নাগরিক সংবাদ

অনিরুদ্ধকে খোলা চিঠি

Byমোঃ গালিব মেহেদী খান

প্রিয় অনিরুদ্ধ,

আজ যখন এই চিঠিটা লিখছি তখন তুমি ক্ষোভে দুঃখে জ্বলছ। তোমার চোখের অবিরাম জলের ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস, আস্থা আর স্বপ্ন। যে স্বপ্ন আমরা জন্মান্তর ধরে দেখে এসেছি।
অনিরুদ্ধ তুমি শুধু তো আমার বন্ধু নও তুমি আমার ভাই। আমরা একসাথে হাটি একসাথে স্বপ্ন দেখি। আমরা একই সাথে এগিয়ে যাই। তোমার পূজা পার্বণ, আমার ঈদ আমরা একত্রেই উদযাপন করে আসছি সেই কতকাল ধরে।

আমরা যখন এক সাথে ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা মেরেছি কিংবা আজিজ মিয়ার টং দোকানে বসে চা খেয়েছি তখন কে অনিরুদ্ধ আর কে মেহেদী এটা বোঝার সাধ্য ছিল না কারোরই। এমনকি আমাদের ধর্মীয় উৎসব উদযাপনেও কে কোন ধর্মাবলম্বীর সেটা বোঝার ক্ষমতা হত না কারোরই। টিএসসির আড্ডা আর রমনার পহেলা বৈশাখ আমাদের একাকার করে দিয়েছিল। আজো কি আমরা আলাদা হতে পেরেছি?
আজ যখন তোমার প্রাণের মন্দির পোড়ে আজ যখন তোমার বাড়ির টিনের বেড়া ফালি ফালি করে কেটে ফেলা হয় তখন তোমার চোখের জল আমাকেও একই ভাবে সিক্ত করে। তবে পার্থক্যটা কি জান? তুমি হারানোর যন্ত্রণায় কাঁদ আর আমি লজ্জায়। এ লজ্জা শুধু আমার নয়, এ লজ্জা সমগ্র বাঙালির।

অনিরুদ্ধ আজ তুমি আমি একটি জায়গায় কিন্তু একই বিরহ ব্যথায় কাতর আর তা হল আমরা আমাদের পরিচিতি হারিয়ে ফেলছি। আমরা আর বাঙ্গালী হয়ে থাকতে পারছি না। আমাদেরকে ক্রমশ আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। আমরা নিজেদের এক সুতোয় আর বেধে রাখতে পারছি না।

হ্যাঁ, যারা করছে তাঁরা আমারই জাতি। আমি মুসলিম তারাও মুসলিম পরিবারের সন্তান। আমরা তো আগেও মুসলিমই ছিলাম তারপরেও তো তুমি আমি এক পরিচয় নিয়েই বেড়ে উঠেছি। আমরা কতদিন এক পাতে খেয়েছি। খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছি আমাদের জাত যায়নি। তোমার মাকে আমি কখনো মাসিমা বলে ডাকি নি, মা বলেই ডেকেছি। তুমিও আমার মা'কে মা বলেই ডাকতে। তোমার আমার মায়েরা আমাদের উভয়কেই কত শাসন করেছেন। আর আমরা তা মাথা মেতে নিয়েছি হাসিমুখে।
মা বল, বাবা বল কিংবা বন্ধু জাত পাতের দোহাই দিয়ে আমরা তো আলাদা করে দেখতে শিখিনি। অথচ দেখ আজ সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। আজ একজনকে প্রশ্ন করতে দেখলাম হিন্দুর রক্ত গ্রহণ করলে কি পাপ হবে? অথচ তোমার দেয়া রক্তে আমার ভাই বেঁচে গিয়েছিল। সে কি তবে বেঁচে থেকে পাপ করেছে, নাকি তুমি তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে পাপ করেছ? ভাবা যায় মানুষ কতটা হীনমন্যতায় ভুগলে পরে এমন ভাবতে পারে? এই প্রজন্মটাকেই এম করে গড়ে তোলা হয়েছে। এরা শুধু ঘৃণা করতে শিখেছে। এরা ভালবাসতে শেখে নি। তুমি মনে কর না এরা ধার্মিক। ব্যক্তি জীবনে এদের ধর্ম চর্চার খোঁজ নিলে তোমাকে হতাশ হতে হবে। এরা ধর্মকে আচার নয় উৎসব হিসেবে দেখে। এরা সারা জীবন অধর্ম করে শর্টকাট বেহেশত খুঁজে বেড়ায়। ফলে খুব সহজেই তাদের বিভ্রান্ত করা যায়।

আজ আমাদেরই সরকারের বাহাদুরের এক মন্ত্রী মহাশয় বলে বসলেন, 'মালাউন'। আসলেই তো একদল 'মালাউন' আমাদের মাঝে বাস করছে। সে মালাউন তো তাঁরা যারা প্রকৃতপক্ষেই এ জাঁতীর জন্য অভিশাপ। 'মালাউন' শব্দটা মন্ত্রী মহাশয় তোমাদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন ঠিকই কিন্তু তুমি আমি আমরা তো জানি প্রকৃত 'মালাউন' কারা।

অনিরুদ্ধ হিন্দু বল আর মুসলিম বল একটি গোষ্ঠী অনেক দিন ধরেই আমাদের মাঝে বেড়ে উঠেছে তারা আসলে মানবতার শত্রু। তাঁরা ধর্মের নামে মানবতাকে কুলষিত করছে। না তোমার, না আমার কারো ধর্মই মানবতাকে পিষে মারতে শেখায় নি। ধর্ম মানুষকে পরিশীলিত হতে শিখিয়েছে। ধর্ম ভালবাসতে শিখিয়েছে। ধর্ম মনুষ্যত্ব শেখায়। যারা ধর্মের নামে মানবতাকে পিষে মারে তাঁরা শুধু মানবতার শত্রু নয়, ধর্মেরও শত্রু।

আমার এই চিঠি তোমাকে শুধু নয় এ দেশের নির্যাতিত সকল ধর্মের মানুষের জন্য। এ আমার কোন আত্মপক্ষ সমর্থনের বয়ানও নয়। এ শুধু একটি বার্তা দিতেই লেখা আর তা হল, ষড়যন্ত্রটা শুধু তোমাদের বিরুদ্ধে নয় বন্ধু, ষড়যন্ত্রটা বাঙালিয়ানার বিরুদ্ধে। যা চলে আসছিল সেই দেশ ভাগের সময় থেকে। আজো চলছে হয়ত আগামীতেও চলবে।

আমি জানি আজ তুমি আমার বা আমাদের উপরে যতই ক্ষুব্ধ হও কাল যদি জানতে পার আমি আক্রান্ত। সব ক্ষোভ ভুলে তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। সেই ভরসাতেই বলছি, বন্ধু ভুল বুঝ না।
আমি তোমার সেই আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু হয়েই তোমার এবং তোমাদের পাশে আছি। তোমাদের পাশে আমরা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন শান্তিপ্রিয় প্রত্যেকেই আছি এবং থাকব।

এ অন্ধকার থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতেই হবে। আর তা এক সাথে এক হয়ে। আমাদের এটাই মাথায় রাখা উচিৎ বাংলাদেশ রচিত হয়েছিল বাঙ্গালিয়ানাকে ধরে রাখতে। আমরা তা ধরে রাখবই, সব কিছুর পরেও আমরা বাঙালি হয়েই বেঁচে থাকব। প্রিয় এই স্বদেশ তোমার আমার আমাদের সবার।

ইতি
মেহেদী।
৫.১১, ২০১৬

SCROLL FOR NEXT