বাংলাদেশ

লাখে একটা, তাও দুর্গন্ধে ভরা

Byবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
শহরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা একেবারেই কম। যেগুলো আছে সেগুলোর পবিবেশও অনুকূল নয়। ছবিটি আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কোটি মানুষের ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৫০ লাখের বেশি পথচারী চলাচল করলেও তাদের জন্য ‘পাবলিক টয়লেট’ আছে মাত্র ৪৭টি। সে হিসেবে প্রতি এক লাখ মানুষের ব্যবহারের জন্য একটি করে পাবলিক টয়লেটও নেই।

আর যেগুলো আছে বাস্তবে সেগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপোযোগী। পর্যাপ্ত আলোহীন এসব টয়লেটে থাকে না প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থা। ভাঙা পানির কল, বদনা- এগুলো যেন স্বাভাবিক বিষয়। টয়লেটগুলোতে ঢুকতেই নাকে আসে দুর্গন্ধ; স্যাঁতসেতে, নোংরা মেঝে, দেয়াল আর দুর্গন্ধ ভরা টয়লেটে টেকাই দায়। কোনো রকমে কাজ সেরে সেখান থেকে বেরিয়ে কোনো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক থাকাও যেন চ্যালেঞ্জ।

ঢাকার বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেক নারী হলেও পাবলিক টয়লেটগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশেই নারীদের জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা নেই। নেই শিশু ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী টয়লেট।

পাবলিক টয়লেটের স্বল্পতা, সচেতনতা আর নজরদারির অভাবে রাজধানীর অনেক ফুটপাতই মল-মূত্রের গন্ধে হাঁটার জন্য অস্বস্তিকর। শহরের অলি-গলি, প্রধান সড়কের আশপাশ প্রায় সবখানেই এ চিত্র নিয়মিত।

শহরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা একেবারেই কম। যেগুলো আছে সেগুলোর পবিবেশও অনুকূল নয়। ছবিটি আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শহরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা একেবারেই কম। যেগুলো আছে সেগুলোর পবিবেশও অনুকূল নয়। ছবিটি আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শাহবাগের ফুটপাত ধরে বাস স্টপেজে গিয়ে নিয়মিত বাস ধরেন ভয়েস আর্টিস্ট মার্জিতা প্রিমা।

মল-মূত্রের দুর্গন্ধে বিরক্ত এই নারী বলেন, “এইটা ক্যামন শহর বলেন? পুরুষের মুতে ভাসা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে কর্মস্থলে যেতে যেতে বমি আসে, আর মনে হয় এদের কি কোনো সিভিক সেন্স নেই?

“কিন্তু আমার নিজের কথা যদি বলি আমার জন্য তো কোনো পাবলিক টয়লেটই নাই এ শহরে। হিসু আটকাইয়া রাখতে রাখতে মনে হয় আমার কিডনিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ে গিয়ে শহরে ঠিক কতগুলো গণশৌচাগার বা পাবলিক টয়লেট ব্যবহার উপযোগী আছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে ওয়াটার এইডের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন নির্মিত মোট ৬৯টি পাবলিক টয়লেটের মধ্যে এখন ৪৭টি টিকে আছে। সেগুলোর মধ্যে পাঁচটি মোটামুটি ব্যবহার উপযোগী।

বাকিগুলোর মধ্যে দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, ১০টি বন্ধ হয়ে গেছে এবং বাকি ১০টিতে কোনো সেবা নেই।

২০১১ সালে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ ও ওয়াটার এইড পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটারের এই শহরে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে পাঁচ লাখ ভাসমান, রিকশাচালক ১০ লাখ, অন্যান্য জীবিকার মানুষ ১০ লাখ, নিয়মিত পথচারী ২০ লাখ এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা ১০ লাখসহ মোট ৫৫ লাখ মানুষের প্রতিদিন চলাচলের সময় টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।

শহরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা একেবারেই কম। যেগুলো আছে সেগুলোর পবিবেশও অনুকূল নয়। ছবিটি আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শহরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা একেবারেই কম। যেগুলো আছে সেগুলোর পবিবেশও অনুকূল নয়। ছবিটি আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

রাজধানীর গুলিস্তান, শাহবাগ মোড়, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, ইন্দিরা রোড, বিমানবন্দর রেল স্টেশনের পাশের পাবলিক টয়লেটগুলি ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে।

মহানগরীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা কারওয়ান বাজারের পাবলিক টয়লেট ঘুরে দেখা যায়, এর মূল মেঝে মোটামুটি পরিস্কার থাকলেও চারটি টয়লেটের অবস্থাই শোচনীয়। টয়লেট এলাকাজুড়েই ছিল মানব বর্জ্যের উৎকট দুর্গন্ধ। ভিতরে ছিল না পর্যাপ্ত আলো।

গর্তের দুপাশে একটি করে ইট দিয়ে বানানো কমোডগুলোই বলে দিচ্ছিল টয়লেটগুলোর মানের বেহাল দশা। এই পরিবেশে কেউ একবার ঢুকলে এই অভিজ্ঞতা তাকে দুঃস্বপ্নের মতই তাড়া করার কথা। তবু এর মাঝেই গোসল করছিলেন সাত-আটজন মানুষ।

সেখানে টোল আদায়ের দায়িত্বে থাকা মো. ঈসা বলেন, “পানির অভাবে এখানে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যাচ্ছে না।

“এখানে প্রায়ই পানি থাকে না। ওয়াসা যদি ঠিক মত পানি দিত তাহলে পরিবেশ কিছুটা ভাল রাখা সম্ভব হত।”

সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারে থাকা পাবলিক টয়লেটগুলোর এই চিত্রের পাশাপাশিই দেখা গেছে ভিন্ন চেহারা এবং পুরো ঢাকা তা শুধু একটি স্থানে।

ওয়াটার এইডের ব্যবস্থাপনায় একটি গণশৌচাগার চলছে গাবতলীতে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের ভিতরে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য স্থাপিত পাবলিক টয়লেটটির পরিস্থিতি বাকি সবগুলো থেকে একবারেই আলাদা।

বাইরে থেকেই আলো-ঝলমল ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বোঝা যায়। ভেতরেও আছে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা, যেগুলো ঢাকার আর কোনো পাবলিক টয়লেটে নেই।

সেখানে হাত-মুখ ধোঁয়া ও গোসলের ব্যবস্থা, সাবান, টয়লেট পেপার, সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির আলাদা ব্যবস্থা, নারী ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী টয়লেট, সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী, স্বচ্ছ আয়না, নিরাপত্তার জন্য মূল প্রবেশ দ্বারে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, ব্যাগ কিংবা মূল্যবান জিনিসপত্র সাময়িকভাবে রাখার জন্য লকার রাখা হয়েছে।

প্রায় এক বছর ধরে এভাবে এই পাবলিক টয়লেটটি চলছে। ব্যবহারকারীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা সেটি উন্মুক্ত থাকে বলে জানান সেখানে ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বরতরা।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বুয়েটের প্রবীণ অধ্যাপক ড. সরওয়ার জাহান জানান, শহর পরিকল্পনায় গুরুত্ব বিবেচনা করে আশির দশক থেকে গণশৌচাগার স্থাপন শুরু হয়।তবে জনসংখ্যা অনেক বাড়লেও সে অনুপাতে গণশৌচাগারের সংখ্যা বাড়েনি। যেগুলো আছে সেগুলোও তদারকির অভাবে ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পাবলিক টয়লেটগুলি বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দিয়ে রেখেছে সিটি করপোরেশন। তবে সেগুলোতে ঠিকমত সেবা দেওয়া হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নেই তদারকি।

ইজারাদাররা বেশি টাকার আয়ের জন্য প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই পাবলিক টয়লেটকে ব্যবহার করছেন গাড়ি ধোঁয়া, পানি বিক্রি, মাদক ব্যবসা; এমনকি রাতে ভাসমান লোকদের থাকার কাজে।

পাবলিক টয়লেটের পানি দিয়েই চলছে গ্যারেজের গাড়ি ধোয়ার কাজ। ছবিটি আজিমপুর মেটার্নিটি এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

পাবলিক টয়লেটের পানি দিয়েই চলছে গ্যারেজের গাড়ি ধোয়ার কাজ। ছবিটি আজিমপুর মেটার্নিটি এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হেলথ অফিসার মাসুদ আহসানও পাবলিক টয়লেটগুলোর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কথা স্বীকার করেন।

কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আগে যে টয়লেটগুলো ছিল সেগুলো ব্যবস্থাপনার ভার ছিল লিজ নেওয়া ব্যক্তিদের ওপর, কিছু ক্ষেত্রে লোকাল অথরিটির উপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু সেই ম্যানেজমেন্ট সাকসেসফুল হয় নাই। এখন সেই লিজগুলো পর্যায়ক্রমে বাতিল করা হচ্ছে।

“তবে এখন যেগুলো করছি সেগুলো যারা তৈরি করবে তারাই তিন/চার বছরের জন্য ব্যবস্থাপনায় থাকবে।এটি সফল হলে ওই পদ্ধতিই চালিয়ে যাওয়া হবে।”

জাতীয় স্যানিটেশন কৌশল -২০০৫ এ বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলো নগরবাসী ও পথচারীদের জন্য গণশৌচাগার নির্মাণ করবে এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেসরকারি পর্যায়ে ইজারা দেবে।

তবে ঢাকা সিটি করপোরেশন অ্যাক্টের ৭৯ নম্বর ধারায় (জনস্বাস্থ্য) বলা হয়েছে, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী কিংবা সরকারের নির্দেশনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক এবং উপযুক্ত স্থানে গণশৌচাগার সেবা প্রদান ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করবে সিটি করপোরেশন।

এই শৌচাগারগুলোতে নারী-পুরুষের পৃথক সুবিধা এবং নিয়মিত পরিস্কার করার কথাও আইনে বলা হয়েছে।

আবার নগর উন্নয়ন সংক্রান্ত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান- ড্যাপের আওতায় পাবলিক টয়লেট নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজউকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলা হলেও রাজউকের ড্যাপের নতুন সংস্করণে পাবলিক টয়লেটের জন্য কোনো জমির সংস্থান নেই।

গ্যারেজের গাড়ি ধোয়ার পাশাপাশি পাবলিক টয়লেটের পানি বিক্রি হচ্ছে বাইরেও। ছবিটি আজিমপুর মেটার্নিটি এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

গ্যারেজের গাড়ি ধোয়ার পাশাপাশি পাবলিক টয়লেটের পানি বিক্রি হচ্ছে বাইরেও। ছবিটি আজিমপুর মেটার্নিটি এলাকা থেকে তোলা। ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

পাবলিক টয়লেট সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা বাংলাদেশ জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-বিএনবিসিতে থাকলেও তা অনুসরণের ব্যাপারে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।

সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “জনগুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির প্রধান সমস্যা হল- যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং যা আছে তার ব্যবস্থাপনার সমস্যা।”

জনস্বাস্থ্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে পাবলিক টয়লেট নিয়ে ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন ড. নজরুল ইসলাম। এ ক্ষেত্রে সরকারের ধীরগতিরও সমালোচনা করেন এই নগরপরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ।

জনবহুল এলাকা ও চাহিদা বিবেচনা করে পাবলিক টয়লেট নিয়ে সরকারের দিক থেকে বিস্তৃত পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

SCROLL FOR NEXT