নাগরিক সংবাদ

প্রলয়ঙ্করী স্যান্ডি আমি এবং আমরা

Byএম আর ফারজানা

আমরা আমেরিকার নিউজার্সিতে ( Ocean township ) বসবাস করছি এক যুগের ও বেশী। পরিচ্ছন্ন সাজানো ছবির মত এই শহরটি আমার খুব প্রিয় একটি শহর। বিশেষ করে আটলান্টিক সাগরের কাছাকাছি হওয়াতে। সাগর থেকে আমার বাসার দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমটার। স্মরণ কালের হারিকেন স্যান্ডির কালো ছোবলে বদলে গেছে এ শহরের চিত্র। যেন এক মৃত্যুপুরী। যেন এ শহর কে আমি চিনিনা, আগে কোনদিন আসিনি এখানে । জীবনে এই প্রথম এতটা ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম যা ভাবনা চিন্তা কল্পনাকেও হারিয়ে দিয়েছিল । ২৯ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এক ভয়াবহ সময় কেটেছে আমাদের যা বিশ্লেষণ করা দুঃসাধ্য । আমাদের মত লাখো মানুষের জীবনে ঘটে গেছে এই বিপর্যয় ।

২৮ অক্টোবর খবরে এই ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সতর্ক করা হয় এবং নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়। যেমনটা করা হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আইরিনের বেলায় । কিন্তু আমি নিজের বাসাতেই ছিলাম অন্য কোথায়ও যাইনি। যদিও আমার স্বামী এবং একমাত্র মেয়ে আফসানা (১১ বছর বয়স ) বার বার বলছিল আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যেতে। ২৮ অক্টোবর দুপুর থেকেই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে এবং ২৯ অক্টোবর বিকাল থেকেই ঝড়ের তিব্রতা বাড়তে থাকে প্রচন্ডভাবে এবং রাত প্রায় ৮ টার দিকে ভয়ংকর রূপ নেয় স্যান্ডি। ততক্ষণে আমরা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। চালু করি জেনেরেটর । কিন্তু রাত ৩ টার পর জেনেরেটার আর কাজ করছিল না। ততক্ষণে ভয়াল রূপ নিয়ে ঘণ্টায় ১২৯ কিলোমিটার বেগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি উপকূল অতিক্রম করছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি । ১৩ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস বইছিল। বাইরে শুধু অন্ধকার আর বাতাসের ভয়ানক গর্জন শুনছিলাম । ঘরে তখন মোমের আলোয়ে নিজেকেই অচেনা লাগছিল মনে হয়েছিল
এই বুঝি মৃত্যু আমাদেরকে আলিঙ্গন করবে। বাসায় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে ইলেকট্রিক হিটার, চুলা , পানি সব কিছুই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শরীর প্রায় বরফের মত জমে যাচ্ছিল । এভাবে রাত গিয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত ঝড়ের তান্ডব ছিল । ঝড় থামতেই বাইরে তাকিয়ে দেখি এ এক অন্য রূপ । ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে এলাকা । ঠাণ্ডায় যখন প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তখন পার্ককিং লটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হিট চালু করে গাড়ীর মধ্যে বসে ছিলাম এবং সেল ফোন চার্জ দিয়ে সবার সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করলাম। প্রতিবেশি রাশিয়ান দম্পতিকে খোঁজ নিতে গিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় আবিস্কার করলাম । তাদেরকে গাড়িতে নিয়ে আসলাম ও শুকনা খাবার, পানি খেতে দিলাম । পরবর্তিতে তারা চলে যায় তাদের ছেলের বাসায় নিউইয়র্কে। অপেক্ষা করছিলাম বিদ্যুতের তখন ও ভাবতে পারিনি ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ৫ হাজার কোটি ডলারের মত হবে। এই ভাবে সারাদিন কাটিয়ে পরদিন আমার আত্নীয়ের বাসায় চলে যাই। যাবার বেলায় দেখছিলাম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও নিউজার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি নিউজার্সির এলাকা পরিদর্শন করছিলেন ।বিদ্যুৎ সংযোগ কবে আসবে তার ঠিক নেই আর ততদিন পর্যন্ত আত্নীয়র বাসায় থাকব।

স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে এখনও পুরোপুরি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গরাজ্য গুলো । বিশেষ করে বর্তমানে যে সমস্যাটি প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে গ্যাস সংকট ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্নতা । লাখ লাখ মানুষ বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে । এতে করে নিন্ম তাপমাত্রার আবহাওয়ার মোকাবেলা করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র সড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে অনেক মানুষ। কোনো কোনো এলাকায় ১১ নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে নিউইয়কের্র বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান কনসলিডেট এডিসন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্স্যুরেন্স ইনফর্মেশন ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো বিপর্যয়ের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে স্যান্ডির অবস্থান চতুর্থ। প্রথম অবস্থানে আছে ২০০৫ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা, এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ার হামলা এবং তৃতীয় স্থানে আছে ১৯৯২ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় এন্ড্রু।

এই ঝড়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৯৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের মৃত্যু হয়েছে নিউ ইয়র্কে। ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডিতে ক্ষতিগ্রস্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতার জন্য 'হেল্প লাইন' চালু করেছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সমবেদনা জানিয়েছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মোমেন।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার ফেইসবুক ও প্রবাসি বাংলাদেশি বন্ধুদের কাছে আমার ফ্যামিলির কাছে যারা এই দুঃসময়ে আমাদের জন্য প্রার্থনা করছেন খোঁজ নিয়েছেন । এত মানুষের ভালোবাসা পাবো ভাবতে পারিনি। তাদের প্রেরণাই মূলত আমার মনে সাহস যুগিয়েছে ।

এম আর ফারজানা , নিউইয়র্ক থেকে । ২ নভেম্বর ২০১২।

(এই লেখাটি pbc.24 New York,সিলেটের আলাপ থেকেও প্রকাশিত )।

SCROLL FOR NEXT