নাগরিক সংবাদ

বৈদেশের জীবন যাপন- ৫

Byসুকান্ত কুমার সাহা

একটা কর্পোরেট ট্রেনিং-এ টপিক ছিল, "কিভাবে আপনি বিদেশের মাল্টিকালচার পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিবেন? পাশাপাশি সেই অঞ্চলের মানব সম্পদকে একটা 'টিম বিল্ডিং'-এর মাধ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পূরণ করবেন?"

ট্রেনিং- এর শুরুতেই আমাদের হেড অব এইচ আর তার মুখবন্ধ বক্তৃতায় পুড়ো টপিকের উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতার সামারি বর্ণনা করে আমাদের সামনে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, "কিভাবে অল্প সময়ের মধ্যে আপনি আপনার সামনে যে বাঁধাগুলো আছে- যেমন ভাষার, কালচারের, ধর্মের, জেন্ডারের- তা অতিক্রম করে নিজেকে একজন সফল ম্যানেজার হিসেবে তুলে ধরবেন?

প্রথমেই ফ্লোর নিয়ে বললাম, স্যার! শুধুমাত্র বিনয় দিয়েই এই সমস্যার ৯০% ভাগ সমাধান করা যাবে। বাকী ১০% নির্ভর করবে আমার শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার উপর! স্যার বললেন, ব্যাখ্যা করেন? বললাম, স্যার! জাপানীরা তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে নিজভাষা ছাড়া অন্যকোন ভাষা শেখেনি অথচ তারাই জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পৃথিবীতে সেরা। এটা হয়েছে একমাত্র তাদের বিনয়ের কারণে। তিনি আমার সাথে একমত হলেন।

আমরা জানি- মাহাথির মোহাম্মদ একটা অনুন্নত মালয় জাতিকে নিজ বুদ্ধি ও নেতৃত্বের গুণে একটা উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে এসেছেন। তিনি তার উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রথমেই যেটা করেছেন সেটা হলো- মালয়েশিয়াতে একটা মাল্টিকালচার সমাজব্যবস্থা গড়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি এতে যেন দুষ্ট মানুষেরা ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে, তার একটা সুষম আইনি কাঠামোও গড়ে তুলেছেন! যার ফলে প্রতিটা মানুষই এখানে তার নিজ নিজ বিশ্বাস ও অভ্যাস অনুযায়ী চলতে পারছে। এখানে যেমন মালয় জাতি ভূমিপুত্র হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তেমনি ব্যবসা বাণিজ্যসহ সকলক্ষেত্রেই সমান সুযোগ পাচ্ছে চাইনিজ ও তামিল জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি এই জাতির মধ্যে ঢুঁকে পড়েছে, ইন্দোনেশিয়ান, রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশীরাও। এখানে 'ইসলাম' প্রধান ধর্ম হলেও অন্য সকল ধর্মের মানুষের যেমন চাইনিজ আদর্শ, হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের জনগোষ্ঠীর জন্য একই সুযোগ বিদ্যমান আছে। ধর্মীয় উৎসব যেমন- হারি রায়া/ঈদ, থাইপুসাম, দীপাবলিক্রিসমাস– এখানে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে পালিত হয়। তবে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো চাইনিজ নববর্ষ। এদেশে সবচেয়ে বড় ছুটি হয় এই নববর্ষেই।

পেশাসূত্রে ইদানীং আমাকে ঘনঘন মালয়েশিয়াতে আসতে হচ্ছে, কারণ এই অঞ্চলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ডেভেলপ করার দায়িত্ব পড়েছে আমার একাউন্টে। পাশাপাশি এখানে একটা টীম তৈরিও করতে হবে যাতে করে আমার অবর্তমানেও ব্যবসা চলতে পারে। টিম বিল্ডিংটা এই কারণে দরকার যাতে ডেভেলপটা দ্রুত হয় এবং ক্রমাগত উন্নয়নের মধ্যে থাকে। এখানে বলে রাখি- মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ট্যুরিজম, খনিজ ও পাল্ম তেল নির্ভর হলেও মূল অর্থনীতিটা আছে চাইনিজ ব্যবসায়ীদের হাতে। আর খুচরো বাজারটা আছে বড় বড় হাইপার মার্কেট যেমন, GIANT, MYDIN, AEON BIG, TESCO সহ ছোট-বড় রিটেইল চেইন শপের দখলে।

এখানে আমাদের প্রতিষ্ঠানের অন্য ব্যবসা আছে। পাশাপাশি আমি যে ব্যবসা গড়তে এখানে এসেছি তার জন্য আমাদের এখানকার ম্যানেজমেন্ট প্রথমে মিস নোরাকে রিক্রুট করেছিল আমাকে সাহায্য করার জন্য। আবার আমার দায়িত্ব ছিল ওকে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া। সে চটপটে হওয়ায় অতিদ্রুত সবকিছু বুঝে নিয়েছিল কিন্তু কিছুদিন পরই সে চাকুরী ছেড়ে দিলে আমাদের আবারও নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এখন মিস মেই কাজ করছে। কিন্তু সেও চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে। আবার আমাদের নতুন কাউকে খুঁজতে হবে। উপরে বর্ণিত আমাদের ট্রেনিং-এর উদ্দ্যেশ্যই ছিল এই বিহেবিয়ারকে এডোব করেই এগিয়ে যাওয়া। তারই ধারাবাহিকতায় আমি মিজ নোরাকে নক করেছিলাম এবং সে উত্তরে জানিয়েছে, সে ভাল আছে এবং নতুন একটা জবে ঢুকেছে।

আমরা ইচ্ছে করলেই এই পজিশনে একটা বাঙ্গালী ছেলেকে নিয়োগ দিতে পারি কিন্তু সমস্যা হলো- সে হয়ত অনেকদিন থাকবে কিন্তু সে আমাদের ব্যবসার সম্প্রসারণের যে লক্ষ্য স্থির করা আছে তা পূরণে এই মুহূর্তে সক্ষম হবে না। কারণ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সে এপোয়েন্টমেন্টই পাবে না। হ্যাঁ, ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে সে তা ফলোআপ করে বাড়িয়ে নিতে পারবে।

কিন্তু আমি এখানে এসে তো বসে থাকতে পারি না। তাই নিজ উদ্দ্যোগে নেমে পড়েছি, দেখি না কী হয়? এই মানসিকতা নিয়ে। পাশপাশি অনেকগুলো লক্ষ্য নিয়ে এবার এলেও আমি তা কমিয়ে – যেখানে অল্পতে বেশী আউটপুট পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে, সেই অংশতে কাজ করছি এবং ইতিমধ্যেই ভাল ফল পেয়েছি। অর্থাৎ আমি আগের ডেভেলপ করা কন্ট্যাক্টগুলোকেই ম্যাচুউর করার চেষ্টা করছি। রোমান্টিকের একটুখানি গুঁড় লাগিয়ে যদি বলি- তাহলে বলতে হয়, আগে যাদের সাথে প্রেম করে গিয়েছিলাম, এ যাত্রায় তাদের বিয়ে করে ঘরে তোলার চেষ্টা করছি!

ড্রাইভিং না জানাটা হচ্ছে আমার একটা দুর্বলতা। এদেশে শুধু নয়, বাংলাদেশ বাদে পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই কাজ করতে হলে ড্রাইভিং জানা চাইই! আমার বস এই বিষয়টাতে আমাকে ব্যাপক চাপে রেখেছেন কিন্তু ঢাকাতে যে এটা শিখবো সেই সময়ই পাচ্ছি না। এতদিন নোরা অথবা মেই ড্রাইভিং করত আর আমি ওদের পাশে বসে থেকে আরামছে কাজ সারতাম কিন্তু এবার আমি ফাঁদে পড়েছি। এবিষয়ে নোরা আমাকে প্রায়ই বলত, স্যার এটা খুবই লজ্জার যে, আমি ড্রাইভ করি আর তুমি আরাম করে বসে থাকো! কাল থেকে তুমি ড্রাইভ করবে আর আমি বসে থাকবো। স্যোসাল গাইড লাইন কী বলে জানো? অনার ইউর ইউম্যান ফার্স্ট! আমিও বলতাম, তাহলে আগামীকাল আমরা একলগে ফ্লাইওভার থেকে জাম্প করুমণে! বাসা থেকে বিদায় নিয়ে এসো।

অনেক আগে একটা লেখা লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল- "সমস্যা যেখানে গুরু, সমাধান সেখান থেকেই শুরু"! হ্যাঁ, গাড়ী চালানো না জানার কারণে আমি যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম তা থেকে আমাকে এবার বের করে এনেছে GRAB TAXI সার্ভিস। আমার প্রায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন আমি পুরোদমে কর্মক্ষম। স্মার্টফোন নির্ভর এই সার্ভিস এত নির্ভরযোগ্য ও ইকোনোমি যে আমি অল্প কয়দিনেই এর প্রেমে পড়ে গেছি। ইতিমধ্যেই কয়েকজন শৌখিন ড্রাইভারের ফোন নম্বরও পেয়েছি। একজন তো ছিল রীতিমত এদেশের পুরস্কার জেতা 'কার রেসার'? অল্পতেই তামিল ছেলেটিকে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় ওকে আমার ফেসবুকের বন্ধুও বানিয়ে ফেলেছি।

বিষয়টা এমন কিছুই না? আমার এক কলিগ জাস্ট ফোনে এই APP টা নামিয়ে দিয়ে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে আমি এর মাস্টার। ইতিমধ্যেই আমি UBER –এর APP টাও নামিয়ে ফেলেছি। এখন বাকী আছে WAZE অর্থাৎ জিপিএস। আমাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না! ট্রেন ও মেট্রো সার্ভিসটাও আগেই আয়ত্তে এনে ফেলেছিলাম!

আর বাকী অবশিষ্ট পথটা হাঁটার কষ্টটুকু তোমাকে মেনে নিতেই হবে সুকান্ত!

চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়ে, দই দেখে ডর পেলে তো হবে না!

ওজন কমাও কাজে লাগবে! হাঁটো!

হাঁট!

চলবে >>>

বৈদেশের জীবন যাপন-৩

SCROLL FOR NEXT