প্রবন্ধ

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা ও বুদ্ধের ধর্ম আত্মশরণের

Byv_sunandapriyo
gautama.jpg
gautama.jpg

শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের একটি পুণ্যময় তিথি; তাৎপর্যমণ্ডিত দিন। এই দিনে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব গৌতম বুদ্ধ বিশাখা নক্ষত্রে বৈশাখের পুণ্যালোকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সিদ্ধার্থ গৌতমের পিতা ছিলেন শাক্যবংশের রাজা শুদ্ধোধন। মাতা ছিলেন রাণী মহামায়া। হিমালয়ের পাদদেশে নেপালের শাক্যদের রাজধানী ছিল কপিলাবস্তু। সিদ্ধার্থ গৌতমের মাতৃদেবী রাণী মহামায়া পিত্রালয়ে যাওয়ার পথে কপিলাবস্তু হতে কয়েক মাইল দূরে লুম্বিনী কাননে বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে রাজকুমার সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

সিদ্ধার্থ গৌতম রাজকীয় ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত পালিত হলেও বাল্যকাল থেকে তিনি জগত-সংসার সম্পর্কে চিন্তা করতেন। রাজা শুদ্ধোধন তাঁর বৈরাগ্যভাব দেখে সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যশোধরা নাম্নী এক অনুপম সুন্দরীর সঙ্গে উনিশ বছর বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করান। সংসারের দুঃখ-কষ্ট যাতে সিদ্ধার্থের দৃষ্টিগোচর না হয় তার সব ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু জীবনে যে দুঃখ সত্য তা সংসারে আবদ্ধ হয়ে সিদ্ধার্থ উপলব্ধি করলেন। মানুষের জীবনে জরা, ব্যাধি, মরণ কেন হয় তা সিদ্ধার্থ গৌতমকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলল। পুত্র রাহুলের জন্মের পরই সিদ্ধার্থ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে রাজসিংহাসন, ভোগঐশ্বর্য সমস্ত কিছু ত্যাগ করে সংসার বন্ধন ছিন্ন করে সত্যের অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন। রাজকীয় ঐশ্বর্য, সুন্দরী স্ত্রী, পুত্র রাহুল কোন বন্ধনই তাকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি। কথিত আছে রাজা শুদ্ধোধন তাকে সন্ন্যাস গ্রহণে বিমুখ করার চেষ্টা করলে তিনি বলেছিলেন-'যদি আপনি এই আশ্বাস দিতে পারেন যে, কখনও আমার মৃত্যু হবে না, ব্যাধি আমায় পীড়িত করবে না, জরা আমার যৌবনকে আকর্ষণ করবে না বা কোন বিপদই আমার সম্পত্তি হরণ করবে না, তা হলেই আমি সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্কল্প ত্যাগ করতে পারি।'
পৃথিবীতে এ আশ্বাস দিতে পারে কোন মানুষ? মুক্তির সন্ধানে অবশেষে সিদ্ধার্থ গৌতম কঠোর সাধনায় নিমগ্ন হলেন। গয়ার নিকট তিনি কৃচ্ছ্রসাধনে প্রবৃত্ত হলেন। অবশেষে ছয় বছর কঠোর সাধনার পর উপলব্ধি করলেন কৃচ্ছ্রসাধনে নয়, মধ্যম পথই মানবের মুক্তির উপায়। মধ্যমপন্থা গ্রহণ করে গয়ার নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন। সে দিনই ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করে হলেন গৌতম বুদ্ধ। জগত সংসারের জন্ম-মৃত্যু রহস্য তাঁর কাছে উন্মোচিত হলো। বুদ্ধত্ব লাভ করে তিনি আনন্দোচ্ছাসে যে উদানগাথা ভাষণ করলেন তাতে বুদ্ধের নির্বাণ দর্শনের সারতত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়-

'হে গৃহকারক, তোমার সন্ধানে কত জন্ম-জন্মান্তরই না এই দুঃখময় সংসার আবর্তে ঘুরে বেড়িয়েছি-তোমায় খুঁজে পাইনি এতদিন। আজ তোমায় চিনেছি, আর তুমি গৃহ- নির্মাণ করতে পারবে না। এই গৃহের সকল কাষ্ঠদ- (ফাসুকা, পার্শ্বকা) ভগ্ন হয়েছে। গৃহচূড়া ধ্বংস হয়েছে। সংসারসমূহের বিনাসে আমি নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছি। আমার সকল তৃষ্ণার ক্ষয় হয়েছে' ।(ধর্মপদ-১৫৩)

তথাগতের এ সত্য উপলব্ধি বিধৃত হয়েছে এ গাথায়। এখানে যে গৃহকারকের অন্বেষণে গৌতম জন্ম-জন্মান্তরে সংসার আবর্তে আবর্তিত হয়েছেন তার নাম হলো 'তৃষ্ণা'। এ তৃষ্ণার কারণে মানুষ জন্ম-জন্মান্তর ঘুরে বেড়ায়। এই তৃষ্ণা থেকেই রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান-এদের সমষ্টিরূপ এই দেহাশ্রিত, ব্যক্তিসত্তা, আমাদের আমিত্ববোধ উদ্ভূত অবিদ্যা এই স্কন্ধ সমবায়ের চূড়া (গৃহকৃট:রাগ-দ্বেষ-মোহ এই দেহাগারের পাশ্বকা (ফাসুকা)। অবিদ্যার গ্রন্থি যখন ছিন্ন হয়, তৃষ্ণার যখন ক্ষয় হয়, তখনই মানুষ দুঃখ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পায়। সেই মুক্তি হলো বুদ্ধের দর্শনে নির্বাণ।

দুঃখের নিবৃত্তির পথ খুঁজেছিলেন তথাগত বুদ্ধ। তিনি তার সন্ধানও পেয়েছিলেন। বোধি লাভের পর চারটি আর্যসত্য উপলব্ধি করলেন, তা হলো-(১) দুঃখ আছে (২) দুঃখের উৎপত্তি আছে (৩) যার উৎপত্তি আছে তার লয়ও আছে, সুতরাং দুঃখেরও লয় আছে (৪) দুঃখ নিরোধের পথও আছে। এ চতুরার্য সত্য ব্যতীত জগতে অন্য কোন ধর্ম নেই। এতেই পৃথিবীর সকল সত্যের সন্ধান নিহিত। বুদ্ধ পঁয়তাল্লিশ বছরব্যাপী দেব মানবের হিতে তাঁর-এ সত্যের বাণী প্রচার করেন।

তথাগত বুদ্ধের বয়স যখন আশি বছর তখন উপলব্ধি করলেন, তাঁর মহাপরিনির্বাণের সময় আসন্ন। বৈশালীতে তিনি একদিন তাঁর ভিক্ষুসংঘকে ডেকে বললেন-বৈশালীতে এই আমার শেষ অবস্থান, তিন মাস পরেই তথাগত পরিনির্বাপিত হবেন। তোমরা কাতর হয়ো না। যে ধর্ম তোমাদের কাছে প্রকাশ করলাম, অনুরাগের সঙ্গে সেই ধর্ম অনুশীলন করে নির্বাণ লাভের জন্য আয়াস কর। অতঃপর বুদ্ধ আনন্দকে ডেকে বললেন–'কুশীনগরে গিয়ে মল্লদের সংবাদ দাও যে তথাগতের পরিনির্বাণ আসন্ন। পরে যেন তারা খেদ না করে যে, তথাগত আমাদের গ্রামেই দেহ রক্ষা করলেন কিন্তু শেষ সময় আমরা তাঁকে দেখতে পেলাম না।'

অনন্তর বুদ্ধ সমবেত শিষ্যদের বললেন- "সংহত পদার্থ মাত্রই নশ্বর। এই সকল বস্তুই ক্ষয়শীল। তোমরা অপ্রমাদের সাথে নিজের মুক্তির পথ অন্বেষণ কর।" তথাগত বুদ্ধ এ কুশীনগরের মল্লদের শালবনে মহাপরিনির্বাণপ্রাপ্ত হলেন, সেদিনও ছিল বৈশাখের পুণ্যলগ্ন পূর্ণিমা তিথি। মহাপরিনির্বাণ লাভের পূর্বে বুদ্ধ শিষ্যদের যে সকল উপদেশ দিয়েছিলেন 'আত্মদীপো ভব'-তুমি নিজে তোমার আলোকবর্তিকা হও, তোমার প্রজ্ঞাদৃষ্টিই তোমাকে পথ দেখাবে; তোমার পথ দেখাবার আলো আসবে না তোমার বাইরে থেকে। যারা পথ দেখাবার ভিড় করে না, তারা কেবল বাড়ায় খোঁজা।' এ প্রজ্ঞা দৃষ্টি লাভ করেই সিদ্ধার্থ গৌতম পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি আলোকবর্তিকা বুদ্ধ হয়েছিলেন। আর তখনই তিনি বলতে পেরেছিলেন 'সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভ করে আমি আর কার কাছে শিক্ষা নেব'। শিষ্যদেরও উপদেশ দিয়ে বলছেন-'অত্তা হি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরো সিযা'- তুমিই তোমার নাথ বা প্রভু। তুমিই তোমার আশ্রয়। তুমি ছাড়া তোমার অন্য কোন আশ্রয় আছে? সুতরাং 'তুম্মে হি কিচচং আতপ্পং'-মুক্তির চেষ্টা তোমাকেই করতে হবে; আমি পথ প্রদর্শক মাত্র!'

'সব্বে ধম্মা অনত্তা'-সকল বস্তুই অনিত্য, ক্ষয়শীল, এদের প্রতি আসক্তি বা মমত্ববোধ ত্যাগ করলেই মানুষ মুক্ত হবে। সেই মুক্ত পুরুষই অর্হৎ পুরুষোত্তম যার ইহ ও পরলোক কোন কিছুর প্রত্যাশা নেই, যিনি বিসংযুক্তা বীতৃষ্ণা এবং সেই হেতু বিগত ভয়। মৃত্যুর ভয় থেকেও তিনি মুক্ত, কারণ তিনি আসক্তিহীন, আত্মদৃষ্টি বা আত্মপ্রীতি তার সমুচ্ছিন্ন।

তথাগত বুদ্ধের ধর্ম বিশেষভাবে প্রজ্ঞানির্ভর। বৌদ্ধধর্মের আদর্শ মানব, যিনি অরি (শত্রু) ধ্বংস করে অরহত প্রাপ্ত হয়েছেন- তিনি অশুদ্ধ;অকৃতজ্ঞ (নির্বাণপ্রাপ্ত), মানবিক ও দিব্য, সর্বপ্রকার যোগ বা বন্ধন থেকে মুক্ত, সকল তৃষ্ণা বর্জন করে তিনি প্রব্রজিত, অনাগারিক। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা গৃহীর পক্ষে তো এই আর্দেশ উপনীতি হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে বুদ্ধ সমস্ত তৃষ্ণার বন্ধন ছিন্ন করার জন্য বলেছেন। তৃষ্ণার বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মানব মুক্তি কি কখনও সম্ভব? তৃষ্ণাই তো সকল দুঃখের মূল। যত দিন না মানব লোভ -দ্বেষ-মোহের মূলোৎপাটন করতে পারবে ততদিন নানা দুঃখের সাগরে মানবকে ভাসতে হবে। তবে গার্হস্থ্য জীবনেও দুঃখের অবসান ঘটানো যায়–তা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অসংখ্য বন্ধন ছিন্ন করা সেতো কত কঠিন, নিজেকে উপলব্ধি করলে এর সত্যতা প্রমাণ মিলবে। বৌদ্ধশাস্ত্রে গৌতম বুদ্ধকে বলা হয়েছে-'সম্যক সম্বুদ্ধ' 'লোকোত্তর পুরুষ' ও 'তথাগত'। বুদ্ধের নামে 'তথাগত' নামটি কিন্তু বিশেষ তাৎপর্যপূণ। অতীত বুদ্ধগণের মতো যিনি মানব মুত্তির জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন (তথা আগত)তাকে তথাগত বলা হয় । অতীত বুদ্ধগণের মতো যিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন বলে 'তথাগত' । গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব শান্তিকামী বিশ্বের জন্য এক মহাবিস্ময়। বুদ্ধের আবির্ভাবে ভারতবর্ষসহ বিশ্বের মানবাত্মার মহিমা নতুন করে উদঘোষিত হয়।

তথাগত বুদ্ধ যে সত্যধর্ম প্রচার করেন, তাতে বলা হয়েছে–মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা, আত্মশরণে বা আত্মপ্রচেষ্টায় নির্বাণ লাভে সক্ষম, অন্য কারও কৃপায় নয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বৌদ্ধধর্ম' গ্রন্থে লিখেছেন- 'বৌদ্ধধর্মের সার উপদেশ এই যে, প্রত্যেক মনুষ্য নিজ কর্মগুণে, নিজ পুণ্যবলে,আত্মপ্রভাবে, সত্যোপার্জনে, প্রেম, দয়া, মৈত্রী বন্ধনে ঐহিক-পারত্রিক মঙ্গল নিদান নির্বাণ রূপ মুক্তিলাভের অধিকারী। যে পথে চলিতে হইবে, তা বুদ্ধ প্রদর্শিত অষ্টাঙ্গিক ধর্মপথ, গম্যস্থান নির্বাণমুক্তি, সারথি আত্মশক্তি।'

মহাপরিনির্বাণ লাভের পূবে তথাগত বুদ্ধ তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দকে সম্বোধন করে বলেছিলেন– 'হে আনন্দ, আত্মদীপ হয়ে বিহার করো, ধর্মশরণ হয়ে বিহার করো।'
তথাগত বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপরিনির্বাণ বৈশাখের মহাপূণ্যলগ্নে বিশাখা নক্ষত্রযোগে সংঘটিত হয়েছিল বলে বিশ্বে সর্বত্র 'শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা' নামে উদযাপিত হয়। এটি তথাগত বুদ্ধে ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত মহাপুণ্যময় দিন। শান্তি, মৈত্রী ও করুণার প্রতীক তথাগতের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত দিনটি বৌদ্ধ ও শান্তিকামী মানুষ স্মরণ ও পালন করে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে মহাবোধে সোসাইটি হলে ১৩৪২ বঙ্গাব্দে ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ দেয়া ভাষণে বলেন- 'আমি যাকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি। তার জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলঙ্কার নয়, একান্তে নিভৃতে যা তাকে বার বার সমর্পণ করেছি। সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করি।'
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 'বুদ্ধ পূর্ণিমা' কবিতায় লিখেছেন–
'জগৎ ব্যথাভরে কাঁদিছে যোড়করে
এ মহা কোজাগরে কে দিবে বরদান,
এসো এসো শ্রেয়, এসো হে মৈত্রেয়
ক্রূরতা-মূঢ়তার কর হে অবসান।'
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা পুণ্যালোকে ধরণী হোক সুশীতল। বিশ্বের সকল প্রাণী সুখী হোক, শান্তি লাভ করুক।

Flag Counter
SCROLL FOR NEXT