যানার। সারা ঢাকা শহরের অবস্থা কি তা এখান থেকেই অনুমেয় ! দলের সাফল্যের জয়গান গাইবার সাথে নিজেদের প্রচারণার সুযোগটা হাতছাড়া করাটাতো বোকামী। তাই এ উপলক্ষ যেন নিজেকে জাহির করারও একটা মোক্ষম সুযোগ। এ কি হাতছাড়া করা যায় ! কোথাও কোথাও মাইকিং চলছে অনবরত এ সমাবেশে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে ।

কেন এই পোষ্টার-ব্যানার-তোরণ বা মাইকিং? কী বা এর উপলক্ষ ?

সহজ কথা হলো- সমুদ্র জয়(!) এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এবং আগত সংবর্ধনার বিষয়ে সাধারন মানুষকে জানানোর প্রচেষ্টা হিসেবে সর্বোপরি নিজেকে প্রচার করার জন্য এতো সব পোষ্টার ফেষ্টুনে ঢাকা শহর সয়লাব।

সমুদ্র জয় নিয়ে আগামীকাল ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত সাতটি যুবসংগঠন নিয়ে গঠিত যুবসংগ্রাম পরিয়দ এক বিশাল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শেখ হাসিনাকে সমুদ্র বিজয়ের জন্য সংবর্ধনা দেয়া হবে। এ গণসংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে ৫ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটানো হবে বলে জানা যায়।

কালকের সংবর্ধনায় সমুদ্রশোভিত সুবিশাল ডিজিটাল মঞ্চে লাখো যুব-জনতার উষ্ণ-ভালোবাসায় সংবর্ধিত হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চটি হবে থ্রিডিতে সাজানো। ভারচুয়াল ডিজাইনে মূল মঞ্চের পেছনে একের পর এক সাগরের ঢেউ খেলবে। সাগরের সম্পদ যেমন সামুদ্রিক মাছ, তেল, গ্যাসের দৃশাবলি থাকবে। মনে হবে সমুদ্রের ওপর মঞ্চটি নির্মিত হয়েছে। সংগীত পরিবেশন করবেন দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন ও এন্ড্র কিশোর । থিম সংগীত- 'দেশ দিয়েছে জাতির পিতা/সাগর দিলে তুমি,'' এছাড়া আরো চমক সাংসদ ও গায়িকা মমতাজ। তিনিও গাইবেন সমুদ্র বিজয় নিয়ে গান। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে মঞ্চ সাজাতে রাতদিন ১ হাজার কর্মী কাজ করে যাচ্ছেন।

এর পর আগামী ২৮ শে এপ্রিল সমুদ্রজয় উদযাপন জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে আর একটি সংগঠনও সমুদ্র জয় নিয়ে বিশাল এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সমুদ্রজয় উদযাপন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে অধ্যাপক জিল্লুর রহমানকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামানকে। এছাড়া ৫০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে ১১ জন কো-চেয়ারম্যান রয়েছে। এ জয়কে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে দুইটি রুটে ভ্রমণ করা হবে। আগামী ২১ থেকে ২৪ এপ্রিল পঞ্চগড় থেকে সেন্টমার্টিন এবং ৮ থেকে ১০ মে বাংলাবান্দা থেকে মংলা হয়ে সুন্দরবনের কটকা পর্যন্ত। এই ভ্রমণে যেসব জেলা কিংবা থানা শহর পড়বে সেখানে সংক্ষিপ্ত আকারে আনন্দ উৎসব করা হবে। ২৮ তারিখের অনুষ্ঠান একযোগে ৬৪টি জেলায় স্টেডিয়ামগুলোতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে লাইভ কাস্ট ও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এবং ঢাকার সংসদীয় আসনগুলোতে কনসার্ট করার ব্যাবস্থা করার চিন্তা ভাবনা চলছে।

কালকের সংবর্ধনায় সমুদ্রশোভিত সুবিশাল ডিজিটাল মঞ্চে লাখো যুব-জনতার উষ্ণ-ভালোবাসায় সংবর্ধিত হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ব্লগার জাহেদ ভাই যখন জার্মানির হামবুর্গের ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুন্যাল ফর দ্য ল' অফ দ্য সি'র (আইটিএলওএস) এর ১৪ মার্চ এ প্রদেয় ঐতিহাসিক রায় এর পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি'কে ধন্যবাদ জানিয়ে এই ব্লগে একটি লেখা পোষ্ট করেছিলো তখন যার পর নাই খুব খুশি হয়েছিলাম। এবং জাহেদ ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম এরকম একটি পোষ্ট দেয়ার জন্য। আসলে কিছু অর্জন এর প্রশংসা জনগনের কাছ থেকে স্বতস্ফুর্ত ভাবেই আসে। ব্লগাররা সাধারণ জনগনের অংশ।আমরা তাই করেছিলাম। সে সময়ে জাহেদ ভাইয়ের ধন্যবাদ জ্ঞাপন বা আমাদের মন্তব্য এ অর্জনকে মন থেকে স্বাগতম জানানোর প্রয়াস ছিলো।

কিন্তু দিন যেতে লাগলো আর এ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলো।

এক পক্ষ বলছে এ এমন এক অর্জন যা বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর আর অর্জন করতে সক্ষম হয় নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত হওয়ার পর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই বিজয়টি অর্জন করতে পেরেছে বলে তারা মনে করেন।
আর অপর এক পক্ষের মতে এটি কোন অর্জনই নয়। জনগনকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের দাবী তো প্রতিষ্ঠাই পায়নি বরং বাংলাদেশ হারিয়েছে বিশাল এক সমুদ্র-এলাকা।
একপক্ষ এ নিয়ে উৎসব করার জন্য বিশাল ব্যবস্থা নিয়েছে আর অপরপক্ষ এ অর্জনকে কি করে খাটো করে দেখা যায় তার জন্য বিবৃতি, বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছে অনবরত।

কিছুদিন পর রায় এর কিছু বর্ণনা, বিরোধী দলীয় নেতাদের বক্তব্য, তাদের এ নিয়ে করা ধন্যবাদ ফিরিয়ে নেয়া দেখে এবং কিছু কিছু পত্র-পত্রিকার লেখার ধরণটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। যে যার মতো ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। মূল বিষয় থেকে বের হয়ে যে যার মতো করে বলে যাচ্ছে। বিরোধী দল বা জামাত সমর্থিত পত্রিকাগুলো তো সমুদ্র এর অধিকার আদায় এর বিষয়টিকে একটি উপহাসের বিষয় বলে মনে করছেন ! এটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করছেন।

তাহলে বিষয়টি দাড়িয়েছে, একপক্ষ বিষয়টিকে সমুদ্র জয়ের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন অপর পক্ষ এটাকে কোন অর্জনই বলতে নারাজ বরং এটাকে পরাজয় হিসেবে তারা গন্য করছেন।

কিন্তু স্বল্প বোধজ্ঞান সম্পন্ন একজনও যদি রায়টি দেখে সেও বুঝতে পারবে এ রায়টি কোন জয় পরাজয়ের বিষয় নয়, সমুদ্রে দু দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত একটি ফয়সালা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাঁর কর্মকর্তা খুরশেদ আলমকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিরোধ মীমাংসায় অসামান্য আন্তরিকতা নিয়ে তৎপরতা চালিয়েছেন। নিঃ সন্দেহে বিষয়টি খাটো করে দেখার মতো নয়। এ রায়টি আইটিএলওএস এর ওয়েব সাইটেও দেয়া আছে। এমনিতেই ভৌগলিকভাবে আমাদের সমুদ্রসীমা খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নয়। দু পাশে দুটো বড় দেশ এবং তাদেরও রয়েছে সু-বিস্তৃত উপকূল। ১৯৮২ সালের ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দা ল অব দা সি সামুদ্রিক সংবিধান না হলে আমাদের বর্তমান প্রাপ্ত অধিকারও অনেকাংশে খর্ব হতো। এই রায় অনুসারে স্পষ্টতই উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবীর এক লাখ সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এর চেয়েও চার হাজার বর্গকিলোমিটার বেশি বাংলাদেশ পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ কিছু ব্লক পুরো বা বা আংশিক হারিয়েছে। কেন সেন্ট মার্টিনকে সর্বশেষ ধরা হলো না, কেন এতগুলো ব্লক হারালো এ ধুয়া তুলে এ অর্জনকে খাটো বা গুরুত্বহীন করার অপপ্রয়াস চালানোর চেষ্টা করছে কিছু মহল।

এখন অবস্থা এমন দাড়িয়েছে, একদল এটিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সুবিশাল করে ফেলার প্রয়াস চালাচ্ছে আর এক দল এটাকে বাংলাদেশের পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা নিচ্ছে। এর ফলে সাধারন জনগন পড়েছে বিপাকে। দু দলের এহেন কর্মকান্ডে প্রকৃত বিষয়টিকে জনগন সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি আর সমুদ্রজয়/পরাজয়— দুই জিনিস।

সমুদ্র সীমা নিয়ে যে ন্যায় ভিত্তিক আইনি অধিকারটি আমাদের অর্জিত হয়েছে, তাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এ নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। এ অর্জনটি কোন অর্জনই না বা এখানে আমাদের কোন স্বার্থ রক্ষিত হয়নি এটা বলা কোন ভাবেই যেমন জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবেনা ঠিক তেমনি এ ধরনের জাতীয় অর্জনকে দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দলের সফলতার গাঁথামালা হিসেবে প্রচার করার প্রচেষ্টাও হবে অনৈতিক । আশা থাকবে, আমাদের প্রাপ্তি যেন অতি বন্দনার উচ্ছ্বসিত তরঙ্গে নিষ্প্রভ না হয়ে যায়

SCROLL FOR NEXT