)
বাংলাদেশ

চাহিদা-উৎপাদনের ফারাকে লোড শেডিং আরও বাড়ছে

Byনিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা, ডলারের দর বৃদ্ধি বছরের মাঝামাঝিতে দেশে ফিরিয়ে এনেছে বিদ্যুতের লোড শেপিং; সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আশা দিলেও সেই সময়ে এসে লোড শেডিং আরও বেড়েছে।

গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বিদ্যুতের লোড শেডিং কোথাও কোথাও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দিনের পাশাপাশি গরমের মধ্যে রাতও কাটাতে হচ্ছে বিদ্যুৎহীন অবস্থায়। ফলে গরমের মধ্য হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে মানুষকে। বিদ্যুতের অভাবে রাজধানীতে পানি সঙ্কটেও ভুগতে হচ্ছে অনেককে।

বিতরণকারী সংস্থাগুলো বলছে, সঙ্কটের মধ্যে অক্টোবরে গরম বেড়েছে, যা পরিস্থিতি নাজুক করে তুলছে। চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না, ফলে কর্তৃপক্ষও অসহায়।

রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গায় ৩৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় পারদ উঠেছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে। আরও কয়েক দিন এমন গরম থাকবে বলেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

দেশে এখন দিনে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় দেড় থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকায় লোড শেডিং বেড়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে ১২ হাজার ১৮৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। আর রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে।

কর্মকর্তারা লোড শেডিং বাড়ার জন্য জ্বালানি সঙ্কটের পুরনো কারণগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়কেও কারণ দেখাচ্ছেন।

একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্রিড বিপর্যয়ের পর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ানরা সাবধানতার ‘চরম নীতি’ অনুসরণ করছেন। সেজন্য খুবই সতর্কতার সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো হচ্ছে। সে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেখানে ১৮০-১৯০ মেগাওয়াট উৎপাদন হত, গ্রিড বিপর্যয়ের পর সেখানে ১২০-১৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না।

গত ৪ অক্টোবর বিদ্যুতের জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সমস্যার পর অন্তত ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিশাল এলাকা।

জ্বালানি সঙ্কটে জুলাইয়ে সরকার সূচি অনুযায়ী লোড শেডিংয়ের যে পরিকল্পনা দিয়েছিল, উৎপাদন কম হওয়ায় শুরু থেকেই তা ভেস্তে যায়।

ঘাটতি বাড়তে থাকার মধ্যেই জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটে। এরপর সঞ্চালন লাইন সচল হলেও লোড শেডিং আগের তুলনায় বেড়ে গেছে।

সম্প্রতি জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তি চরমে ওঠে

ভোগান্তি অসহনীয়

এই অবস্থায় রাজধানীবাসীকে দিনের অনেকটা সময় বিদ্যুৎহীন অবস্থায় পার করতে হচ্ছে। ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি আরও নাজুক।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, দিনের পাশাপাশি এখন মধ্যরাতেও কয়েক দফায় লোডশেডিং হচ্ছে।

মিরপুরে কিছুদিন আগেও দৈনিক গড়ে ৩-৪ বার লোডশেডিং হলেও এখন হচ্ছে ৬-৭ বার এবং বিদ্যুৎ আসছে আগের তুলনায় বেশি সময় পরে।

মিরপুর ১২ নম্বরের বাসিন্দা একরামুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শনিবার রাত ১২টার পর থেকে বিকাল পর্যন্ত ৪ বার লোড শেডিং হয়েছে।

“গতকাল রাত ১ টা থেকে ২টা, পৌনে ৭টা থেকে পৌনে ৮টা, সকাল পৌনে ১২টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত আরও দুইবার বিদ্যুৎ গেছে। মাঝরাতে যদি দুইবার বিদ্যুৎ চলে যায়, ঘুমাব কীভাবে? আগে তো রাতের দুর্ভোগটা ছিল না, এখন সেটা শুরু হল।”

লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় বেশি দুর্ভোগে পড়েছে শিশু ও বয়স্করা।

কবির বলেন, “আমার তিন বছরের মেয়ে আর সাড়ে ছয় মাসের ছেলেটা কারেন্ট চলে যাওয়ায় অস্থির হয়ে পড়েছে। রাতে বাচ্চা দুইটা একদম ঘুমাতে পারেনি। দিনের বেলায়ও তো বিদ্যুৎ যাচ্ছে।”

মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আজিমপুর, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো, গোড়ান এলাকায় গতকাল রাত ১২টার পর থেকে সন্ধ্য পর্যন্ত ৫-৬ বার বিদ্যুৎ যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের আগে দক্ষিণ গোড়ান এলাকায় ২-৩ বার লোড শেডিং হলেও শনিবার থেকে ৬-৭ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে এবং এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আসছে।

দক্ষিণ গোড়ানের বাসিন্দা গৃহিনী মোর্শেদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুদিন ধরে একদম অসহ্য হয়ে যাচ্ছি লোড শেডিংয়ে। একে তো অনেক গরম, তার উপরে এত বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে, যেটা বলার না। রাত ১২টার পরে সকাল পর্যন্ত তিন বার লোড শেডিং হল।

“আমরা মধ্যবিত্তরা আইপিএস বা জেনারেটর চালানোর মতো অবস্থায় নাই। চার্জার ফ্যান-লাইট যে কিনব, সব কিছুর দাম এত বেশি, সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। এগুলোর জন্য আলাদা বাজেট করার মতো অবস্থা নাই।”

তিনি বলেন, “আমরা কোনোরকম সহ্য করে নিচ্ছি। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি বয়স্ক মানুষ, ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার-নানা ধরণের রোগে ভুগছেন। লোডশেডিংয়ে ওনার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জানি না কমে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।”

ঢাকার রামপুরায় গত কয়েকদিন ধরে তিন ঘণ্টা পর পর লোড শেডিং হচ্ছে।

রামপুরার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, “তার মানে দৈনিক ৮ বার লোড শেডিং। এটা ভাবা যায়! বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে একে তো নাভিঃশ্বাস অবস্থা, তার উপরে পানির সঙ্কটও তৈরি হয়েছে। চলাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।”

আজিমপুরের শেখ সাহেব এলাকার বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন লোড শেডিংয়ে গরমের দুর্ভোগের পাশাপাশি ফ্রিজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝামেলায় পড়েছেন।

“এই এলাকা তো এমনিতেই ঘিঞ্জি। আলো-বাতাস ঢোকে না একেবারে। গরমে তো কষ্ট হচ্ছেই, তার উপরে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে ফ্রিজটাও নষ্ট হয়ে গেল। দুই বছরও ভালোভাবে চালাতে পারলাম না। লোড শেডিংয়ে ক্ষতির কথা বলে বোঝানো যাবে না। বাচ্চারা পড়তে বসলে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে, পরে আর পড়ায় মনোযোগ দেয় না। খুব সমস্যা হচ্ছে।”

আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মমিনা ইসলাম বলেন, “বেশ গরমের মধ্যেও দিনে চার-পাঁচবার বিদ্যুৎ চলে যায়, এজন্য মাঝে মাঝে বাসায় পানিরও সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। একদিকে গরম, একই সঙ্গে মশার উপদ্রব, তার সাথে দেখা দিয়েছে পানির সঙ্কট। এইসব নিয়ে আমরা দিন পার করছি।”

বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জাতীয় গ্রিড

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা বলছেন, যখন প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন, তখন বেশ কয়েকটি কারণ মিলে সঙ্কট তীব্র হয়েছে।

তাদের ভাষ্য, বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলো ইউনিট কারিগরি কারণে বন্ধ আছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ আরও কমেছে। বেশ কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৪-৫ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে, সে কারণে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে।

বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হওয়ার মধ্যে গরমে চাহিদা বেড়েছে। গরম না কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশা দেখছেন না তারা।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকদিন ধরে গরমটাও অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছে। মানুষ ফ্যান, এসি এগুলো বেশি ব্যবহার করছে। লোড অনেক বেড়ে গেছে।

“সাধারণত ছুটির দিনে আমাদের চাহিদা থাকে ১৪৫০-১৫০০ এর মতো। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ১১০০-১২০০ এর মতো। আমরা বরাদ্দ কম পাচ্ছি, তাই লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।“

ডেসকোর এমডি কাউসার আমির আলীও বলেন, “আমরা যতটুকু বরাদ্দ পাচ্ছি, সে অনুযায়ী বিতরণ করছি। পিডিবি আমাদের যা দিচ্ছে, আমরা তাই দিচ্ছি। কিন্তু চাহিদা আরও বেশি।”

সঙ্কটের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পিডিবি আমাদের জানিয়েছে, তারা গ্যাস পাচ্ছে না। তরল জ্বালানি প্রাপ্তিতে সমস্যা হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছি না।”

SCROLL FOR NEXT