নাগরিক সংবাদ

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই

Byফারদিন ফেরদৌস

শিশুর গালের মতো লাল রোদের নরম রঙ নিয়ে নিত্যদিন চারিদিকে সকাল হয়, সেই ভোরের রোদ যখন ধানের ওপরে মাথা পেতে শোয়, মাঠের ঘাসের পরে যখন শৈশবের ঘ্রাণ মিলে তখন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ 'অবসরের গান' শিরোনামে কাব্য করেন। পাড়া গাঁ'র এমন উৎসবের আহবানে কবি কি সাড়া না নিয়ে পারেন? আর নিজের ঠিকানা ছেড়ে দূরে কোনো এক নিভৃত গ্রামের সবুজ শ্যামলিমায় ফিরে গিয়ে কর্ম কোলাহলমুখর এই জগৎ সংসারের একগুয়েমি ভুলে কবি'র সেই অবসরের গান শুনবার সাধ কার না জাগে?

হাজার বছর ধরে সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগর ঘুরে পৃথিবীর পথে হাঁটতে হাঁটতে মানুষের ক্লান্ত প্রাণ দু'দন্ড শান্তি খোঁজে কোনো এক নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। কিন্তু বনলতা সেনের কাছে পৌছবার ফুরসৎ মেলে কখন কয়জনার? ছুটিটা যে ভীষণ করে চাই, অবসরের দেখা যেন মাঝে মাঝি পাই। কিন্তু কে দেয় ভরসা, কে দেয় ছুটি? তবে কাজপাগল এই মানুষের দেশে এবার ঈদের কথা একদমই আলাদা। এবারের ছুটির ঘন্টা একটানা নয় দিনের! আহা, কী আনন্দধারা বহিছে ভুবনে!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে এবার টানা নয়দিন ছুটি কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেশের প্রধান নির্বাহি বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তিনি এক দিনের ছুটি এদিক সেদিক করে দিয়েছেন, ফলে এবারের ঈদের ছুটি সরকারি কর্মীরা পাবেন টানা নয় দিন। ৪ জুলাইয়ের কাজের দিনটাকে সরকার ঘোষণা করেছে ছুটির দিন হিসেবে, আর ১৬ জুলাই শনিবারের ছুটির দিনটাকে ঘোষণা করা হয়েছে কর্মদিবস বলে। উন্নত বিশ্বে এমনটা হরহামেশাই করা হয়। জাপানে অবকাশ ছুটি কাটাতে রীতিমতো বাধ্য করা হয়। আমরা এই পথে নতুন, তাই প্রগলভতা একটু বেশি। দেখতে হবেতো আমরাও কিন্তু উন্নত হচ্ছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদেরকে মাঝে মাঝেই দেখা যায় পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো নির্জন দ্বীপ বা ফার্ম হাউজে অবকাশ কাটাতে। আমাদের এখানে অবশ্য এমন চল এখনও গড়ে উঠেনি। তবে ৯ দিনের ছুটি দিয়ে যাত্রাটা শুরু করা গেল। এরপর নিশ্চয় আমাদের রাজা বাদশাহরাও ছুটি আর কর্মদিবস এদিক সেদিক করে আনন্দ অবকাশযাপনে চলে যাবেন। তারপর ফিরে এসে নতুন উদ্যমে আমাদেরকে শাসন করবেন।

৯ দিনের লম্বা ছুটি হলো, এবার তবে মন খারাপের মেঘের কোলে রোদ হাসুক। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি বলে হর্ষ ও উচ্ছ্বাসের আহাহাহাহারা আনন্দের বাণ ডাকুক ।

এতোদিনকার অভ্যাস ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় বলে পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি ঠাওরে কবিতার স্নিগ্ধতাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে কাব্যকলাকে ছুটি দিয়ে রেখেছেন সেই কবে কালে। এবার ৯ দিনের ছুটির হৈহল্লায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'হে মহাজীবন'র অমর পঙক্তিমালাকেই বরং উলটে দিয়ে ক্ষুধার রাজ্যকে বাই বাই বলে দিন না। কবিতার স্নিগ্ধতায় মাতুন, হাসুন, উল্লাস করুন, আনন্দে নেচে উঠুন। আপনি হাসলেই না তবে হাসবে বাংলাদেশ।

আপনাদের মনে থাকবার কথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর ভাগ্নে ফটিককে মামীর অনাদরে বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে ফিরবার আগে স্কুল বা সময়ের কাছ থেকে ছুটি মেলেনি। ফলে চিরস্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যাওয়ার জন্য চিরকালীন ছুটি পেয়ে যায় সে। কিন্তু যথাসময়ে সাধের ছুটি মিললে হয়ত মায়ের সন্তান মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারত। তাহলে অবশ্য গল্পের ট্রাজেডি হতো না। তবুও পথ হারিয়ে কোনো বনে যাওয়ার জন্য, কোনো মাঠে ছুটে বেড়ানোর জন্য ছুটি যে খুব দরকার গুরুদেব এভাবেই আমাদেরকে তা শিখিয়েছেন।
কে না জানে ছোট শিশুদের পাঠশালার বন্দি জীবন ভালো লাগে না। সে চায় অবাধ স্বাধীনতা, খোলামেলা বন্ধনহীন জীবন- সেখানে থাকবে না কোন বাঁধা নিষেধ, সেখানে থাকবে শুধু উন্মুক্ততা, থাকবে খোলা আকাশ, বাতাস, আর প্রকৃতির ছন্দময় উচ্ছলতা। সে জন্য শিশু তার মাকে রাবীন্দ্রিক ভাষায় যেমনটা বলেঃ
মাগো আমায় ছুটি দিতে বল
কাল থেকে পড়ছি যে মেলা
এখন আমি তোমার ঘরে বসে
করব শুধু পড়া পড়া খেলা।

তেমনি আপনি বুড়ো খোকারও সারাবছর কাজ করে করে নিজের মানি ব্যাগ ও ভূঁড়ির বারোটা বাজানোর পর খানিকটা যবনিকা, বিরতি বা বিশ্রামের দরকার আছে বটে। ডান হাতে, বাম হাতে, টেবিলের ওপরে বা নীচ দিয়ে যে টাকা কড়ি আসে অবকাশে গিয়ে তাকে এহাত-ওহাত না করতে পারলে কি আয় রোজগারে বরকত হবে? যদিও এই ছুটিটা সরকারী চাকুরেদের জন্য, তবে মনে রাখতে হবে এই চাকুরেদের লাখো পরিবারও এই ছুটিটার সমান বেনিফিশিয়ারি। অতএব ৯দিনের ছুটি পানেওয়ালাদের কোনো ঈর্ষা নয়, বাদ্য বাজুক, সুরের ঝড় উঠুক, নৃত্যে ছন্দ উঠুক, তা থা থৈ থৈ তা থৈ থৈ।

রাজধানী অথবা কর্মস্থলের নিত্যদিনের যানজট, বাড়িওয়ালার সেই একই ঘ্যানর ঘ্যানর, বিদ্যুতের অপেক্ষায় নিশিকালে দয়িতার সাথে রোমাঞ্চের সময় পাড়, ওয়াসার বর্জ্যমিশ্রিত জলে স্নান বা পিয়াসা নিবারণ, চোর ছ্যাছড়, ছিনতাইকারীর কাছে মোবাইল, ট্যাব, অর্থ বর্গা দেয়ার হাপিত্যেশ, আন্ডার প্রেশারে কায়কারবারের নিয়ত গলদঘর্ম জ্বলুনি এই নয়দিনে এসবের পুরোটাই মাফ। আহা যদি ঢাকার চোর ডাকাতদেরও সমান সময় ছুটি দেয়া যেত তবে টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপকেও নবম দিবসের জন্য ছুটিতে পাঠানো যেত।

তবু এই ভালো যে, এই ক'দিন পত্রিকায় গুজবের ডালপালারা ডানা মেলবে না, ব্রেন ওয়াশড উগ্রবাদী কচি ভাইসোনারা কারো ঘাড়ে চাপাতি মারবার জন্য মানুষ খোঁজে পাবে না, পুলিশ ভাইয়াদেরকেও একই স্ক্রিপ্টের এনকাউন্টার গপ্প বিশ্বাস করানোর পেরেশানি পোহাতে হবে না, পলিটিশানদের একে অপরকে দোষারোপের জন্য মঞ্চ সাজানো হবে না, বশংবদ টিভি ক্যামেরা বা সাংঘাতিক কলমের বাহাদুরিও দেখা যাবে না। ছুটির আনন্দে আমরা আজ এমনটা কেন ভাবব না, জগতে দুঃখ নাই, পাপ নেই, রেষারেষি নাই। হিংসা, দ্বেষ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ এসবের কিচ্ছুটি নেই। আছে কেবল সত্য, সুন্দর আর আনন্দ। উপনিষদ যেমনটা বলে রেখেছে সেই হাজার বছর আগে, আনন্দই শেষ কথা বলিয়াই জগৎ দুঃখদ্বন্দ্ব সহিতে পারে। দুঃখতো আছেই তাহার ওপরে আনন্দ আছে বলিয়াই সে আছে। নহিলে কিছুই থাকিত না। অতএব সারা বছরের জমানো দুঃখ গ্লানি'র ওপর আনন্দ জয়যাত্রার রথ ছোটাবার এইতো সময়।

সেই যে 'কবির কৈফিয়ত' প্রবন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেছেন, আনন্দরূপ মানুষের মধ্যে একবার ভাঙচুরের মধ্যে দিয়া তবে আপনার অখন্ড পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারিবে। যতদিন তা না হয় ততদিন লড়াইয়ের মন্ত্র দিনরাত জপিতে হইবে; ততদিন লাগাম পরিয়া মুখ থুবড়িয়া মরিতে হইবে। ততদিন ইস্কুলে আপিসে আদালতে হাটে বাজারে কেবলই নরমেধযজ্ঞ চলিতে থাকিবে। সেই বলির পশুদের কানে বলিদানের ঢাক-ঢোলই খুব উচ্চৈঃস্বরে বাজাইয়া তাহাদের বুদ্ধিকে ঘুলাইয়া দেওয়া ভালো- বলা ভালো, এই হাড়কাঠই পরম দেবতা, এই খড়গাঘাতই আশীর্বাদ, আর জল্লাদই আমাদের ত্রাণকর্তা।

আমাদের অন্তরের আনন্দরূপ নিরন্তর ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে তবে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠি আমরা। শপথ নিই, ছুটিতে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে ফিরে গিয়ে একটা ভালো কাজ অন্তত করবই। প্রকৃতির বন্ধু বৃক্ষরোপন, অসহায়কে সাহায্য কিংবা কোনো এক সাদাসিধা মুক্তিযোদ্ধার ঈদ উৎসবকে সত্যিকার অর্থেই আনন্দদায়ক করে তুলব। আর সেই বিন্দু বিন্দু ভালো কাজের পথ ধরেই শান্তি ও সুস্থিরতায় পৌছে যাবে দেশ ও মানুষেরা। তাই আমরা এবার ছুটির জয় বন্দনাই করব।
কবি সুকুমার রায় আমাদের গলায় তবে ধ্বনিত হোক-
এখন থেকে কেবল খেলা কেবল ছুটোছুটি
পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে আয়রে সবাই জুটি।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৯ জুন ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous

SCROLL FOR NEXT