নাগরিক সংবাদ

মুক্তি হোক গৃহবন্দী শিশুদের। যারা চার দেওয়ালে মাঝে একান্ত অপারগ হয়েই কাটাচ্ছে শৈশব ভিডিও গেমস, টেলিভিশন অথবা কম্পিউটার নামক যন্ত্রটাকে সাথে করে।

Byসৈয়দ সাইফুল আলম

গোটা দুনিয়াই বদলে গেছে এবং যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বস্তুর প্রকৃতি ও জীবের জীবনধারা, এ বদলের কারণ পুঁজির বিকাশ , অসম পুঁজির গতিময়তা এবং দৌরাত্ম। পুঁজির প্রতিযোগিতা বাড়ছে, বাড়ছে পণ্য দস্যুতা । মানুষকে পণ্য বানাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ,সে সূত্রে বদলে যাচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো। পরিবর্তন ঘটছে নগরজীবনে, জীবনযাপনে। আরবান লিভিং কনসেপ্ট এর অন্তরালে আমরা অস্থির এবং অসুস্থ জীবনধারাকে আমরা বেছে নিচ্ছি। আমরা পৃথিবীতে থেকেও মাটি থেকে বিছিন্ন। আমরা মাটির গন্ধ পাই না, পাই না মাটির ছোঁয়া। পাশের ফ্ল্যাটের মানুষগুলোকে চিনি না, তারা যেন অন্য কোন গ্রহের। ক্রমেই আমরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছি ইট-রড-সিমেন্টের চার দেয়ালের স্কয়ারফিটের জীবন ধারার মাঝে। আজ পরিবার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আমি আর তুমিতে এসে দাঁড়িয়েছে। স্কয়ারফিটের জীবনই যেন আজকের নাগরিক বাস্তবতা।

গৃহবন্দী শিশুর জীবন
গৃহবন্দী শিশুর জীবন

"কি ছোঁবেন নাকি আকাশটাকে" শিরোনাম নিয়ে আমার সবাই আকাশ ছুঁতে ব্যস্ত। আমরা আকাশ ছুঁতে চাই। আকাশ ছোঁয়া এ সংস্কৃতির যুগে আমার একবারও লক্ষ্য করতে চাই না- আমি যে বাড়িটি করছি কিংবা কিনছি সে বাড়িটির পাশে কতটুকু জায়গা নির্ধারিত আছে জীবনধারণের অপরিহার্য গাছের জন্য। আমরা চাই নির্মল বাতাস। অথচ আমাদের আশেপাশের গড়ে উঠা এ আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিংগুলোর চারপাশে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই যেখানে নিম, হিজল, আম কিংবা একটা সরু সুপারি গাছ বেড়ে উঠবে। এখানেই আমরা একটি ফ্ল্যাট বা প্ল্লট কিনে আগামী প্রজন্মের জন্য নিশ্চিন্ত হচ্ছি। কিন্তু সে ফ্ল্যাট বা প্লট কী আমাদের কিংবা আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বসবাসের উপযোগী থাকবে?

প্রিয় ব্লগার, একজন শাওনের গল্প বলি।

তিন তলা বাড়ির দুই রুম। আশেপাশে বড় বড় বিল্ডিং সবারই প্রতিযোগিতা আকাশটাকে ছোঁবার। তার মাঝেও নগরী গোলাপবাগ এলাকার শিশু শাওন ভাগ্যবান। বিকেলে বাড়ী সামনে গোলাপবাগ মাঠে খেলে শাওন ও তার বন্ধুরা । স্কুলের অন্য বন্ধুদের অবসর যখন কাটে টিভি দেখে কিংবা মাসের দু একটা ছুটির দিনে হয়ত একটু সুযোগ মিলে মা-বাবার হাত ধরে কিছুক্ষনের জন্য খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ানোর। তখন বাড়ীর পাশের এই মাঠটির জন্য শাওন নিজ গর্ব বোধ করে। হাজারো গল্প এই মাঠ ঘিরে।

একদিন একদল লোক আসে নিমিষে দখল হয়ে যায় গোলাপবাগ মাঠ। ফ্লাইওভার হবে এই অজুহাতে নিমার্ণ সামগ্রী রেখে মাঠটি দখল হয়ে গেছে। এখন স্কুল থেকে ফিরে টিভি দেখে কিংবা জানালার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা ছাড়া অবসর কাটানোর মত কিছুই করার নেই। হাজার ক্লান্তি মাঝেও জানালার ফাঁকা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেই নিমিষেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। তবুও ভয় হয় একদিন হয়ত এই এক চিলতে আকাশ দেখার সুযোগটা গুড়িয়ে এখানেও গড়ে উঠবে কোম্পানীর হাইরাইজ বিল্ডিং।

কিন্তু ভেবে দেখুন আপনার আমার শৈশবের কথা। খেলার ছলে গ্রামের এ পাড়া থেকে ও পাড়া, কোথায় পড়েনি আমাদের পদচিহ্ন? অধুনিক নগরায়নের খেলার মাঠের স্বল্পতা, সময় সল্পতা, নিরাপত্তার অভাব, ব্যস্ততা প্রভৃতির কারণে শিশুদের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখছি। বন্দী শিশুরা অবসর কাটানোর জন্য বেছে নিয়েছে টিভি কিংবা কম্পিউটার যন্ত্রটাকে। এ কথা সত্যি শিশুর সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার বিকল্প নেই ।

bicycle training dhanmondi

সীমাবদ্ধতা আছে, আছে সাধ আর সামর্থ্যের মাঝে ব্যবধান কিন্তু হতাশ হলে চলবে না, কিছু একটা করতে হবে। আর কিছু একটা করার আগ্রহ নিয়ে ২০০৫ সালে ফ্ল্যাট বন্দী এই শিশুদের কৈশরকে একটু আনন্দময় তোলার লক্ষ্যে স্থানীয় অধিবাসীরা ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের সহায়তায় শিশুদের জন্য সপ্তাহে দুদিন আয়োজন করেছে বিনা খরচে সাইকেল প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। হাজার সীমাবদ্ধতার মাঝেও সপ্তাহের দু'দিন বৃহস্পতি ও শনিবার ধানমন্ডি ৪/এ সড়ক শুধু শিশুদের জন্য। বিকাল ৪টা থেকে ৬টা ধানমন্ডি ৪/এ সড়ক যেন এক শিশু রাজ্য। দুপুর তিনটার পর থেকে শিশুদের জমায়েত শুরু হয়। ঐ নিদিষ্ট সময় রাস্তায় কেউ জোরে গাড়ি চালায় না। পুরো রাস্তাটাই থাকে শিশুদের নিয়ন্ত্রণে। খুব প্রয়োজন না পড়লে কেউ তেমন একটা গাড়ি রাস্তায় বের করে না। ঐ দু'ঘন্টা সময়।

তামজিদ বার বার পড়ে যাচ্ছে তারপরও এক পা দু'পা করে এগিয়ে গিয়ে সাইকেলে উঠে। সাইকেলটাকে নিয়ন্ত্রনে আনার আবার প্রচেষ্টা। আজকের ভারসাম্যহীন এই সাইকেলটাকে হয়ত আগামীকালই সে নিয়ন্ত্রনে আনবে। জয় হবে তার প্রচেষ্টার, যা তার আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। তামজিদের মত অনেক শিশুই সাপ্তাহিক বিনোদনের একটি বিশেষ অংশে পরিণত হয়েছে এই সাইকেল প্রশিক্ষণ।

শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও তাদের সাথে সময় কাটান। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাইকেল প্রশিক্ষণ হয়ে উঠেছে অভিভাবক-শিশুদের মিলনমেলায়। ঢাকা শহরে একই বিল্ডিং-এ থেকেও পাশের ফ্ল্যাটের মানুষরাই থাকে অচেনা। কিন্তু ধানমণ্ডি ৪/এ এলাকার পরিবেশ ব্যতিক্রম। এখানকার বেশিভাগ শিশুই তাদের পাশের ফ্ল্যাটই নয় আশেপাশে অন্য বিল্ডিংয়ের শিশুদেরও চিনে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিশুরা পরষ্পরের মধ্যে সহজে গড়ে নিয়েছে স্বভাবজাত বন্ধুত্বের সর্ম্পক।

আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ছেলেমেয়ে নিয়ে ধানমণ্ডি লেক ঘেঁষা এই শিশু রাজ্যে। আপনার শিশুর সাইকেল চালানোর শেখার প্রচেষ্টা আপনাকে মুগ্ধ করবে। হয়তবা আবারও ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আপনার সেই র্দুদান্ত শৈশবের স্মৃতিরগুলোর কাছে ।

জয় হোক তাদের, যারা এই অপরিকল্পিত নগরে নিজেদের প্রচেষ্টায় শিশুদের বিনোদনের জন্য বিকল্প আয়োজন নিয়েছেন। মুক্তি হোক গৃহবন্দী শিশুদের যারা চার দেওয়ালে মাঝে একান্ত অপারগ হয়েই কাটাচ্ছে শৈশব।

আমাদের স্বপ্ন হোক কদম, হিজল কিংবা কোন বুনো ফুলের গন্ধে আবারও সুবাসিত হবে ঢাকার বাতাস। আকাশ ছোঁয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়, স্বপ্ন হোক একটা ঘুঘু বাসা বুনতে খড় কুটা সংগ্রহে ব্যস্ত হবে, এই নগরীর অফিস পাড়া ব্যস্ত মতিঝিলে। আবারও মুখরিত হবে ঢাকার আকাশ হাজারো নাম জানা-অজানা পাখির কলতানে। ইট, সিমেন্টের শহরে রোবটের মত নয়, আমরা চাই চারপাশের সবুজ বৃক্ষরাজি নিয়ে প্রকৃতির বুকে আমাদের নব প্রজন্ম বেড়ে উঠবে।

————————————————-
Syed Saiful Alam
shovan1209(at)yahoo.com

SCROLL FOR NEXT