নাগরিক সংবাদ

শুভ বিজয়াঃ উৎসবের আনন্দমঠ হোক সবার সমান তীর্থ!

Byফারদিন ফেরদৌস

শুভ বিজয়া!

সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই, বন্ধু, সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী, শিক্ষক, চিকিৎসক, মিষ্টিওয়ালা, দইওয়ালা, গ্রামের প্রান্তিক মানুষটি যিনি তিল তিল করে শ্রম ও ঘামে শস্যকণা উৎপাদন করে সবার মুখে অন্ন যোগান এবং অন্যান্য পেশাজীবী সবার জন্য অশেষ শুভ কামনা। ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক হৃদ্যতায় জয় হোক মানুষের। এগিয়ে থাকুক বাংলাদেশ!


…………
আমার স্বজাতি এক নন প্র‍্যাকটিসিং মুসলিম বন্ধুর ধারণা ঘুষ, দুর্নীতি, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, অন্যের কুৎসা রটনা, পরের ধন কেড়ে নিয়ে পোদ্দারি করা, পরশ্রীকাতরতা, কাজে ফাঁকি দেওয়া, অন্যকে ঠকিয়ে নিজের পকেট ভারি করায় ঈমান বা বিশ্বাস নষ্ট হয় না। কিন্তু তিল পরিমাণ ঈমানও অবশিষ্ট থাকে না যদি আপনি মুসলিম হয়ে হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন।
অথচ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই ভূমিতে হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি নিয়ে কী দারুণ পঙক্তিমালাই না সাজিয়েছিলেন:
মোরা এক বৃন্তে দু'টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ!

জাতীয় কবি'র এই সার্থক কবিতার মতো করেই হাজার বছর ধরে আমাদের এই বঙ্গভূমিতে বিশ্বের চারটি বড় ধর্মের মানুষ বাস করে আসছে। তারা ধর্ম যার যার মতো করে পালন করলেও উৎসবের রঙটা একে অপরের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে খুব ভালোভাবেই। সেই উৎসবের আলোয় আমরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবাই হাত ধরাধরি করে চলছি একসাথে। কোনো অশুভ শক্তিই এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
যার যার ধর্ম নিয়ে কোনো কথা হবে না। ঈশ্বরের আরাধনা যার যার একান্তের, নীরবের, নিভৃতের। কিন্তু উৎসবের আনন্দমঠ হোক মহানুভব ও অসাম্প্রদায়িক সকল মানুষের সমান তীর্থ।

আমার যে বোসম ফ্রেন্ডের কথা বলছিলাম, পেশায় তিনি একজন কলেজ শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়ান। বিজ্ঞান কি মানুষকে গোঁড়া, মৌলবাদী বা উগ্রবাদী হিংসুক বানায়? তবে তো তার উচিৎ হবে জালাল উদ্দিন রুমি, কাহলিল জিবরান, কাজী নজরুল ইসলাম, হোমার, শেক্সপিয়র, লিও তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলীতে চোখ বুলানো। তবু যদি বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি তার প্রেম জাগ্রত হয়। ছাড়া ছাড়া দু'ছত্র ধর্মপুস্তিকা পড়লে মিলিট্যান্ট হওয়া যায়, সাধু হওয়া কোনোদিনই সাজবে না বন্ধুগণ।

অল্পবিদ্যা নিয়ে আসলে এই কথা অনুধাবন করা যাবে না যে, পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম বা নীতিশাস্ত্রেই শান্তির কথা বলা আছে। আব্রাহামিক ধর্ম ইসলামের 'শয়তান', খৃস্টীয় 'দিয়াবল' আর হিন্দু পুরাণের অসুর বা মহিষাসুর এই তিনটি পৌরাণিক চরিত্রেরই এক নিগুঢ় সাযুজ্য রয়েছে। তিনজনই কঠোর নিয়মনিষ্ঠ আরাধনায় পরম ঈশ্বরের মন পেতে চেয়েছিলেন। তবে ঘটনাচক্রে তিনজনই প্রভুদ্রোহী হয়ে উঠলে নানা বাহানায় নিজেদের অমরত্বের দাবি আদায় করে নেয়। আর পৃথিবীতে শুভ বা অশুভবোধের ভেদাভেদ জিইয়ে রাখে।

ইবলিশ বা দিয়াবল অমর অক্ষয় থাকলেও অসুরকে বদ করতে পেরেছিলেন এক মহামায়া নারী। তিনি আর কেউ নন দুর্গা। পুরুষ মানুষ বাস্তবে না মানলেও পুরাণে এভাবেই নারীকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। মাকে দেয়া হয়েছে বহুমাত্রিক রূপ।

অন্যদিকে বুদ্ধদর্শনের প্রধান অংশ হচ্ছে দুঃখের কারণ ও তা নিরসনের উপায়। বাসনা হল সর্ব দুঃখের মূল। বৌদ্ধমতে সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য- এটাকে নির্বাণ বলা হয়। নির্বাণ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিভে যাওয়া (দীপনির্বাণ, নির্বাণোন্মুখ প্রদীপ), বিলুপ্তি, বিলয়, অবসান। কিন্তু বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল সকল প্রকার দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ। বৌদ্ধ অষ্টবিধ উপায়ের মাধ্যমে মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।

মুসলিম ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রথম সুরা ফাতেহার ৫ নাম্বার আয়াতটি হলোঃ ইহদিনাছ ছিরাতাল মুস্তাকিম। অর্থাৎ আমাদেরকে সরল পথ দেখাও বা Guide us to the Straight Way.

এই যে সর্বময় শক্তি হলো মা অথবা নারী, বাসনা হলো সব দুঃখের মূল এবং মানুষকে কামনা করতে হবে সরল পথ বা মধ্যপন্থা। এমনসব ধর্মীয় মর্মবাণীর মাঝে ঘৃণা, হিংসা, বিবাদ বা কাউকে ক্ষুদ্র করে দেখবার কিছু আছে কি? এক কথায় নেই।

ইসলামের মহানবীর সাম্যবাদ ও উদারতার গহিনে ডুব না দিয়ে 'বিশ্বাস' নিয়ে যেই শিক্ষকরা কথা বলেন, তাদের শিক্ষার্থীরা কোন মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠে!

আমাদের এই বাংলাদেশে ঈদের জামাতে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন হিন্দুরা, পূজার সংগঠক হয় মুসলমানরা। এই সম্প্রীতি ও বন্ধন অটুট রেখেই দেশ এগিয়ে চলছে কাঙ্ক্ষিত চূড়ায়।

শেষে আমার এই টাইপড বন্ধুদের জন্য আজকের বিজয়ার দিনে কামিনী রায়ে'র অমৃত কথাগুলো তোলা থাকল!
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১১ অক্টোবর ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous

SCROLL FOR NEXT