ভাস্কর্য হল প্রাচীনতম শিল্প। হাজার হাজার বছর পূর্বের ভাস্কর্য আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখতে পাই। তেমনি একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকায় সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনের চত্বরে, (গ্রীক থেমিসের প্রতীকি)। ভাস্কর্যটি নির্মাণ করছেন ভাস্কর মৃণাল হক।
ভাস্কর্যটিতে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করা হয়েছে ন্যায়বিচারের সূচক হিসেবে। দণ্ড বা শাস্তির সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তলোয়ার। আর চোখ বাঁধা রাখা হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে। রোমান আইন থেকেই আমাদের বিচারের বিষয়ের উৎপত্তি। সেজন্যই অন্যান্য দেশের মতো এই ভাস্কর্য করা হয়েছে।
অনেকে ভাস্কর্য আর মূর্তিকে গুলিয়ে ফেলে। মূর্তি বা প্রতিমা তৈরী করা হয় ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে,পূজা করা হয় মূর্তি বা প্রতিমাকে। আর ভাস্কর্য হল শিল্প যা খোদাই করে করা হয়।
আভিধানিক অর্থে, ভাস্কর্য অর্থ Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরী করা হয়, তাকে ভাস্কর্য বলা হয়। যেমন বলা হয় 'ভাস্কর্য বিদ্যা' এর অর্থ হল, The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন, আছে অক্সফোর্ড অভিধানে- One who carves images or figures. অর্থ্যাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরী করে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, সুপ্রিম কোর্টের তিন শতাধিক আইনজীবী স্থাপিত ভাস্কর্যটি অপসারণ চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তারও আগে হেফাজত এই দাবি করে আসছে এবং ভবিষ্যতে অনেকে করবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। তারা দাবি করছেন এই ভাস্কর্য স্থাপন করে ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত করা হয়েছে। কিভাবে? এটি তো ন্যায়ের প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, এতেই তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগল? ভণ্ড পীরেরা ওয়াজ করে ধর্মটাকে টুপির ভিতর ভরে টাকা তুলে নিজের পকেটে ঢোকায় তখন কোথায় থাকে অনুভূতি?
একটা মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশ যখন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হয় কোথায় থাকে তখন ধর্ম? মুসলিম দেশ হিসাবে, মুসলমান হিসাবে তো এটা লজ্জার। ঘুষ খাওয়া চলছে, পরের বাড়ি জায়গা দখল চলছে জোর করে, ভিড় বাসে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া চলছে, ঘরে বউ পেটানো চলছে, সুদ খাওয়া চলছে, মিথ্যার ফুলঝুরি বানিয়ে ধর্ম ব্যবসা হচ্ছে, একটা মামলায় (যেটা ছয় মাসে শেষ হয় ) দিনের পর দিন ক্লাইণ্টকে ঘুরানো হচ্ছে, তখন অনুভূতিতে লাগে না, তখন ধর্মের কথা মনে থাকে না । আর একটা ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে তাতেই এদের অনুভূতি ডুবে গেল। ঈমান এত দুর্বল কেন? একটা ভাস্কর্যই ঈমান নাড়িয়ে দেয়? অথচ সৌদি আরবের ৮৬তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশটির বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি উন্মোচন করা হয়েছে গত বছর । কই তারা তো অনুভূতি নিয়ে নাচে নাই? সৌদি তো মুসলিম কান্ট্রি এবং সেখানে শরিয়া আইন ।
সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি।বাদশা সালমানের এই প্রতিকৃতিটি তৈরি করেছেন সৌদি চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ আসিরি। ২১৬ বর্গমিটার উচ্চতার এই প্রতিকৃতিটি সম্পন্ন করতে তিনি ৪০ দিন সময় নেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি হিসেবে সালমানের ছবিটিকে স্বীকৃতি দিতে এরইমধ্যে গিনেজবুক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে সৌদি শিক্ষা বিভাগ। সৌদিবাসীর অনুভূতি নাই? আছে । আসলে তারা জানে এটা একটা ভাস্কর্য, একটা শিল্প। এটা নিয়ে নাচানাচির কিছু নাই।
স্ট্যাচু অব সালাদিন দামাস্কাস, সিরিয়াচাইলে এরকম বিভিন্ন দেশের বহু ভাস্কর্যের উদাহরণ টানা যায়। শুধু কি ভাস্কর্য! ধর্মীয় অনুভূতি ওয়ালাদের কত কিছুতেই সমস্যা, ভাস্কর্যে সমস্যা, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়ে সমস্যা, মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে সমস্যা- চার ক্লাসের উপরে মেয়েদের পড়ার দরকার নাই। কত কত কি!
আসলে এরাই দেশের সমস্যা। সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে না তারা ধর্ম পালন করে। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিথার্থ করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে মাদ্রাসার অবুঝ, এতিম ছাত্রদের ব্যবহার করে যখন সরকারের কাছ থেকে জমি নেয়া হয় তখন এদের ধর্মীয় অনুভূতি ঘুমায় । এরাই ধর্মের বড় শত্রু। সাধারণ জনগণ নয়।
পরিশেষে বলব, ভাস্কর্য ছিল, আছে, থাকবে। সরকারের কাছে দাবি জানাই এই ভাস্কর্য ন্যায়ের প্রতীক, এই ন্যায়ের প্রতীক সরানোর কোন যৌক্তিকতা দেখি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য শিল্প সভ্যতার প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
নিউজার্সি ,যুক্তরাষ্ট্র থেকে।