চার ব্লগারের জামিন আবেদনের শুনানির পর মহানগর হাকিম মোহাম্মদ তারেক মঈনূল ইসলাম ভূইয়া দুই তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম ও সাজ্জাদ হোসেনকে এই নির্দেশ দেন।
বুধবার প্রতিবেদন পাওয়ার ভিত্তিতে শুনানি করে পরবর্তী আদেশ দেয়া হবে বলে আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
দুই দফায় চার দিনের রিমান্ড শেষে ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিন এবং সাত দিনের রিমান্ড শেষে ব্লগার সুব্রত অধিকারী শুভ, মশিউর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজকে গত বুধবার আদালতে হাজির করা হয়। তাদের জামিন আবেদন শোনার জন্য সোমবার দিন রেখে কারাগারে পাঠায় আদালত।
সোমবার সকালে মহানগর হাকিম আদালতে আসিফের জামিন আবেদনের শুনানি হয়। এরপর বিকালে শুভ, বিপ্লব ও রাসেলের আবেদন শোনেন হাকিম মোহাম্মদ তারেক মঈনূল ইসলাম ভূইয়া।
শুনানি শেষে তিনি ব্লগারদের বিষয়ে পুলিশকে প্রতিবেদন দিতে বলেন।
হেফাজত ইসলাম নামের একটি সংগঠনের দাবির প্রেক্ষাপটে গত ১ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রোপ্তারের পর শুভ, বিপ্লব ও পারভেজকে ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসাবে সাত দিনের রিমান্ডে নেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন।
আসিফের জামিন আবেদনের শুনানিতে উপস্থিত তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মাইনুল ইসলামের কাছে আদালত জানতে চান, ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পর আসিফের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আসিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তিনি যে তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন, তাতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে (আইসিটি) মামলা করা যেতে পারে।
পরে রাসেলের পক্ষে জ্যের্তিময় বড়ুয়া, বিপ্লবের পক্ষে অ্যাডভোকেট মানোয়ার হোসেন ও শুভর পক্ষে অ্যাডভোকেট প্রাণনাথ আদালতে শুনানি করেন।
শুনানির শুরুতেই তদন্ত কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেনের কাছে কাছে তদন্তের অগ্রগতি জানতে চান বিচারক।
জবাবে সাজ্জাদ জানান, অভিযুক্তদের ব্লগে মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিটিসিএলের প্রধানকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
ব্লগার রাসেলের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ সময় বলেন, প্রথমদিনের রিমান্ড আবেদন এবং রিমান্ড ফেরতের প্রতিবেদনেও এসব কথা বলা হয়নি।
“আসলে তদন্ত কর্মকর্তা তাদের আটকে রাখার মতো অথবা সুনির্দিষ্ট মামলা দেয়ার মতো কোনো তথ্যই পাননি। পেলে এর আগে দাখিল করা রিমান্ডের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হতো।”
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার আইনগত ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনজীবী বলেন, “৫৪ ধারার অপপ্রয়োগের কারণেই ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. হামিদুল হক এবং সালমা মাসুদ চৌধুরীর বেঞ্চ একটি সিদ্ধান্ত দেয়, যা পুলিশ একদমই মানে না।”
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ব্লগারদের আটকের পর ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্ত কর্মকর্তারা কোনো সুনির্দিষ্ট মামলা বা অভিযোগ আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও তাদের কারাগারে অন্তরীণ রাখার জন্য আদালতে দাঁড়িয়ে বার বার আবেদন করছেন।
“এর বিরুদ্ধে আমরা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হতে পারি। পুলিশ বায়বীয় ও ঝাপসা বক্তব্য দিয়ে অভিযুক্তদের মারাত্মক রকমের হয়রানি করছেন। তাদেরকে জামিনে মুক্তি দেয়া হোক,” বলেন তিনি।
তিনি জানান, রাসেল পদার্থবিজ্ঞানে বিদেশে পিএইচডি শেষে দেশে ফিরেছেন। তিনি একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তার স্ত্রীও পিএইচডি শেষে শিক্ষকতায় যুক্ত।
“আমাদের বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকেই থাকে তাহলে ৫৪ ধারা কেন, সুনির্দিষ্ট মামলা করুন। যে শাস্তি হয় আমরা মাথা পেতে নেব। দয়া করে আমাদের বলির পাঠা বানাবেন না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মশিউর রহমান বিপ্লবের পক্ষে শুনানিতে তার আইজীবী মনোয়ার হোসেন জানান, ২০১২ সালের অগাস্ট মাসের পর থেকে মশিউর রহমান আর কিছু লেখেননি।
তিনি প্রশ্ন করেন, “তারপরও কেন তাকে আটক রাখা হবে?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র সুব্রত অধিকারী শুভর আইনজীবী শ্রী প্রাণনাথ ‘আমার ব্লগের’ মুখপাত্র সুশান্ত দাশগুপ্তের সুপারিশ করা একটি দলিল উপস্থাপন করে বলেন, ‘সাদা মুখোশ ’ আইডি শুভর নয়, অন্য কারো । সুতরাং হিন্দু ধর্মবলম্বীদের দেবতা ‘রামকে’ নিয়ে লেখাও শুভর নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের দাবিতে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের প্রতিবাদেই গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। পরে এই আন্দোলনে যুক্ত হয় বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর মাঠে নামে চট্টগ্রামভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, যারা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ এনে তাদের শাস্তি দাবি করে।
হেফাজতে ইসলাম গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়াসহ যে ১০ জন ‘নাস্তিক’ ব্লগারের ফাঁসির দাবি তুলেছে, সেই তালিকায় আসিফের নাম প্রথমদিকেই ছিল।
ব্লগে লেখালেখিকে কেন্দ্র করে ২০১১ সালের ১ অক্টোবর আসিফকে ১৮ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ‘লেখালেখি বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে’ মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ব্লগে লেখালেখির জন্য হামলার মুখেও পড়তে হয় আসিফকে। গত ১৪ জানুয়ারি রাতে উত্তরায় তার ওপর হামলা হয়।
ছুরিকাঘাতের গুরুতর জখম নিয়ে বেশ কিছুদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।